দেশভাগ ও পাকিস্তান আন্দোলনের ইতিহাসে আগ্রহীদের চৌধুরী রহমত আলীকে আলাদাভাবে পরিচয় করিয়ে দেয়ার প্রয়োজন হয় না। পাকিস্তানের অন্যতম রূপকার হিসেবে পরিচিত এ রাজনীতিবিদ ও স্কলারের রাজনৈতিক অবদান কম নয়। এ ক্ষুদ্র পরিসরে সে তালিকা নিষ্প্রয়োজন। পাকিস্তান তিনি আসলে শেষ পর্যন্ত চেয়েছেন কিনা কিংবা ত্রিশ ও চল্লিশের দশকের রাজনৈতিক বাস্তবতায় পরবর্তী সময়ে কোন ধরনের পাকিস্তান, কীভাবে চেয়েছিলেন তাও এখানে বলছি না। স্বাধীন পাকিস্তান নিয়ে তার অসন্তুষ্টি কিংবা তিনি কেন পাকিস্তানে থাকতে পারেননি সে প্রসঙ্গে আলোচনা থেকেও আপাতত বিরত থাকছি। আমি বরং তার লেখা ‘পাকিস্তান প্রস্তাবনা’ নামে খ্যাত গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক প্যাম্ফলেট ‘এখন না হলে কখনো নয়: আমরা কি টিকে থাকব, না চিরতরে ধ্বংস হয়ে যাব?’ প্রসঙ্গে কিছু কথা বলব। মূলত এ প্রস্তাবনার ভিত্তিতে রহমত আলীর মুসলিম জাতীয়তা ভাবনাসংক্রান্ত কিছু প্রসঙ্গ ও প্রশ্ন তোলার চেষ্টা করব।
রহমত আলীর ‘পাকিস্তান প্রস্তাবনা’ প্যাম্ফলেটের ভাষা যথার্থই বিপ্লবী ও ধারালো। বিদ্যমান রাজনৈতিক, সামাজিক ও ভাবনার কাঠামো ভেঙেচুরে, ভারতীয় মুসলিমদের নিজস্ব ভাবাদর্শ ও জীবনাচরণের ভিত্তিতে নিজেদের শাসন প্রতিষ্ঠার তীব্র ইচ্ছা ও প্রত্যয় প্রকাশিত হয়েছে এতে। আবেগ, শঙ্কা, প্রত্যয় ও দরদ মিশ্রিত এ প্রস্তাবনার প্রতিটি শব্দে যেন আগুন ফেটে পড়ে। যেন বৈষম্য, নিরাশা, নিষ্কর্মের অতল গহ্বর থেকে টেনে বের করে ইতিহাসের সামনে দাঁড় করিয়ে দিতে চান তার নিজের সম্প্রদায়ের মানুষদের। কিন্তু তখনকার কেমব্রিজের এ ছাত্রের কেন পাকিস্তান প্রতিষ্ঠায় এ দৃঢ় ও সাহসী অবস্থান? ১৯৩৩ সালে লেখা এ প্রস্তাবনা মোটেই আকস্মিক নয়। খেলাফত আন্দোলন ও বেঙ্গল প্যাক্টের অপ্রত্যাশিত পরিণতি, ১৯২৬-এর দাঙ্গা, নেহরু রিপোর্টসহ অন্যান্য রাজনৈতিক ও সামাজিক বাস্তবতায় যে ‘হিন্দু-মুসলিম সমস্যা’ তৈরি হয়েছিল, সে পাটাতনে দাঁড়িয়ে আল্লামা ইকবালের ১৯৩০ সালের পাকিস্তান প্রস্তাবের ধারাবাহিকতায় রহমত আলী নিজের প্রস্তাব রাখেন। কিন্তু ইকবাল ও রহমত আলী পাকিস্তান বলতে ভৌগোলিকভাবে উত্তর ভারতের পাঁচটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশের কথা ভাবলেও দুজনের প্রস্তাবনার পার্থক্যও ছিল। ইকবাল যেখানে এই পাঁচটি প্রদেশ (পাঞ্জাব, উত্তর পশ্চিম সীমান্তবর্তী প্রদেশের কিছু অংশ, কাশ্মীর, সিন্ধু ও বেলুচিস্তান) একসঙ্গে একটি ইউনিট হিসেবে সর্বভারতীয় ফেডারেশনের একটি হিসেবে কল্পনা করেছেন, রহমত আলী এ প্রদেশগুলোকে তাদের নিজস্ব একটা আলাদা ফেডারেশন করার প্রস্তাব উপস্থাপন করেন। বলা বাহুল্য এই দুই প্রস্তাবের কোনোটিতেই মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলা ছিল না।
