উৎপাদন পর্যায়ে সিরামিক পণ্যকে সম্পূরক শুল্কমুক্ত রাখা প্রয়োজন

২০১২ সালে যাত্রা হয় আকিজ সিরামিকসের। টাইলস, স্যানিটারিওয়্যারের পর এখন টেবিলওয়্যারের মতো উচ্চমূল্য সংযোজিত পণ্য উৎপাদন শুরু করেছে প্রতিষ্ঠানটি। এ শিল্পের ভবিষ্যৎ বিকাশে আসন্ন বাজেটের প্রত্যাশা নিয়ে সম্প্রতি বণিক বার্তার সঙ্গে কথা বলেছেন আকিজ গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শেখ বশির উদ্দিন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন বদরুল আলম

২০১২ সালে যাত্রা হয় আকিজ সিরামিকসের। টাইলস, স্যানিটারিওয়্যারের পর এখন টেবিলওয়্যারের মতো উচ্চমূল্য সংযোজিত পণ্য উৎপাদন শুরু করেছে প্রতিষ্ঠানটি। শিল্পের ভবিষ্যৎ বিকাশে আসন্ন বাজেটের প্রত্যাশা নিয়ে সম্প্রতি বণিক বার্তার সঙ্গে কথা বলেছেন আকিজ গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শেখ বশির উদ্দিন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন বদরুল আলম

বাজেট থেকে সিরামিক উৎপাদন শিল্পের প্রধান প্রত্যাশা কী?

শিল্প খুব দ্রুতহারে বড় হচ্ছে। গত এক দশকে বৃদ্ধির হার অনেক বেশি। সামগ্রিকভাবে সিরামিক শিল্পের প্রবৃদ্ধির হার ১৫ শতাংশেরও বেশি, যা খুবই আশাব্যঞ্জক। এখন প্রত্যন্ত অঞ্চলেও সিরামিক শিল্পের কারখানা গড়ে উঠছে। স্বাভাবিকভাবে এমনটা হওয়ার কথা না। এসব কারখানাগুলো যে খুব ছোট আকারে হচ্ছে, তেমনটা নয়। কারণ খুব ছোট সক্ষমতার সিরামিক কারখানা করতে গেলে এখন আর ব্যবসার সম্ভাব্যতা থাকে না। ফলে প্রত্যন্ত অঞ্চলেও মোটামুটি বড় ধরনের শিল্পই হচ্ছে। অবস্থায় সিরামিক খাতের ওপর আরোপিত ডিউটি হার কমানো প্রয়োজন। সিরামিক শিল্পের পণ্যে উৎপাদন পর্যায়ে সম্পূরক শুল্ক আরোপ আছে। আমার অনুরোধ থাকবে সিরামিক শিল্পকে উৎপাদন পর্যায়ে সম্পূরক শিল্পের আওতামুক্ত রাখার। সম্পূরক শুল্ক যেটা উৎপাদন পর্যায়ে আরোপ আছে, সেটা প্রত্যাহার না হলে ফাঁকির প্রবণতা বেড়ে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে। হার যত বাড়বে, ফাঁকির প্রবণতাও তত বেশি উৎসাহ পাবে।

স্যানিটারিওয়্যার টাইলসকে বিলাস পণ্য হিসেবে বিবেচনা না করে হাইজিন পণ্য হিসেবে বিবেচনা করা উচিত। যদিও বিলাস টাইলসও আছে। যেগুলোর ব্যবহারও আছে। গোটা শিল্পে বিলাসী পণ্য হতে পারে ১০-১৫ শতাংশ। বাকি ৮০-৮৫ শতাংশই হাইজিন পণ্য। পণ্যকে সম্পূরক শুল্ক থেকে বাদ দিলে হাইজিন পরিস্থিতি উন্নত হবে। আর সিরামিক পণ্য উৎপাদনকারীদের মধ্যে প্রতিযোগিতার লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি হবে। যে প্রতিষ্ঠানগুলো শুল্ক কর দেয় আর যারা দেয় না, এদের মধ্যে খুবই অসম প্রতিযোগিতা হচ্ছে। ফলে পুরনো প্রতিষ্ঠিত কোম্পানিগুলো ক্ষতির শিকার হচ্ছে।

আমদানিনির্ভর স্থানীয় পর্যায়ে উৎপাদনসিরামিক খাতে দুই ধরনের বিনিয়োগের প্রভাব সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কী?

