হলিউডে আমেরিকার আদিবাসীদের চিত্রায়ণে পরিবর্তন আসছে

শ্বেতাঙ্গ কাউবয়দের আক্রমণের শিকার যুক্তরাষ্ট্রের আদিবাসী জনগোষ্ঠী। হলিউডের পর্দায় আদিবাসীদের এমন উপস্থাপন যেন এক অলিখিত রীতিতে পরিণত হয়েছিল।

শ্বেতাঙ্গ কাউবয়দের আক্রমণের শিকার যুক্তরাষ্ট্রের আদিবাসী জনগোষ্ঠী। হলিউডের পর্দায় আদিবাসীদের এমন উপস্থাপন যেন এক অলিখিত রীতিতে পরিণত হয়েছিল। শ্বেতাঙ্গ নায়কের টার্গেট প্র্যাকটিসের জন্যই কেবল তাদের ব্যবহার করা হতো। এমনকি আদিবাসীদের কেন্দ্র করে তৈরি সিনেমাগুলোর মূল চরিত্রে শ্বেতাঙ্গ অভিনেতাদেরই নির্বাচন করা হতো। এসব সিনেমায় যুক্তরাষ্ট্রের আদিবাসী জনগণকে নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন করা হতো। গত শতকের পুরোটাজুড়ে হলিউডে এমন ট্রেন্ডই ছিল। এখনো অনেকাংশেই তা বজায় আছে। তবে পরিবর্তন তো শাশ্বত। তাই সিনেমায় আদিবাসীদের উপস্থাপনের এ ধারায়ও ট্রেন্ড থেকে বেরিয়ে আসার প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে। সিনেমার গল্প তাদের প্রেক্ষাপট থেকে বলা হচ্ছে। তার সাম্প্রতিকতম উদাহরণ হতে যাচ্ছে কিলারস অব দ্য ফ্লাওয়ার মুন।

ওসেজ নেশন। যুক্তরাষ্ট্রের ওকলাহোমা অঙ্গরাজ্যে এ আদিবাসী জাতির বসতি। ১৯২০-এর দশকজুড়ে তাদের ওপর কয়েক ধাপে বর্বর হত্যাকাণ্ড চালিয়েছিল শ্বেতাঙ্গরা। উদ্দেশ্য ওসেজদের জমি ও সম্পদ দখল করা। ইতিহাসের সে অন্ধকার দিক নিয়ে পরিচালক মার্টিন স্করসেসি নিয়ে আসছেন কিলারস অব দ্য ফ্লাওয়ার মুন। তবে এ সিনেমা তৈরি করতে গিয়ে তিনিও প্রথমে বিভ্রমের শিকার হয়েছিলেন। অনুসরণ করেছিলেন হলিউডের বহুল প্রচলিত ট্রেন্ড। অর্থাৎ ওসেজদের ইতিহাসের ওপর ভিত্তি করে সিনেমা হলেও কেন্দ্রে ছিল শ্বেতাঙ্গরাই। তবে তিনি প্রাজ্ঞ নির্মাতা। তাই এ বিভ্রান্তি কাটতে সময় লাগেনি তার। কিলারস অব দ্য ফ্লাওয়ার মুনের শুটিং চলাকালীন পুনরায় লেখা হয়েছে চিত্রনাট্য। উদ্দেশ্য আদিবাসী চরিত্রগুলোকে সিনেমার কেন্দ্রে নিয়ে আসা। সে কারণে মূল চরিত্রে এসেছে পরিবর্তন। শুরুতে লিওনার্দো ডিক্যাপ্রিওকে ঘিরে আবর্তিত হয়েছিল সিনেমার গল্প। একটি মহাকাব্যিক ক্রাইম সিনেমা হওয়ার কথা ছিল এটির। কিন্তু নতুন চিত্রনাট্যে তৈরি হয়েছে নতুন অবস্থান। আদিবাসী তারকা লিলি গ্ল্যাডস্টোনের চরিত্রটিকে আরো বড় ও গুরুত্বপূর্ণ করা হয়েছে। তাকেই দেখা যাবে মুখ্য চরিত্রে। আগে শ্বেতাঙ্গদের দিক থেকে গল্পটি বলার আয়োজন করা হয়েছিল। পরিবর্তিত চিত্রনাট্যে আদিবাসীদের দৃষ্টিকোণ থেকেই সিনেমাটি তৈরি করা হয়েছে। ওসেজদের ওপর চালানো বর্বরতাকে আরো বিস্তারিতভাবে ও গুরুত্ব দিয়ে দেখানোর চেষ্টা করা হয়েছে। সম্প্রতি কিলারস অব দ্য ফ্লাওয়ার মুন টিমের পক্ষ থেকে ঘোষণা করা হয়েছে যে অস্কারে লিলি গ্ল্যাডস্টোন পার্শ্ব চরিত্র নয়, বরং মূল অভিনেতা হিসেবেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন। নিজের বিভ্রম ও আত্মোপলব্ধি কবুল করে নিয়েছেন স্বয়ং মার্টিন স্করসেসি। টাইম ম্যাগাজিনকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘এক পর্যায়ে উপলব্ধি করলাম যে আমি কেবল শ্বেতাঙ্গ চরিত্রদের নিয়েই একটি সিনেমা বানাচ্ছি।’ এতটুকুই। এক বাক্যেই তিনি নিজের দায় স্বীকার করে নিয়েছেন। আদিবাসীদের প্রতি হলিউডের দৃষ্টিভঙ্গির বিবর্তনের ক্ষেত্রে এটিই হতে যাচ্ছে সাম্প্রতিকতম পদক্ষেপ। ২০ অক্টোবর মুক্তি পাবে কিলারস অব দ্য ফ্লাওয়ার মুন। মার্টিন স্করসেসি কীভাবে আদিবাসীদের উপস্থাপন করেছেন, তা তখন দর্শকের কাছে আরো পরিষ্কার হবে। এখন হলিউডের সিনেমাগুলোয় আদিবাসীদের কীভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে তার কিছু নমুনা চলুন দেখে নেয়া যাক।

