বাংলাদেশে নারী নির্যাতনের ইতিহাস বহু দিনের। ঘরে বাইরে নানাভাবে নির্যাতন ও বৈষম্যের শিকার তারা। অথচ বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, জুলাই আন্দোলনসহ দেশের যেকোন ক্রান্তিলগ্নে পুরুষের পাশাপাশি নারীরা মুখ্য ভূমিকা পালন করেছেন। দেশের বহু গুরুত্বপূর্ণ সেক্টরে তারা কাজ করছেন, দেশকে এগিয়ে নিচ্ছেন। কিন্তু ঘরে ও বাইরে এ নারীরা নিরাপদ নন। সম্প্রতি এটি আরো কমেছে। প্রতিদিনই হেনস্তা, ধর্ষণ, নির্যাতনের খবর পাওয়া যায়। আজ ৮ মার্চ। আন্তর্জাতিক নারী দিবস। এ দিন নতুন করে বাংলাদেশে নারীর নিরাপত্তা নিয়ে কথা বলা প্রয়োজন। বণিক বার্তার সঙ্গে এ নিয়ে কথা হয়েছে বিনোদন অঙ্গনের কয়েকজন শিল্পীর সঙ্গে।
নারী নিরাপত্তা নিয়ে অভিনেত্রী কাজী নওশাবা আহমেদ বলেন, ‘শুধু নারী দিবস এলেই আমরা নারীদের প্রতি সহমর্মী হয়ে উঠি। এটা থেকে আমাদের বের হয়ে আসতে হবে। আমাদের সারা বছর নারীর অধিকার ও নিরাপত্তার বিষয়ে কথা বলা উচিত। একটা স্বাধীন রাষ্ট্রে আমাকে আমার নিরাপত্তা নিয়ে ভাবতে হচ্ছে, এটাই জাতিগতভাবে ভীষণ লজ্জার। নারী দিবসে আমি শুধু নারী নিরাপত্তার কথা বলতে চাই না, আমি সার্বিক নিরাপত্তার কথা বলতে চাই।’
এ বিষয়ে নওশাবা বলেন, ‘নারী নিরাপত্তার পাশাপাশি আমাদের শিশু অধিকার নিয়ে কথা বলতে হবে। আমরা শিশুদের খেলার মাঠ দিতে পারি না। তাদের খেলাধুলার কোনো জায়গা নেই, মনোরঞ্জনের কোনো জায়গা নেই। তারা সবসময় দেখছে মারামারি কাটাকাটি। ফলে শিশুরা শৈশব থেকেই মনোরঞ্জন ও সুস্থ সংস্কৃতি চর্চার অভাবে অপরাধপ্রবণ হয়ে বড় হচ্ছে। ফলে ধর্ষণ ও নানা অপকর্মে জড়িত হচ্ছে।’
সুস্থ জাতি গঠন ও নারী-পুরুষের বৈষম্যহীন সমাজব্যবস্থা তৈরির জন্য সংস্কৃতি চর্চার আবশ্যকতা জরুরি বলে মনে করেন তিনি।
বিষয়টি নিয়ে এ সময়ের আরেক জনপ্রিয় অভিনেত্রী এলিনা শাম্মী বলেন, ‘বাংলাদেশের মতো পুরুষ শাসিত সমাজে এটা একটা কমন বিষয়। শুধু বর্তমান সময়ে এসে নারীরা যে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে এমনটা নয়। নারীরা সবসময় নির্যাতিত, নিগৃহীত ও বঞ্চিত। মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে জুলাই আন্দোলনে প্রতিটা সময় নারীদের যেমন অবদান ছিল পরবর্তী সময়েও তারা নিগৃহীত হয়েছে সমানভাবে। নারীদের প্রতি এ অন্যায় একটা চলমান প্রক্রিয়া।’
আগের তুলনায় নারীরা বর্তমানে অনেক বেশি সোচ্চার উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘নিকট অতীতের তুলনায় বর্তমানে নারীরা নিজেদের বিষয়ে সোচ্চার। তারা তাদের অধিকারের বিষয়ে অনেক বেশি সচেতন। যে কারণে আমার কাছে মনে হয় এখন সময় বদলাচ্ছে। নারীদের নিজস্ব সচেতনতা ও আত্মবিশ্বাসের পাশাপাশি নারী শিক্ষার হার বাড়ছে। কর্মক্ষেত্রেও অনেক বেশি অবদান রাখছে। যার কারণে তারা আত্মমর্যাদার জায়গায় অনেক বেশি সচেষ্ট। যে কারণে নারীদের নিজস্ব জায়গাটা আগের থেকে অনেক বেশি মজবুত।’
