ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বনাম মেধা-নেতৃত্ব

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বয়স একশ বছর হলো। এই দীর্ঘ পথযাত্রায় একটা কালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হিরন্ময় সময় গেছে, যখন মেধা ও মননে প্রতিষ্ঠানটির সুখ্যাতি চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছিল। স্বীকৃত হয়েছিল এ বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধা-নেতৃত্ব। তারপর একটা সময় গেছে যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধা-নেতৃত্ব প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। শতবর্ষের শেষে আজ প্রশ্ন উঠেছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কি বর্তমান সময়ে মেধা-নেতৃত্ব দিতে পারছে?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বয়স একশ বছর হলো। এই দীর্ঘ পথযাত্রায় একটা কালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হিরন্ময় সময় গেছে, যখন মেধা মননে প্রতিষ্ঠানটির সুখ্যাতি চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছিল। স্বীকৃত হয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধা-নেতৃত্ব। তারপর একটা সময় গেছে যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধা-নেতৃত্ব প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। শতবর্ষের শেষে আজ প্রশ্ন উঠেছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কি বর্তমান সময়ে মেধা-নেতৃত্ব দিতে পারছে?

প্রশ্নের জবাব দেয়ার জন্য আমি চারটি প্রশ্নের অবতারণা করছি। প্রথমত, মেধা-নেতৃত্ব বলতে কী বোঝায়? দ্বিতীয়ত, অতীতে কি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মেধা-নেতৃত্ব দিতে পেরেছে? তৃতীয়ত, বর্তমানে কি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মেধা-নেতৃত্ব দিতে পারছে এবং যদি না পেরে থাকে, তাহলে তার অন্তরায়গুলো কী কী? এবং চতুর্থত, যদি মেধা-নেতৃত্ব দিতে হয়, তাহলে আর কী কী করা প্রয়োজন? কতগুলো উপসংহারমূলক বক্তব্যের মাধ্যমে আমি আমার বক্তব্য শেষ করব। 

আমরা যখন মেধা-নেতৃত্বের কথা বলি, তখন শুধু শিক্ষাগত উত্কর্ষ বা বিদ্যার্জনের কথা বলি না, মেধা-নেতৃত্বের কথা বলতে আমরা মনন, চিন্ত-চেতনা বুদ্ধিবৃত্তিকে একটি উচ্চতম পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার কথা বলি। সুতরাং সেই প্রেক্ষিত থেকে মেধা-নেতৃত্বের পাঁচটি মাত্রিকতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

প্রথমত, মেধা-নেতৃত্ব দিতে হলে একটা বিশ্ববীক্ষণ একটি বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গি থাকতে হবে। একটি প্রতিষ্ঠান যদি চিন্তা-চেতনার ক্ষেত্রে, মননের ক্ষেত্রে কূপমণ্ডূক হয়, তাহলে তার পক্ষে মেধা-নেতৃত্ব দেয়া সম্ভব নয়।

দ্বিতীয়ত, মেধা-নেতৃত্ব দিতে হলে মন চিন্তার ক্ষেত্রে বুদ্ধিবৃত্তির চর্চা থাকতে হবে এবং সত্যিকার অর্থে মেধা-নেতৃত্বদানকারী একটি প্রতিষ্ঠানকে মুক্তবুদ্ধি মুক্তচিন্তার আধার হতে হবে।

তৃতীয়ত, মেধা-নেতৃত্ব দিতে হলে মেধা-নেতার প্রয়োজন হবে। সেই মেধা-নেতার একদল হবে শিক্ষার্থীরা এবং অন্যদল হবেন শিক্ষক গবেষকরা। মেধা-নেতৃত্ব দেয়ার জন্য শিক্ষক গবেষককে যেমন উচ্চমানের হতে হবে, তেমনি শিক্ষার্থীদের শাণিত হতে হবে সর্ব অর্থেই।

