শেষ পর্যন্ত ম্যাচটি বার্সেলোনার জন্য তুলনামূলক স্বস্তিদায়কই ছিল। সেরহু গিরাসির হ্যাটট্রিক মুহূর্তে মুহূর্তে উত্তেজনা বাড়িয়েছে। বলের দখল নিয়ে আধিপত্য বিস্তার করতে পারেনি হ্যান্সি ফ্লিকের দল, কিন্তু তবুও আগের লেগের বড় ব্যবধানে জয় নিরাপত্তার একটা চাদরে ঢেকে রেখেছিল বার্সাকে। আর তাতেই কিনা চলতি মৌসুমে ‘অজেয়’ বার্সেলোনার দেখা মেলেনি সিগনাল ইদুনা পার্কে। চ্যাম্পিয়নস লিগের কোয়ার্টার ফাইনালের ফিরতি লেগে বরুসিয়া ডর্টমুন্ডের ঘরের মাঠে অনেক নাকাল হয়েই ১-৩ গোলে হেরেছে ব্লগ্রানারা। তবে দুই লেগ মিলিয়ে ৫-৩ ব্যবধানে শেষ পর্যন্ত ৬ বছর পর সেমির টিকেট গিয়েছে বার্সার পকেটেই। তবে ঠিক সময়মতো পাওয়া আত্মঘাতী গোলটা না এলে, রাতটা তাদের জন্য হতে পারত বেশ বিব্রতকর।
‘আমি জানতাম এমন কিছু একটা ঘটতে পারে, কারণ এই স্টেডিয়ামটা আমি খুব ভালো চিনি,’ ম্যাচ শেষে বললেন বার্সেলোনা কোচ হ্যান্সি ফ্লিক, যিনি এক সময় বায়ার্ন মিউনিখের কোচ ছিলেন। ‘সবকিছু ঠিকঠাক হয়নি আমাদের জন্য, আর ডর্টমুন্ড দুর্দান্ত খেলেছে। আমরা যেমন খেলি, আজ তা খেলতে পারিনি।‘
বার্সার চ্যাম্পিয়ন হওয়ার সম্ভাবনা নিয়ে কিছুটা সন্দেহের ছায়া ফেলে দিয়েছে এই ম্যাচ। লিগ টেবিলের শীর্ষে থাকা ফ্লিকের বার্সার হয়তো দেখানোর মতো অনেক কিছুই আছে। তবে তাদের হাই ব্যাকলাইন নির্ভর খেলা যে ঝুঁকিপূর্ণ—আর ডর্টমুন্ডের চেয়ে নিখুঁত কোনো দল হলে হয়ত ফাঁকগুলো আরো স্পষ্ট হতো। আসলে বার্সার ঘরের মাঠে ৪-০ গোলের জয়টাই আগের সপ্তাহে ফল নির্ধারণ করে দিয়েছিল। তবুও একটা ভয় ছিল—বার্সা যদি শুরুতে গোল খেয়ে বসে! এবং সেটা ঘটেই গেল। গত আট বছরে দু’বার তিন গোলে এগিয়ে থেকেও ইউরোপীয় টুর্নামেন্টে হেরেছে বার্সা—রোমা ও লিভারপুলের কাছে। ডর্টমুন্ড সে পুরোনো দুঃস্মৃতি জাগাতে চেয়েছিল ‘ইয়েলো ওয়াল’-এর উন্মত্ত গর্জনে।
ফর্মেশন পাল্টে এদিন ৩-৪-২-১ নিয়ে মাঠে নামে ডর্টমুন্ড। মিডফিল্ডে বাড়তি মানুষ নিয়ে তারা দ্রুত প্রেস করে বার্সার খেলা ভেঙে দিতে থাকে, আর ফ্লিকের দলও সেভাবে সাড়া দিতে পারেনি।