চলমান অবস্থা কাটিয়ে ওঠার সম্ভাবনা নিয়ে বলেন, ‘জুলাই আন্দোলনের মতো এত বড় একটা বিপ্লব, ছিন্নভিন্ন একটা দেশ, নতুন একটা সরকার, পুলিশের নীরবতা সবকিছু মিলিয়ে যে প্রভাব, এটা যথারীতি নারীর ওপর পড়েছে। ইনশাআল্লাহ এটাও আমরা কাটিয়ে উঠব।’
অভিনেত্রী মনিরা মিঠু বলেন, ‘নারীদের নিরাপত্তা বাংলাদেশে কোনো কালেই ছিল না। আগেও যেমন নিরাপত্তা শঙ্কায় নারীরা ভুগেছেন এখনো ভুগছে। এখন যা হচ্ছে, অতীতেও এ রকম আমরা অনেক দেখেছি। এর জন্য আমি বাংলাদেশের আইন ব্যবস্থাকে দায়ী করব। কারণ আমাদের দেশের আইন-শৃঙ্খলার অবস্থা একেবারেই খারাপ।’
নির্যাতনকারীদের শাস্তির প্রতি গুরুত্ব দিয়েছেন মিঠু। তিনি বলেন, ‘নারীদের নিরাপত্তা যারা বিঘ্নিত করবে এবং যারা দর্শনসহ গুরুতর অপরাধ ঘটাবে, তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া উচিত বলে আমি মনে করি।’
নারী দিবস উপলক্ষে মনিরা আক্তার মিঠু বলেন, ‘নারী দিবস উপলক্ষে আমাদের দেশে অনেক সেমিনার হয়। সেখানে বিভিন্ন রকমের আলোচনাও হয়, কিন্তু দিন শেষে আমরা যা দেখছি নারী নির্যাতন কমছে না, নারীরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে।’
নিরাপত্তা কেমন করে আনা যায় সে প্রসঙ্গে বলেন, ‘নারীদের নিরাপত্তা রক্ষার্থে প্রয়োজন সরকারকে কঠোর আইন প্রণয়ন করা ও তা কার্যকর করা। নারীদের জন্য আলাদা পরিবহন তৈরি করে দেয়া। বাসের মধ্যে নারীরা ইভটিজিয়ের এর শিকার হয়, এগুলো শক্ত হাতে প্রতিরোধ করা। তাছাড়া পারিবারিকভাবেও সন্তানদের প্রতি নজর রাখা উচিত, কখন কী করছে খেয়াল রাখা উচিত।’
অভিনেত্রী মোমেনা চৌধুরী বলেন, ‘নারীদের নিরাপত্তা কোনো কালেই ছিল না। এখনো নেই। নারী যদি নিরাপদ থাকত, তাহলে দেশে এত ধর্ষণ হতো না। তাছাড়া এখন পুলিশবাহিনী একেবারেই দায়িত্ব নিচ্ছে না। এ কারণে নারীর নিরাপত্তাহীনতা আরো বেড়ে গেছে। সময়টা এখন খুবই খারাপ।’
সংস্কৃতি চর্চার জায়গায়ও নারীরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘বিভিন্ন জায়গায় শুটিংয়ে বিভিন্ন সমস্যা হচ্ছে। শিল্পকলায় দর্শক নেই। শিল্পকলায় ছেলেমেয়েরা আড্ডা দিচ্ছে না। সম্প্রতি সিগারেট খাওয়া নিয়েও একটা ঘটনা ঘটে গেল, সবকিছু মিলিয়ে আতঙ্কে আছি।’
প্রশাসনিক কাঠামো আরো শক্ত করার প্রয়োজন মনে করেন তিনি। এ বিষয়ে মোমেনা চৌধুরী বলেন, ‘আমার মনে হচ্ছে না যে প্রশাসন খুব ভালোভাবে কাজ করছে। নারী দিবসে আমি এটাই চাইব যে আমাদের প্রশাসনে যোগ্য মানুষ আসুক। প্রশাসনে লোকবল বাড়ানোর প্রয়োজন। প্রশাসনে এমন মানুষ নিয়ে আসা উচিত, যারা দেশটাকে ভালোভাবে মেইনটেইন করতে পারবে। নারীরা নির্ভয়ে মুক্ত স্বাধীনভাবে চলতে পারবে। নারী দিবসে আমি এটাই কামনা করছি।’