এক্ষেত্রে পরিচালক জন ফোর্ড নির্মিত সিনেমাগুলো প্রকৃষ্ট উদাহরণ হতে পারে। ১৯৩৯ সালে তিনি তৈরি করেছিলেন ‘ড্রামস অ্যালং দ্য মোহক’। মোহকরা উত্তর আমেরিকার আদিবাসী জনগোষ্ঠী। তাদের ভূখণ্ডে জবরদস্তিমূলক বসতি স্থাপন করতে চায় শ্বেতাঙ্গরা। স্বাভাবিকভাবেই রুখে দাঁড়ায় মোহক যোদ্ধারা। এখানে নায়ক তো তারাই। শ্বেতাঙ্গ দখলদারদের বিরুদ্ধে তারা প্রতিবাদ করেছে। কিন্তু সিনেমার গল্প এমনভাবে সাজানো হয়েছে যাতে মোহকদেরই ভিলেন মনে হয়। ১৯৫৬ সালে ফোর্ডের বানানো ‘দ্য সার্চার্স’ সিনেমায়ও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। তবে ১৯৬৪ সালে নির্মিত ‘চিয়েন অটাম’ সিনেমায় নিজের পূর্বাবস্থান থেকে খানিকটা সরে আসেন জন ফোর্ড। সিনেমাটিতে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ওপর হওয়া ঔপনিবেশিক বর্বরতাকে সহানুভূতির সঙ্গে দেখানো হয়। কিন্তু ততটুকুই। মূল নায়ক ও রক্ষাকর্তা হিসেবে দেখানো হয়েছে শ্বেতাঙ্গদেরই। তারাই সিনেমাটির কেন্দ্রে, আদিবাসীরা নয়।

হলিউডের সিনেমায় আদিবাসী চরিত্রে অভিনয়ও করানো হয়েছে শ্বেতাঙ্গ অভিনেতাদের দিয়ে। তার একটি নমুনা ‘ওয়াইন্ডওয়াকার’ সিনেমাটি। কিথ মেরিলের পরিচালনায় ১৯৮১ সালে সিনেমাটি মুক্তি পেয়েছিল। সেখানে এক চিয়েন যোদ্ধার বীরত্ব তুলে ধরা হয়েছে। এটি নিঃসন্দেহে চমৎকার। কিন্তু বিপত্তিটা লাগে অন্য জায়গায়। অদ্ভুতভাবে চিয়েন যোদ্ধার ভূমিকায় ব্রিটিশ অভিনেতা ট্রেভর হাওয়ার্ডকে দিয়ে অভিনয় করানো হয়েছিল।

গত শতাব্দীর শেষ দিক থেকে আদিবাসীদের কেন্দ্রে রেখে সিনেমা বানানোর প্রবণতা বাড়তে থাকে। তেমনই একটি সিনেমা হলো ১৯৯০ সালে মুক্তি পাওয়া ‘ড্যান্সেস উইথ ওলভস’। এর ব্যাপক সাফল্য সিনেমায় যুক্তরাষ্ট্রের আদিবাসীদের জীবন ও সংস্কৃতিকে অধিকতর গুরুত্ব দিয়ে তুলে ধরার ক্ষেত্রে শ্বেতাঙ্গ নির্মাতাদের অনুপ্রাণিত করে। সে ধারাবাহিকতায় একে একে নির্মিত হয় ‘দ্য লাস্ট অব দ্য মোহিকানস’, ‘জেরোনিমো’, ‘থান্ডারহার্ট’, ‘দ্য নিউ ওয়ার্ল্ড’-এর মতো সিনেমা। পরিচালনায় এসেছেন আদিবাসী নির্মাতারাও। চিয়েন আদিবাসী গোষ্ঠীর সদস্য পরিচালক ক্রিস আয়ার নির্মাণ করেছেন ‘স্মোক সিগন্যালস’। আরেক আদিবাসী পরিচালক স্টার্লিন হার্জো নির্মাণ করেছেন ‘রিজার্ভেশন ডগস’।

ইতিহাসে বারবার আদিবাসীদের ওপর বর্বর আক্রমণ চালানো হয়েছে। তাদের ভূমি দখল করে তৈরি করা হয়েছে উপনিবেশ। তেমনি হলিউডেও তারা হয়েছে সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের শিকার। আশার কথা হচ্ছে সে পরিস্থিতিতে পরিবর্তন আসছে। হচ্ছে ইতিবাচক বিবর্তন।

আরও