চতুর্থত, মেধা-নেতৃত্ব দিতে গেলে পুঁথিগত বিদ্যা কিংবা শ্রেণীকক্ষের জ্ঞানই যথেষ্ট নয়, শ্রেণীকক্ষের বাইরে বৃহত্তর পরিমণ্ডলে শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতির জগতে যে জ্ঞান রয়েছে, তা আমাদের জানতে হবে।

পঞ্চমত, মেধা-নেতৃত্ব মানে শুধু তাত্ত্বিক জ্ঞানার্জন নয়, শুধু নেয়া নয়, মেধা-নেতৃত্ব মানে দেয়াওদেশ জাতির জীবনের বহু ক্ষেত্রে অবদান রাখতে হবে।

পাঁচ নির্ণায়কের পরিপ্রেক্ষিতে যদি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে আমরা তাকাই, তবে আমরা নিশ্চিতভাবে বলতে পারি যে অতীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মেধা-নেতৃত্ব দিতে পেরেছে। ১৯২১ সালে যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয় অঞ্চলের উচ্চশিক্ষার জন্যে, তখন কিন্তু এর গঠন কাঠামো অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ধাঁচে আদলে করা হয়েছিল। সুতরাং বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্মলগ্নেই একটি বৈশ্বিক প্রেক্ষিত বীক্ষণ নিয়েই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পথচলা শুরু।

বিশ্ববীক্ষণের ক্ষেত্রে দেখেছি যে জন্মের শুরুতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যোগসূত্র স্থাপন করেছে, বিশ্বের নানান মনীষী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছেনরবীন্দ্রনাথ এসেছিলেন, ওস্তাদ বড়ে গোলাম আলী এসেছিলেন। সম্মাননা তালিকার দিকে যদি তাকাই তবে একদিকে যেমন নোবেল বিজয়ী পদার্থবিদ সতীশ চন্দ্র রমনকে সম্মাননা দেয়া হয়েছে, তেমনি তা দেয়া হয়েছে মিসরের পূর্বতন রাষ্ট্রপ্রধান প্রয়াত জামাল আবদুল নাসেরকে। সুতরাং বিশ্বের জ্ঞান, মনন, চিন্তা-চেতনার সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংযুক্তিএটা অনেক আগেই হয়েছিল এবং অতীতে আমরা এটা বারবার দেখেছি।

দ্বিতীয়ত, মুক্তবুদ্ধি বা মুক্তচিন্তার কথা যদি বলি, তাহলে তিরিশের দশকে জনাব আবদুল ওদুদ, অধ্যাপক কাজী মোতাহার হোসেনের নেতৃত্বে ঢাকায় বুদ্ধির মুক্তির যে আন্দোলন শুরু হয়েছিল, তার আধার কিন্তু ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। বুদ্ধির মুক্তির সে সংগ্রাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বারবার করেছে একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে সামরিক শাসনের সময়ে। তার জন্যে হেনস্তা করা হয়েছে ছাত্র-শিক্ষকদের, আঘাত এসেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে, নিপীড়িত হতে হয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটিকে, কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাতে পিছপা হয়নি।

মেধা-নেতার কথা যদি বলি, তবে তালিকা করার প্রয়োজন নেই, কারণ সে তালিকা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হবে। প্রথম থেকেই বিশ্বের নানা জ্ঞাণী-গুণীজন, বিদগ্ধ মানুষরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন, গবেষণা করেছেন। বোস-আইনস্টাইন তত্ত্বের গবেষণা অধ্যাপক সত্যেন্দ্রনাথ বসু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার সময়ই করেছেন। সুতরাং বিশ্বমানের একটি গবেষণায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় একটি ভূমিকা রেখেছে। দশকে দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মেধাসম্পন্ন শাণিত বুদ্ধির শিক্ষার্থী তৈরি করেছে, যাঁরা বিশ্বের নানা জায়গায় ছড়িয়ে গিয়ে বৈশ্বিক চিন্তা-চেতনা, মনন অগ্রগতিতে অনন্য অবদান রেখেছেন। অতএব মেধা-নেতার ক্ষেত্রেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পিছিয়ে ছিল না।