রহমত আলীর ‘পাকিস্তান প্রস্তাবনা’-এর ভিত্তি কী? স্পষ্টত তার পাকিস্তান চিন্তার কেন্দ্রে আছে এক ধরনের মুসলিম জাতীয়তার ভাবনা। সেই মুসলিম জাতীয়তার স্বরূপ কী? রহমত আলীর মুসলিম জাতীয়তার ভাবনা মূলত কংগ্রেসের ‘ভারতীয়রা এক জাতি’ ভাবনার বিপরীতে তৈরি। তার মতে, ভারতে নানা জাতির বসবাস। এসব জাতির ভাষা, সংস্কৃতি, ইতিহাস, ধর্ম, নৃতাত্ত্বিক পরিচয়সহ যাপিত জীবনের নানা অভ্যাস ও অনুষঙ্গ আলাদা। অর্থাৎ তাদের জাতীয়তাও আলাদা। সে দৃষ্টিকোণ থেকে ভারতীয় মুসলমানদের ধর্ম, ইতিহাস, ঐতিহ্য ইত্যাদিও ভিন্ন। ফলে মুসলমানদের জাতীয়তাও আলাদা। ভারতীয় জাতীয়তাবাদের নামে এক খোপে মুসলিম জাতীয়তাকে আটকানো যাবে না। এতে আধিপত্যবাদী হিন্দু জাতীয়তাবাদের খপ্পরে পড়ে মুসলমানদের স্বকীয়তা হারিয়ে যেতে বাধ্য। এক জাতীয়তার খপ্পরে কীভাবে মুসলমানদের যাপিত জীবনের নানা অনুষঙ্গ বিলীন হয়ে যায় সে নজিরও হাজির করেন রহমত আলী। তিনি দাবি করেন এই এক জাতীয়তার ভাবনার কারণেই উর্দু মুসলমানদের অন্যতম ভাষা হলেও ভারতীয় জাতীয় ভাষার কাতারে স্থান পায়নি।
রহমত আলীর জাতীয়তার ভাবনায় একটি বিষয় স্পষ্ট। তিনি মুসলমানদের শুধু রাজনৈতিক কমিউনিটি হিসেবে দেখেননি। অর্থাৎ তার ভাবনা কংগ্রেসের হিন্দু জাতীয়তার রাজনৈতিক আধিপত্যের বিপরীতে মুসলিম জাতীয়তায় সীমাবদ্ধ থাকেনি। আরো স্পষ্ট করে বললে তিনি মুসলিম জাতীয়তাকে শুধু রাজনৈতিক সুযোগ-সুবিধা আদায় কিংবা রাজনৈতিক কমিউনিটি গড়ার অস্ত্র হিসেবে দেখেননি। বরং তার জাতীয়তার ভাবনা উঠে আসে মুসলমানদের প্রতিদিনকার জীবনযাপনের অনুষঙ্গ থেকে (the minutest details of our lives)। তার মতে মুসলমানদের প্রথা, খাবারের অভ্যাস, পোশাক ইত্যাদি নিত্য অনুষঙ্গ—যা মুসলমানদের জীবনের অপরিহার্য অংশ—অন্য সম্প্রদায় থেকে আলাদা। এ অনুষঙ্গ বাঁচিয়ে রাখতে, এই যাপিত জীবনের অনুষঙ্গ থেকেই রহমত আলীর মুসলিম জাতীয়তার জন্ম। তিনি শঙ্কা প্রকাশ করেন যে সর্বভারতীয় এক জাতীয়তার অংশে পরিণত হলে মুসলমানদের জীবনের অপরিহার্য উপাদান হুমকির মুখে পড়বে। আর এ উপাদানের ধ্বংস মানে মুসলিমদের টিকে থাকাই দুঃসাধ্য হয়ে পড়বে। অস্তিত্বের সংকটে পতিত হবে পুরো মুসলিম সম্প্রদায়।
