চ্যাম্পিয়নস লিগ

রাজাদের ঘরে রাজত্ব করে সেমিফাইনালে আর্সেনাল

দুই লেগ মিলিয়ে ৫-১। শুধু রিয়াল মাদ্রিদকে হারানোই নয়, একেবারে উড়িয়ে দিয়েছে আর্সেনাল। ওপরের স্ট্যান্ডে তখন গানার্স সমর্থকরা গলা ফাটিয়ে গাইছে— এ তাদের ইউরোপিয়ান ইতিহাসের সেরা রাতগুলোর একটি, তাও আবার সবচেয়ে মহিমান্বিত মঞ্চে।

নাম তার সান্তিয়াগো বার্নাবেউ, চ্যাম্পিয়নস লিগের রাজাদের ঘর। কিন্তু এই রাতে, যখন অন্তহীন গল্পের শেষ পৃষ্ঠায় এসে কলম থামে, সেখানে দাঁড়িয়ে বুকায়ো সাকা, উত্তর দিকের গ্যালারির সামনে সেই চেনা কাঁধ ঝাঁকানো ভঙ্গিমায় যেন বললেন, তো কেমন হলো এবার? ইতিহাসের পাতায় লিখে রাখার মতো এক রাত, আর্সেনালের নিজস্ব গল্প— যেমনটা চেয়েছিলেন মিকেল আর্তেতা। এ এক পরিণতির গল্প, পরিপক্বতার গল্প।

চ্যাম্পিয়নস লিগের সেমিফাইনালে ওঠা নিশ্চিত করে দেয়া সেই গোলটা যেন দলের পারফরম্যান্সের এক নিখুঁত প্রতিচ্ছবি— ধৈর্য, নিয়ন্ত্রণ, পরিণত সিদ্ধান্ত এবং সাহস। সাকা প্রথমার্ধে একটা পেনাল্টি মিস করেছিলেন, যেটা হয়তো আরো আগেই ম্যাচের ভাগ্য লিখে দিতে পারত। বার্নাবেউয়ের গর্জনের ভেতর পেনাল্টি মিসের সেই মুহূর্তটা ভয়াবহ লাগলেও তিনি ভেঙে পড়েননি। ভয় পাননি। কেউই পায়নি। রিয়াল মাদ্রিদের কিংবদন্তি, গ্যালাকটিকোর ইতিহাস বা সান্তিয়াগো বার্নাবেউয়ের ভয়ঙ্কর পরিবেশ— কিছুই এ রাতে ছুঁতে পারেনি গানারদের। এখানে এসে বহু দল যেভাবে গুঁড়িয়ে পড়েছে, সেই পরিণতি থেকে বেঁচে গিয়ে আর্সেনাল যেন এক ভ্রম ভেঙে দিল।

প্রথম লেগের ৩-০ লিড এদিন কোনো সময়ই প্রকৃত অর্থে চাপে পড়েনি। এমনকি সাকার গোলের ঠিক পরপর স্যালিবার ভুলে ভিনিসিউস জুনিয়রের গোলেও না। যেখান থেকে সাধারণত ভুল করা শুরু হয়, আত্মবিশ্বাস ভেঙে যায়— সেখানে বরং কালো অ্যাওয়ে জার্সিধারী আর্সেনাল ছিল আরো বেশি শান্ত, আরো বেশি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। এরপর শেষ মুহূর্তে গ্যাব্রিয়েল মার্তিনেল্লি মাঝমাঠ থেকে ছুটে এসে থিবো কর্তোয়াকে পরাস্ত করলেন আর বার্নাবেউয়ের রাতটা পূর্ণতা পেল।

দুই লেগ মিলিয়ে ৫-১। শুধু রিয়াল মাদ্রিদকে হারানোই নয়, একেবারে উড়িয়ে দিয়েছে আর্সেনাল। ওপরের স্ট্যান্ডে তখন গানার্স সমর্থকরা গলা ফাটিয়ে গাইছে— এ তাদের ইউরোপিয়ান ইতিহাসের সেরা রাতগুলোর একটি, তাও আবার সবচেয়ে মহিমান্বিত মঞ্চে। এক সপ্তাহ আগে মাদ্রিদকে বিধ্বস্ত করেছে, এবার পরিণত ম্যাচ ম্যানেজমেন্টে তারা বুঝিয়ে দিল কারা আসলে সেরা। ডেকলান রাইস, মার্টিন ওডেগার্ড আর থমাস পার্টে মিলে মাঝমাঠে দাপট দেখিয়েছেন, খেলা নিয়ন্ত্রণে রেখে শেষ কাজটাও সম্পন্ন করলেন নিখুঁতভাবে।