পুঁথিগত শিক্ষার বাইরে যদি বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে চিন্তা করি, তাহলে বাংলাদেশের শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতির ক্ষেত্রে, অর্থাৎ যা কিছু আমাদের সুকুমার বৃত্তিগুলোকে বিকশিত করে, সেই সব ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অগ্রগণ্য ভূমিকা রেখেছে। বিশ্ববিদ্যালয় সাহিত্যিক সৃষ্টি করেছে, শিল্পকলায় নতুন নতুন ধারার জন্ম দিয়েছে, দর্শনের ক্ষেত্রে নতুন চিন্তা-চেতনার জন্ম দিয়েছে।

শুরুতেই উল্লেখ করেছিলাম যে মেধাসম্পন্ন প্রতিষ্ঠান হলে পরেই মেধা-নেতৃত্ব দেয়া যায় না, মেধা-নেতৃত্বের আরেকটি দিক হচ্ছে জাতি সমাজকে কিছু ফিরিয়ে দেয়া। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আমাদের দেশের সব রকমের সামাজিক আন্দোলনে, সর্বপ্রকারের মুক্তিবুদ্ধির আন্দোলনে এবং শেষ পর্যন্ত আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে একটি রক্তক্ষরা ভূমিকা রেখেছে। আমার জ্ঞান সীমিত, কিন্তু বিশ্বের অন্য কোনো বিশ্ববিদ্যালয় একটি দেশের আন্দোলনে, সংগ্রামে স্বাধীনতার লড়াইয়ে এত দীর্ঘ সময় ধরে এমন একটি অবিস্মরণীয় ভূমিকা রেখেছে বলে আমার জানা নেই।

ভাষা আন্দোলনে, ষাটের ছাত্র গণ-আন্দোলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা বাঙালি জাতি ভোলেনি। এবং তা মনে রেখেছে পাকিস্তানি শাসকরা। তাই ২৫ মার্চ তারা যখন আক্রমণ চালিয়েছে, তার অন্যতম লক্ষ্য ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, শিক্ষার্থী কর্মচারীরা যুদ্ধ করেছেন এবং শহীদ হয়েছেন। বিজয় যখন আমাদের দোরগোড়ায়, তখন পাকিস্তানি শাসকরা তুলে নিয়ে গেছে আমাদের মেধার আকর মনীষীতুল্য বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের এবং তাঁদের হত্যা করেছে নির্মমভাবে। কারণ তারা জানত যে মেধা মননের মূল কেন্দ্র হচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং তাকে যদি ধ্বংস করে দেয়া যায়, তাহলে বাঙালি জাতির মেধা মননের মেরুদণ্ড ভেঙে দেয়া যাবে। 

সুতরাং আমরা এখানে যদি উপসংহার টানি, তাহলে পূর্ববর্তী আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলতে পারব যে অতীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশে মেধা-নেতৃত্ব দিতে পেরেছে।

এবার প্রবন্ধের গোড়ায় উত্থাপিত তৃতীয় প্রশ্নটিতে যাওয়া যেতে পারেঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কি বর্তমানে মেধা-নেতৃত্ব দিতে পারছে? সম্পর্কে দীর্ঘ আলোচনার প্রয়োজন নেই, বিরাট মূল্যায়নেরও দরকার নেই। কিন্তু আমি যদি সাধারণ একজন মানুষ হই, তাহলে বলতে পারব, কথা এখন সবাই বলছেন এবং এটা আমাদের সমাজে বহুল প্রচলিত যে মেধার যে জায়গাটিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অতীতে নেতৃত্ব দিয়েছে, তার অবক্ষয় হয়েছে, সেটি ম্লান হয়েছে। কতখানি সেটা ম্লান হয়েছে, কতটুকু অবক্ষয় ঘটেছে সেখানে, তা পরীক্ষা করার প্রয়োজন নেই। কিন্তু অবক্ষয় যে সেখানে ঘটেছে এবং ম্লানিমা যে সেখানে গেড়ে বসেছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

