চ্যাম্পিয়নস লিগের কোয়ার্টার ফাইনালের প্রথম লেগে এই রাত এমিরেটস স্টেডিয়ামের ইতিহাসে সবচেয়ে গৌরবময় হিসেবে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। এবং সেই রাতের নায়ক—ডেকলান রাইস। কে জানতো, এই রাতে রাইসে ভর করবেন ডেভিড বেকহাম আর তার পা থেকে বাঁকানো রংধনুর মাধুর্যে রিয়ালের হৃদপিণ্ডে আঘাত হানবে মারণঘাতী জোড়া মিসাইল!
এই ম্যাচের আগে ৯ মৌসুমে ৩৩৮টি ক্লাব ম্যাচ এবং ৬৪টি আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলে রাইস কখনো সরাসরি ফ্রিকিক থেকে গোল করতে পারেননি। কিন্তু এমিরেটসে গোলশূন্য প্রথমার্ধের পর দ্বিতীয়ার্ধে মাত্র ১২ মিনিটের ব্যবধানে তিনি করলেন দুইটি। চোখ কচলানো, শিহরণ জাগানো মুহূর্ত! বলের ফ্লাইট, স্পিন, ভয়ংকরভাবে নিখুঁত বাঁক—সব মিলিয়ে এক পরিপূর্ণ রোমান্স আর থিবো কর্তোয়ার অসহায়ত্ব!
প্রথম ফ্রিকিকে বল ছিল কর্তোয়ার বাঁ দিকের পোস্টের বাইরে এক গজ, রাইস সেটিকে ঘুরিয়ে নিয়ে গেলেন ঠিক মাঝখানে—জালে ঢুকলো মাঝ বরাবর, অসম্ভব রকমের নিখুঁত এক গোল। দ্বিতীয় গোলটি করার পর রাইস লাফ দিয়ে উঠলেন বিজ্ঞাপন বোর্ডের ওপর, হাত দু’টো মেলে ধরলেন আকাশের দিকে—সেই মুহূর্তেই তিনি হয়ে উঠলেন দশ ফুট লম্বা এক কিংবদন্তি।
দ্বিতীয় 'মিসাইলে' রিয়াল-বধের পর রাইসের উদযাপন। ছবি: গেটি ইমেজেস
রিয়াল মাদ্রিদের জন্য এই ম্যাচ যেন এক দুঃস্বপ্ন। চ্যাম্পিয়নস লিগের ১৫ বারের চ্যাম্পিয়নরা এই টুর্নামেন্টে সব সময় নাটকীয় প্রত্যাবর্তনের জন্য বিখ্যাত। কিন্তু এবার যেন গল্পটা আলাদা।
বুকায়ো সাকা ও মার্টিন ওডেগার্ডরা ডানপ্রান্ত দিয়ে বারবার গেছেন আক্রমণে। আর্সেনালের তরুণ লেফট ব্যাক লুইস-স্কেলি ম্যাচজুড়ে ত্রাস হয়ে ছিলেন। ইনভার্টেড রান, শোল্ডার ড্রপ, নিচু পাস—সব মিলিয়ে রিয়ালের ডিফেন্সে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেন বারবার। এবং ঠিক এমনই এক আক্রমণ থেকে বল পেলেন মিকেল মেরিনো, ঠাণ্ডা মাথায় ওয়ানটাচে স্কোর করলেন ৩-০।
অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, এই ফেব্রুয়ারির আগে পর্যন্ত মেরিনো কখনো নাম্বার নাইন হিসেবেই খেলেননি। আর এখন সেই পজিশনে ছয়টি গোল করে ফেলেছেন। কাই হ্যাভার্জ ও গ্যাব্রিয়েল হেসুসের ইনজুরিতে ডিবক্সে আরো পরিণত এই স্পেনিয়ার্ড।
খেলার শেষদিকে এদুয়ার্দো কামাভিঙ্গা দ্বিতীয় হলুদ কার্ড দেখে লাল কার্ডে মাঠ ছাড়েন। সেই দৃশ্যেই যেন রিয়ালের পারফরম্যান্সের সার খুঁজে পাবেন দর্শকরা। গানারদের জন্য ২০০৯-১০ মৌসুমের পর সবচেয়ে বড় ইউরোপিয়ান রাত ছিল এই ম্যাচ। সেবার কোয়ার্টার ফাইনালে বার্সেলোনার মুখোমুখি হয়েছিল আর্সেনাল। তার পর এতগুলো বছর অপেক্ষা, ব্যর্থতা, হোঁচট—সব কিছুর জবাব দিল এই পারফরম্যান্স।
এমবাপ্পের শূন্য দৃষ্টি। ছবি: এপি
বুকায়ো সাকা ম্যাচের মঞ্চ প্রস্তুত করেন। তার মুভমেন্ট, আউটসাইড রান এবং ড্রিবল রিয়াল ডিফেন্সকে বারবার বিভ্রান্ত করেছে। তিনিই ফাউল আদায় করে এনে দেন সেই দুটি ফ্রি-কিক, যা থেকে গোল করেন রাইস।
থিবো কর্তোয়া বেশ কয়েকটি দারুণ সেভ করেন—সালিবার শট, মার্টিনেলির ফলোআপ, এবং মেরিনোর একাধিক প্রচেষ্টা ঠেকান তিনি। তবু বাঁচাতে পারেননি দলকে। তবে মান বাঁচিয়েছেন অবশ্যই। এমনকি বেলিংহ্যামকেও একবার গোললাইন ক্লিয়ার করতে দেখা গেছে। কিলিয়ান এমবাপ্পে এবং ভিনিসিয়ুস জুনিয়রের গতি কিছুটা হুমকি তৈরি করলেও ডেভিড রায়া দুর্দান্ত সেভ করে আর্সেনালকে প্রথমার্ধে বাঁচান।
ম্যাচের আগে আর্সেনাল সমর্থকদের গ্যালারিতে আনা তিফোতে লেখা ছিল—‘মেইক ইট হ্যাপেন’। আর দল যেন সত্যিই সেই ডাক শুনে জবাব দিয়েছে। চ্যাম্পিয়নস লিগের স্বপ্ন এখন আর শুধু স্বপ্ন নয়। এমিরেটসের আলোয় তা বাস্তবের মতোই উজ্জ্বল।