গোলের পর বুকায়ো সাকা। ছবি- এপি

সব কিছুর মাঝে আর্তেতার জন্য একটাই হতাশার খবর, হলুদ কার্ড দেখে পিএসজির বিপক্ষে প্রথম লেগ মিস করবেন পার্টে। কিন্তু এর বাইরেও গল্প ছিল। আর্সেনাল শুরু থেকেই ছিল দুর্দান্ত। সাকা একাধিকবার সুযোগ তৈরি করেছেন, কর্তোয়া অসাধারণ সেভে দলকে বাঁচিয়েছেন। বারো মিনিটে পেনাল্টি পেলেও সাকার দুর্বল শটে সেই সুযোগ হাতছাড়া হয়। কর্তোয়া হাত বাড়িয়ে বাঁচান, গর্জে ওঠে বার্নাবেউ।

কিন্তু এরপরই রাইসের বিরুদ্ধে বিতর্কিত এক ফাউলে মাদ্রিদ পেনাল্টি পেতে পারত। তবে ভিএআরের সাহায্যে সিদ্ধান্ত পাল্টে যায়। সেটাই যেন রূপ দেয় পরিকল্পনায়। আর্তেতা যেভাবে বলেছিলেন, মাদ্রিদকে অস্থির করে ধীরগতিতে খেলায় নিয়ন্ত্রণ নিতে হবে— ঠিক সেটাই করল তার দল। প্রথমার্ধে ডেভিড রায়াকে কোনো সেভই করতে হয়নি, আর মাদ্রিদকে তিনবার বাঁচান কর্তোয়া। মাদ্রিদের বিখ্যাত আক্রমণভাগ এদিন নামের ভারেই যেন নুয়ে পড়েছিল। কোথাও দেখা মেলেনি সৃষ্টিশীলতার। ছায়া হয়ে ঘুরে বেড়িয়েছেন এমবাপ্পে। একমাত্র উল্লেখযোগ্য মুহূর্ত ছিল ভিনিসিউসের এক দূরপাল্লার শট।

দ্বিতীয়ার্ধে ম্যাচের মোড় ঘুরে যায়। রায়ার লং বলে রাইসের হেডে বল যায় সাকার পায়ে। ওডেগার্ড থামিয়ে খোঁজেন উপযুক্ত পাস। মেরিনো চমৎকার এক বল বাড়ান, আর সাকা ঠাণ্ডা মাথায় ওয়ান টাচে দারুণ এক চিপে বলটা জালে জড়ান। এরপর সেই অপ্রত্যাশিত ভুল। স্যালিবার মনোযোগ সরে যাওয়া আর ভিনিসিউসের গোল। একটা মুহূর্তে বার্নাবেউ জেগে ওঠে, মনে হয় নতুন কোনো উন্মাদনার সূচনা। কিন্তু না, আর্সেনাল এবার আর সেই গল্প লিখতে দেয়নি।

বার্নাবেউতে সবচেয়ে নাটকীয় মুহূর্তগুলো আসে অন্তিম সময়ে, এবং অবশ্যই তা ঘটান রেয়াল মাদ্রিদ। এ রাতে এমন সময়ে মার্তিনেল্লি এসে গাঁথলেন শেষ ছুরিটি। কর্তোয়াকে পরাস্ত করে গোল করে লিখে দিলেন ম্যাচের উপসংহার। আর্তেতা ও তার ছেলেরা মাদ্রিদের মাটিতে রূপকথা লিখলেন।

১৬ বছর পর চ্যাম্পিয়নস লিগের সেমিফাইনাল নিশ্চিতের ম্যাচে এটা শুধুই জয় নয়, এটা এক বার্তা— ইউরোপ, এবার আর্সেনালকে গুরুত্ব দিয়ে দেখো।

আরও