এই যে মেধা-নেতৃত্বের ক্ষেত্রে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পিছিয়ে গেল, তার দুটো দিক আছে। একটি হচ্ছে যে বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে কতগুলো সার্বজনীন সামগ্রিক সমস্যা আছে, যা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করছে। আর অন্যটি হচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব কিছু সমস্যা আছে, যার কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মেধা-নেতৃত্ব দেয়ার জায়গায় পিছিয়ে গেছে। 

সামগ্রিক সমস্যাগুলোর দিকে যদি তাকাই, তাহলে পাঁচটি সমস্যা আমরা চিহ্নিত করতে পারি। এক, আমার কাছে সব সময় মনে হয়েছে যে বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষার মূল লক্ষ্য যে কী, সেটা বোধ হয় খুব সংহত পরিষ্কারভাবে আমরা এখনো সংজ্ঞায়িত করতে পারিনি। উচ্চশিক্ষা নিতে যিনি আসেন, তার কাছে হয়তো একটি সনদ প্রাপ্তিই মূল কথা। একটি সনদ পেলেই তিনি একটি ভালো চাকরি পাবেনএমনটাই তার হয়তো ধারণা। উচ্চশিক্ষা যাঁরা দিচ্ছেন, তাঁরাও হয়তো ভাবেন যে সনদ প্রদান করতে পারলেই তাঁদের দাযিত্ব শেষ। সেই সঙ্গে বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষা কি অধিকার, নাকি এটা একটা সুযোগ, সে প্রশ্নেও একটা ধোঁয়াটে ভাব আছে। সুতরাং বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষার আসল উদ্দেশ্য কী, সে ক্ষেত্রে একটি দিকনির্দেশনা অনুপস্থিত।

দুই. রাষ্ট্রের দিক থেকেও উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে কোনো পরিষ্কার দিক-দর্শন নেই। এই যে রাষ্ট্র উচ্চশিক্ষায় বিনিয়োগ করছে, কেন সে সেটা করছে, কী তার প্রত্যাশা, কী সে চায় উচ্চশিক্ষা খাত থেকে, উচ্চশিক্ষা রাষ্ট্রকে কী দিতে পারে, তার খুব স্বচ্ছ সংহত কোনো ব্যাখ্যা নেই। বাংলাদেশে জাতীয় একটি ব্যাখ্যার অনুপস্থিতিতে উচ্চশিক্ষা খাতে সমস্যার সৃষ্টি হয়।

তিন. উচ্চশিক্ষার পরিবেশের ক্ষেত্রে একটি সমস্যা আছে। ব্যাপারে আমি শুধু শ্রেণীকক্ষের ভেতরের পরিবেশের কথা বলছি না, আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের সামগ্রিক ভৌত অবকাঠামোর কথা বলছি না। একটি পঞ্চতল ইমারতে শিশু শিক্ষাসদন বসতে পারে, কিন্তু সেখানে একটি বিশ্ববিদ্যালয় চলতে পারে না। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য এমন একটি ভৌত অবকাঠামোর পরিবেশ থাকতে হবে, যেখানে শ্রেণীবহির্ভূত যেসব কার্যক্রম আছে, তা চালানোর যেন সুযোগ থাকে।

চার. উচ্চশিক্ষার একটি বাণিজ্যিকীকরণ হয়েছে। আমি শুধু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বিভাজনের কথা বলছি না। আমি মনে করি, উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে দেয়া-নেয়া, দাতা-গ্রহীতা বড় হওয়ার কারণে উচ্চশিক্ষা একটি বাণিজ্যিক সামগ্রীতে পরিণত হয়েছে।