দেশের টাইলসের বাজারের চাহিদায় আমদানিনির্ভরতা ১০ শতাংশও কিনা তা নিয়ে সন্দেহ। বাকি ৯০ শতাংশই স্থানীয় পর্যায়ে উৎপাদন হচ্ছে। আমদানির সঙ্গে স্থানীয় উৎপাদনের প্রতিযোগিতা সবসময়ই থাকবে। আমার কাছে মনে হয় এর দরকারও আছে। কারণ স্থানীয় শিল্প আমদানি করা পণ্য দেখে শিখতে পারে। এতে পণ্য বৈচিত্র্যময় করার কিছু জ্ঞান আসে। উন্নতমানের হাইভ্যালু উৎপাদনের রেফারেন্স হিসেবে কাজ করে। আমদানিকারকরা একটা বাজার সৃষ্টি করলে স্থানীয় উৎপাদকরা সেটা ধরার চেষ্টা করতে পারেন। ফলে এখনই আমদানি বন্ধ করে দেয়া প্রয়োজন, এমনটা আমি মনে করি না। যদিও আমি এটাও মনে করি, মুহূর্তে যে বাণিজ্য ঘাটতি ঘটছে, সেই প্রেক্ষাপটে দেশে যেসব পণ্য উৎপাদন স্বয়ংসম্পূর্ণতা আছে রফতানি হয়, ধরনের পণ্য আমদানির বিপরীতে বিদেশী মুদ্রা সাশ্রয়ের জন্য সাময়িকভাবে আপৎকালীন বাদ দেয়া যেতে পারে। তবে দীর্ঘমেয়াদে ধরনের কিছুর পক্ষপাতী আমি না।

সিরামিক শিল্পে বিনিয়োগ পরিস্থিতি নিয়ে আপনার মূল্যায়ন জানতে চাই।

সিরামিক টেবিলওয়্যারে খুব একটা কেউ আসছে না। আমি বলব টাইলসের চেয়ে টেবিলওয়্যারে সম্ভাবনাটা বেশি। কারণ টেবিলওয়্যারের ব্যবসাটা অনেক বেশি টেকনিক্যাল, চ্যালেঞ্জিং। এখন কোন ব্যবসায়টা বেশি জটিল সেটা যদি বলি, তাহলে বলব টেবিলওয়্যারটা অনেক বেশি জটিল। দ্বিতীয় স্যানিটারিওয়্যার। তারপর টাইলস। আমরা তিনটিরই ব্যবসা করি। বাজারে মুহূর্তে টাইলস ব্যবসায় প্রচুর বিনিয়োগ আসছে। অনেক করপোরেট হাউজ আসছে। গ্রামে গেলেও দেখা যাচ্ছে টাইলসের অনেক চাহিদা তৈরি হচ্ছে। কিন্তু সেসব টাইলস খুব কম মূল্যমানের পণ্য। যতগুলো কোম্পানি নতুন করে আসছে, উনারা কম মূল্যমানের পণ্য দিয়ে শুরু করছেন। কম মূল্যমানের পণ্যে অনেক বেশি প্রতিযোগিতা চলে এলে, যারা দক্ষতার সঙ্গে পরিচালনা করতে পারেন, তারাই টিকে থাকতে পারবেন। সিমেন্ট ইন্ডাস্ট্রিতেও একসময় অনেক বিনিয়োগ হয়েছে। অনেকেই ঝরে পড়েছেন। কিন্তু সিমেন্ট নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য, এখানে ভলিউম গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু সিরামিকস নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য নয়। এখানে অনেক বড় বিনিয়োগ নিয়ে চলে এলে হবে না। সিমেন্ট হলে ব্যাগে ১০ টাকা দাম কমিয়ে দিয়ে দ্রুত বাজার ধরে ফেলা যায়। কিন্তু সিরামিকসের ক্ষেত্রে আস্থা, বিশ্বাস বিষয়গুলো সংশ্লিষ্ট। সিমেন্টের ক্ষেত্রে মজবুত কাঠামো বড় বিষয়। সিরামিকসেও দৃঢ়তা জরুরি। ফ্লোরে লাগানো হচ্ছে, এটা যেন ভেঙে না যায়, ফেটে না যায়। কিন্তু এখানে নান্দনিকতারও একটা বিষয় আছে। তাই নান্দনিকতার কারণে ব্যবসার প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে জটিলতা অনেক বেড়ে যায়। যারাই নতুন আসছেন, দুটো জিনিসকে বিবেচনায় নিয়ে যদি ব্যবসায়িক পরিকল্পনা করেন, তাহলে তাদের সফল হওয়ার সুযোগ রয়েছে। কিন্তু কম দামি পণ্যের বাজার এখন আর লাভজনক নয়। কারণ অনেক বেশি খেলোয়াড় সেখানে। কম মাঝারি দুই ধরনের দামের পণ্যের ক্ষেত্রেই এখন লাভজনক হওয়া জটিল। আমরা এগুলোকে ক্যারিয়ার পণ্য বলি। অনেকেই ক্যারিয়ার পণ্যে ব্যবসায়িক অবস্থান চিন্তা করছেন। আমার পরামর্শ হচ্ছে, সিরামিকের পণ্য ১৫ বছরে দাম বাড়েনি, তবে খরচ অনেক বেড়েছে। তাই আমি লো-এন্ড মার্কেট সম্পর্কে সচেতনতার কথাই বলব।