রহমত আলী কি এক ধরনের প্যান-ইসলামিক মুসলিম জাতীয়তার কথা বলছেন? বিষয়টি পরিষ্কার নয়। তার কল্পিত পাকিস্তানে কিন্তু ভারতের সব মুসলমান নেই। এটি একেবারে উত্তর ভারতের একটি নির্দিষ্ট ভৌগোলিক সীমারেখায় কল্পিত। তিনি যে যাপিত জীবনের অনুষঙ্গের কথা বলছেন, এমনকি উর্দু ভাষার কথা বলছেন, তা একান্তই এই ভৌগোলিক সীমার মানুষের জীবনাচরণের সঙ্গে সম্পৃক্ত। আবার প্যাম্ফলেটের শেষের দিকে তিনি কিন্তু বিষয়টিকে প্যান-ইসলামিক ভাবনার দিকে নিয়ে যাচ্ছেন। তিনি দাবি করছেন ভারতে তার কল্পিত মুসলিম সম্প্রদায়ের পতন কিন্তু বিশ্বব্যাপী পুরো মুসলিম জনগোষ্ঠীরই পতন ডেকে আনবে। কিন্তু কেন? কীভাবে? জাতীয়তা যদি ‘নির্দিষ্ট ভূখণ্ডে কল্পিত জনগোষ্ঠীর’ সঙ্গে সম্পৃক্ত হয় তাহলে রহমত আলীর কল্পিত উত্তর ভারতের মুসলিম জনগোষ্ঠীর পতন কীভাবে বিশ্বব্যাপী প্রভাব রাখবে? শুধু তাই নয়, রহমত আলীর জাতীয়তার ভাবনা আরো নানা দিক থেকে অস্পষ্ট, অসংগত ও অসম্পূর্ণ। শুধু রহমত আলীর ভাবনা কেন, ত্রিশ ও চল্লিশের দশকে ভারতে মুসলিম জাতীয়তার ভাবনার কোনোটাই অস্পষ্টতা ও অসংগতি এড়াতে পারেনি। এ অসম্পূর্ণতা, অসংগতি ও অস্পষ্টতাকে আমরা কীভাবে পড়ব? শক্ত যৌক্তিক ও সংগতিপূর্ণ ভাবনার পাটাতনে তৈরি নয় বিধায় এই মুসলিম জাতীয়তার ভাবনাকে খারিজ করে দেব? আমাদের এ অঞ্চলের জাতীয়তাবাদের ইতিহাস আসলে এ খারিজেরই ইতিহাস। এই খারিজ তত্ত্বের বাইরে গিয়ে, অসম্পূর্ণ, অসংগতি ও অস্পষ্টতা ‘ দোষে দুষ্ট’ মুসলিম জাতীয়তার ভাবনার পুনঃপাঠ দরকার।
আজকের জাতীয়তাবাদের তত্ত্বের আলোকে বিচার করলে রহমত আলী ও তার সহকর্মীদের অসম্পূর্ণ, অসংগত ও অস্পষ্ট ভাবনা আমাদের কাছে দুর্বল ও সীমাবদ্ধ মনে হওয়া অস্বাভাবিক নয়। তত্ত্ব চাপিয়ে না দিয়ে এ ভাবনাগুলো পড়তে হবে ওই সময় ও ঘটনার প্রেক্ষাপটে। আমার মনে হয় বরং তাদের ভাবনার এ অস্পষ্টতাই এক ধরনের শক্তি। বলা যায় অস্পষ্টতাই চল্লিশের দশকের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে সহজে নানা মুসলিম জাতীয়তার ভাবনাকে এক জায়গায় দাঁড় করাতে পেরেছে। বাংলাসহ ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের মুসলিম জনগোষ্ঠী এ ভাবনাকে নিজেদের আঞ্চলিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে পুনর্নির্মাণ করতে পেরেছে। আরো শক্তিশালী করতে পেরেছে মুসলিম জাতীয়তার ভাবনাকে। সহজে নিয়ে যেতে পেরেছে কৃষক ও সাধারণ মুসলমানদের দরজায়। জনপ্রিয় করে তুলতে পেরেছে পাকিস্তান আন্দোলনকে। তাই তো দেখি বাংলায় চল্লিশের দশকের গোড়ায় লেখা মুজিবুর রহমান খানের ‘পাকিস্তান’, হবিবুল্লাহ বাহার চৌধুরীর ‘পাকিস্তান’, কিংবা আবু জাফর শামসুদ্দিনের ‘পলাশী থেকে পাকিস্তান’ গ্রন্থে রহমত আলী কিংবা ইকবালের জাতীয়তা ভাবনার প্রভাব থাকলেও বাংলার প্রেক্ষাপটে তা নতুন রূপ পেয়েছে। এবং বাংলার মুসলমান তা গ্রহণও করেছে।
মোঃ মিজানুর রহমান: পিএইচডি গবেষক,
ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, সান্তা ক্রুজ