আর্থিক জালিয়াতির অভিযোগ

বাফুফে সাধারণ সম্পাদককে দুই বছর নিষিদ্ধ করল ফিফা

বাংলাদেশ ফুটবলে দীর্ঘদিনের অনিয়ম ও জালিয়াতির পর অবশেষে বোমার মতোই বিস্ফোরণ।

বাংলাদেশ ফুটবলে দীর্ঘদিনের অনিয়ম ও জালিয়াতির পর অবশেষে বোমার মতোই বিস্ফোরণ। আর্থিক জালিয়াতির দায়ে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের (বাফুফে) সাধারণ সম্পাদক আবু নাঈম সোহাগকে দুই বছর নিষিদ্ধ করেছে আন্তর্জাতিক ফুটবল সংস্থা (ফিফা)। সঙ্গে ১০ হাজার সুইস ফ্রাঁ জরিমানাও গুনতে হবে তাকে। ফিফার ওয়েবসাইটে ১৪ এপ্রিল সোহাগকে নিষিদ্ধ করার খবরটি দেয়া হয়। 

দীর্ঘ তদন্ত ও শুনানি কার্যক্রম চালিয়ে অপরাধের প্রমাণ পেয়েছে ফিফা। মোট চারটি ধারায় অভিযোগ আনা হয়েছিল। সাধারণ কর্তব্য, আনুগত্যের দায়িত্ব, জালিয়াতি ও মিথ্যাচার ও তহবিল তছরুপ ও অপব্যবহারের অভিযোগ তার বিরুদ্ধে।

ফিফার স্বাধীন এথিকস কমিটির বিচারিক চেম্বার জানিয়েছে, এর মধ্যে প্রথম তিনটি ধারায় অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে। কেনাকাটা ও ফিফার তহবিল অপব্যবহার নিয়ে আবু নাঈম সোহাগকে পাঠানো ৫১ পৃষ্ঠার চিঠিটি ফিফার ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে। যে চিঠির অনুলিপি দেয়া হয়েছে বাফুফে ও এএফসিকে।

২০১৭ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরের মধ্যে এ অপরাধগুলো করেছেন সোহাগ। যেটির তদন্ত শুরু হয় ২০২০ সালের অক্টোবরে। গত বছর অক্টোবরে তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পর ফিফার সদর দপ্তরে শুনানি হয় ১৬ ফেব্রুয়ারি। 

নিয়মানুযায়ী ফরওয়ার্ড ফান্ডের অর্থ নির্দিষ্ট একটি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে রাখাটা ফিফার নিয়মে বাধ্যতামূলক। লেনদেনও শুধু সেখান থেকেই করার নিয়ম। ফিফার তদন্তে এখানেই বড় দাগে তিনটি অনিয়ম দেখা গেছে। এর মধ্যে আছে ফিফার তহবিলের জন্য নির্দিষ্ট অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা নগদে উত্তোলন করা, ফিফা সম্পর্কিত প্রকল্প বা প্রোগ্রামে অন্য অ্যাকাউন্টের টাকা ব্যবহার এবং ফিফা তহবিলের টাকা ভিন্ন খাতে ব্যয় করা।

ফিফা নৈতিকতা বিষয়ক কমিটির ইনভেস্টিগেটরি চেম্বার বেশ কিছু লেনদেন বিশ্লেষণ করে ৫ লাখ ৯৭ হাজার ৮৪ ডলার লেনদেনে আর্থিক অসংগতি খুঁজে পেয়েছে। এটি যাচাইকৃত লেনদেনের ১৭.৭৩ শতাংশ। এছাড়া ২০১৬ সালে ফিফা ফান্ডের মাত্র ১২.৬৯ শতাংশ সঠিকভাবে লেনদেন করা হয়েছে বলে তদন্তে উঠে এসেছে।

ফিফার ইনভেস্টিগেটরি চেম্বার ২০১৬ থেকে ২০১৯ সালের কেন্দ্রীয় পর্যালোচনা এবং নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান বিডিও ২০১৭ থেকে ২০১৯ সালের পুঙ্খানুপুঙ্খ নিরীক্ষা বিশ্লেষণ করেছে। এর মাধ্যমে ফরওয়ার্ড নীতিমালা প্রতিপালনে বাফুফে ক্রমাগত ব্যর্থ হয়েছে বলে মন্তব্য করা হয়েছে ফিফার প্রতিবেদনে।