আমাদের সিরামিক ইন্ডাস্ট্রি কতটা স্বয়ংসম্পূর্ণ?

সিরামিক পণ্য বিশেষ করে পোরসিলিনের তৈজসপত্র, টেবিলওয়্যার উৎপাদনের জন্য যে ধরনের কাঁচামাল লাগে, আর পোরসিলিনের টাইলসের ক্ষেত্রে কাঁচামালের নাম একই। তফাতটা পিওরিটি বা বিশুদ্ধতা। বিশুদ্ধতার মাত্রাটা অনেক বেশি উন্নত। কাঁচামালগুলো তো খনিজ। আমাদের দেশে ধরনের খনিজ কিন্তু আছে খুবই সামান্য। কিন্তু বিভিন্ন পরিবেশগত দিক বিবেচনায় সরকারের পক্ষ থেকে এগুলো উত্তোলনে বিধিনিষেধ রয়েছে। ফলে আমাদের আমদানির ওপর নির্ভর করতে হয়। ইংল্যান্ড বা জার্মানিতে বা অধিকতরভাবে স্পেন পরিশোধনের কাজগুলো করে। তুরস্কও করে। আমরাও মৌলিক কাঁচামাল পরিশোধনের ওপর বিনিয়োগ করতে চাচ্ছি।

বর্তমানে যুদ্ধের প্রভাবে কাঁচামাল আমদানিতে কোনো সমস্যা মোকাবেলা করতে হচ্ছে কি?

কভিডকালীন সারা দুনিয়ায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো ভালো পরিমাণে প্রণোদনা দিয়েছে, যা বেশির ভাগ মানুষ ভোগ ব্যয়ে রূপান্তর করেছে। বিশেষ করে উন্নত বিশ্বে। ফলে বৈশ্বিকভাবে কৃত্রিম চাহিদা তৈরি হয়েছে। কিন্তু বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটেই এখন বিনিয়োগ ব্যয়টা অনেক বেড়েছে। সাপ্লাই চেইনে যতটুকু না ঘাটতি ঘটেছে, তার চেয়ে বেশি ঘটেছে জাহাজ ভাড়ায়। বড় প্রতিবন্ধকতা হলো ডলারের দাম অসম্ভব বেড়ে গিয়েছে। কাঁচামাল সরবরাহ পর্যায়ে খুব একটা সমস্যা আছে তা না। তবে মূল্যস্ফীতি ঘটেছে মারাত্মকভাবে। আবার জাহাজ ভাড়াও বেড়েছে মারাত্মকভাবে।

আরও