কারিম আদেয়েমির গতিতে বারবার ফাটল ধরে বার্সার রক্ষণে। নবম মিনিটে পাসকাল গ্রসকে ফাউল করেন শেজনি, পেনাল্টি থেকে গোল করেন গিরাসি। ডর্টমুন্ডের প্রেসিং আর স্টেডিয়ামের গর্জনে তখন যেন ভীতপ্রায় বার্সা, মাঠেও কাজ করছে না পরিকল্পনা। শুরুর ২০ মিনিটে পাঁচবার লক্ষ্য বরাবর শট নেয় স্বাগতিকরা।
কোচ ফ্লিক পেদ্রিকে বিশ্রামে রেখে যে জুয়া খেলেছিলেন, সেটা যে ভুল তা তখনই বোঝা যাচ্ছিল। এরপর ৫৯ মিনিটে মাঠে নামেন বার্সার এই মিডফিল্ড কাণ্ডারি। এরপর কিছু সময় নিয়ন্ত্রণ নিতে পেরেছিল বার্সা।
দ্বিতীয়ার্ধে আবার জোরেশোরে শুরু করে ডর্টমুন্ড, আর গিরাসির হেডে দ্বিতীয় গোল পেয়েও যায় তারা। কিন্তু এরপরই ম্যাচের মোড় ঘুরে যায়। ফারমিন লোপেজের ক্রস ভুল করে নিজের জালেই পাঠান রামি বেন্সেবাইনি। এ আত্মঘাতী গোল যেন ডর্টমুন্ডের আগুনও নিভিয়ে দেয়।
রামি বেন্সেবাইনির আত্মঘাতী গোল উদযাপন করছেন রবার্ট লেভানদোফস্কি। ছবি- এপি
পরবর্তীতে, বদলি নামা জুলিয়েন দুরানভিলের দারুণ ক্রস থেকে তৃতীয় গোলটি পান গিরাসি। ১৪ মিনিট বাকি থাকতে ম্যাচের স্কোরলাইন ছিল ৩-১, আর দুই লেগ মিলিয়ে বার্সা তখন এগিয়ে ৫-৩ ব্যবধানে! এরপর জুলিয়ান ব্রান্ট গোল করলেও অফসাইডের কারণে বাতিল হয়, নাহলে ম্যাচের শেষটা আরো রুদ্ধশ্বাস হতো। ডর্টমুন্ড আসলে টাই উল্টে দিতে পারেনি, তবে বার্সার দুর্বলতা ঠিকই প্রকাশ করে দিয়েছে। আগের ম্যাচে যে বার্সা গোলের ১৩টি সুযোগ তৈরি করেছিল, এদিন করেছে ১৮টি—এটা স্পষ্ট সংকেত।
হ্যান্সি ফ্লিকের বার্সা বরাবরের মতোই হাই ডিফেন্স লাইনে খেলে, আর প্রেসিং সামান্য ব্যর্থ হলেই রক্ষণের পেছনে বিশাল ফাঁক তৈরি হয়। এটাই তাদের বিপদ। এই মৌসুমে তারা ওসাসুনা, বেনফিকা, অ্যাথলেটিকোর বিরুদ্ধে চারটি করে গোল হজম করেছে। এই ম্যাচের আগে টানা ২৪ ম্যাচ অপরাজিত বার্সার এই গতি থেমে গেছে। ম্যাচ শেষে বার্সার ডিফেন্ডার রোনাল্ড আরাউহো বলেন, ‘সংশোধনের অনেক কিছুই আছে, তবে আমরা সেমিফাইনালে। অন্য সময় হলে এই ম্যাচ আমরা হারিয়ে ফেলতাম।‘
ইন্টার না বায়ার্ন, যেই আসুক পরবর্তী রাউন্ডে—বার্সার দুর্বল প্রেসিং আর রক্ষণের পেছনের ফাঁক দেখে নিশ্চিতভাবেই তারা সুযোগ খুঁজবে। চ্যাম্পিয়নস লিগের দ্বিতীয় লেগের ভূতও বার্সাকে না খুঁজেই পারে না!