ইনভেস্টিগেটরি চেম্বারের পর্যবেক্ষণে উঠে আসে, ফান্ডের খরচের আওতায় থাকা খাতে নির্ধারিত ব্যাংক অ্যাকাউন্টের বদলে বাফুফের পরিচালন ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে খরচ করা হয়েছে। যেমন ২০১৬ সালের কেন্দ্রীয় পর্যালোচনায় দেখা যায়, ওই বছর ফিফা ফরওয়ার্ড ফান্ডে ৭ লাখ ৮ হাজার ৮২০ ডলার পেয়েছিল বাফুফে। এর মধ্যে মাত্র ৯০ হাজার ১৪ ডলার ফিফা নির্ধারিত অ্যাকাউন্ট থেকে খরচ করা হয়, যা প্রদেয় অর্থের মাত্র ১২.৬৯ শতাংশ।

বাফুফের খরচে আরো যেসব অসংগতি ধরা পড়ে:

নারী ফুটবলে ভ্রমণ ও বেতন বাবদ ১ লাখ ৭ হাজার ৬৩৪ ডলার খরচের কোনো সহায়ক কাগজপত্র দেখানো হয়নি।

জাতীয় দলের কোচ ও টেকনিক্যাল ডিরেক্টরকে ৪৪ হাজার ১০০ ডলার বেতন দেয়া হয়েছে নগদে। আবার বাফুফের ব্যাংক রেকর্ডে দেখা যায়, এ বেতন ব্যাংক ট্রান্সফারের মাধ্যমে দেয়া হয়েছে। যাতে মনে হতে পারে, এ বেতন দুইবার দেয়া হয়েছে।

 ২০১৪ ও ২০১৫ সালের প্রশাসনিক খরচ বাবদ ৩৫ হাজার ৫৭৩ ডলার খরচের কথা ২০১৬ সালেও উল্লেখ করা হয়। এখানেও দুইবার পরিশোধের ব্যাপার থাকতে পারে।

বাংলাদেশের ফুটবল ক্লাবগুলোকে ১ লাখ ২৪ হাজার ৫৩৫ ডলার ভর্তুকি দেয়া হয়েছিল। যেটা ফিফা ফরওয়ার্ড নীতিমালার অংশ নয়, ফিফার সঙ্গে সম্মতিক্রমেও হয়নি। তার ওপর, এ অর্থ বিতরণের পক্ষে যথাযথ প্রমাণও নেই, যার মধ্যে ৫৩ হাজার ৫৮৮ ডলার দেয়া হয় নগদে।

ফিফার নিয়োগ করা নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান বিডিওর ২০১৭-২০ নিরীক্ষায় দেখা যায়, ফিফা ফরওয়ার্ড ব্যাংক অ্যাকাউন্টের অর্থ ফিফা সম্পর্কিত খাতে ব্যয় করার কথা থাকলেও সেটি অনুসরণ করা হয়নি। ফরওয়ার্ড প্রোগ্রামের সঙ্গে যুক্ত নয়, এমন খাতের জন্য নগদ টাকা তোলা হয়েছে। কী উদ্দেশ্যে নগদ টাকা তোলা হয়েছে সেই ব্যাখ্যা বা প্রমাণপত্র বাফুফের কাছ থেকে পাওয়া যায়নি। ফিফার প্রতিবেদনে আবু নাঈম সোহাগের ব্যাখ্যাও জুড়ে দেয়া হয়েছে। যাতে সোহাগ বলেছেন, ‘অনেক সময় স্পন্সরদের কাছ থেকে সময়মতো টাকা পাওয়া যায় না। কিন্তু বিভিন্ন টুর্নামেন্ট ও অনুষ্ঠান সময়মতোই আয়োজন করতে হয়। এ ধরনের ঘটনায় বাফুফের সিদ্ধান্তে সাময়িকভাবে ফিফা ফান্ড থেকে অর্থ নিয়েছি। অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা গেছে, প্রতিশ্রুত সময়ের মধ্যেও আমরা স্পন্সরদের টাকা পাইনি। তখন আমাদের ব্যাংক ও নির্বাহী কমিটির সদস্যদের কাছ থেকে ধার নিতে হয়েছে। এসব টাকা আমরা বাফুফের অন্য অ্যাকাউন্টে জমা রেখেছি। ওইসব অ্যাকাউন্ট থেকে ফিফা অনুমোদিত বাজেটের মধ্যে খরচ করা হয়। আমরা ফিফা অ্যাকাউন্ট থেকে টানা নিয়েছি শুধু ধার বাবদ।’

এদিকে, নিষেধাজ্ঞার শাস্তিকে অবৈধ হিসেবে দাবি করলেন সোহাগ নিজে। তিনি জানিয়েছেন, কোট অব আরবিট্রেশন ফর স্পোর্টস (খেলাধুলা সম্পর্কিত আন্তর্জাতিক আদালত) ফিফার রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করবেন তিনি।

গতকাল গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে এ কথা জানান আবু নাইম সোহাগের আইনি সহায়তা দানকারী প্রতিষ্ঠান এ হোসাইন অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস।

আরও