পাঁচ. উপরোক্ত বাণিজ্যিকীকরণের ফলে সময়, সনদ এগুলোই বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষায় মুখ্য হয়ে উঠেছে এবং জ্ঞানার্জন, কী শিখছি, তা গৌণ হয়ে গেছে।

বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষার সামগ্রিক চালচিত্রের পরিপ্রেক্ষিতে আমরা যদি শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক অন্তরায়গুলোর দিকে তাকাই, তাহলে আবারো পাঁচটি বিষয়ের দিকে আমি সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই।

প্রথমত, ১৯৭৩ সালে যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ গৃহীত হয়, তখন তার একটি প্রেক্ষিত ছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠিত হলে দেশের উচ্চশিক্ষার শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ হিসেবে এটি একটি স্বাধীনতা ভোগ করবে, স্বাধীনভাবে এর কার্যকলাপ চালাতে পারবে, এটি একটি মুক্তবুদ্ধি, মুক্তচিন্তার ক্ষেত্রভূমি হবে, এমন একটি ভাবনা থেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশের প্রতিষ্ঠা। কিন্তু অনেকেই এখন মনে করছেন যে বর্তমান সময়ে ১৯৭৩ সালের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ অনেকাংশেই তার কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলেছে এবং বলা হচ্ছে যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব বহু সমস্যার সূত্র ওই অধ্যাদেশের মধ্যেই নিহিত। 

কথা ঠিক কিংবা বেঠিক, সে প্রশ্নে আমি যাচ্ছি না, কিন্তু অধ্যাদেশ বিষয়ে প্রশ্ন যখন উঠেছে এবং বিষয়টি যখন প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে, তখন তা খতিয়ে দেখতে হবে। 

দ্বিতীয়ত, এটা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই এবং আমরা যদি আমাদের কাছে সৎ থাকি, তাহলে আমাদের মানতেই হবে যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ধরনের রাজনৈতিকীকরণ অনুপ্রবেশ করেছে। সে রাজনৈতিকীকরণের একটি দিক হচ্ছে ছাত্ররাজনীতি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররাজনীতি সব সময় ছিল এবং সবসময়ই থাকবে। এবং সেখানে ছাত্ররাজনীতি ছিল বলেই দেশ জাতি বহু কিছু লাভ করেছে। কিন্তু ছাত্ররাজনীতি আর ছাত্রদের নিয়ে রাজনীতি এক জিনিস নয়।

কিন্তু আজকে বহু ক্ষেত্রে ছাত্রদের নিয়ে রাজনীতি করা হচ্ছে এবং বৃহত্তর রাজনৈতিক দলগুলোর রাজনীতির সঙ্গে ছাত্ররাজনীতিকে একাত্ম করে ছাত্র রাজনৈতিক সংগঠনগুলোকে বৃহত্তর রাজনৈতিক দলগুলোর অঙ্গপ্রতিষ্ঠানে পরিণত করা হয়েছে। সুতরাং স্বাভাবিকভাবেই দেশের বৃহত্তর রাজনীতির নানান টানাপড়েন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে পড়ছে। এটা গেল একটা দিক।

আরেকটা দিক হচ্ছে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র প্রাক্তন শিক্ষক। সেই দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই বলছি যে শিক্ষকদের মধ্যে রাজনীতি বিস্তার লাভ করার কারণে রাজনীতি নিয়ে শিক্ষকরা ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ায় যে মেধাভিত্তিক নেতৃত্ব দেয়ার কথা বলা হচ্ছে, সেটা আর দেয়া যাচ্ছে না। এটা আমাদের স্বীকার করতেই হবে। 

তৃতীয়ত, মেধাভিত্তিক শিক্ষক নিয়োগ মধ্যমমানের শিক্ষক নিয়োগ ব্যাপারটির রাজনৈতিকীকরণে মেধাভিত্তিক শিক্ষক নিয়োগ যে বিঘ্নিত হচ্ছে, তা একদিকে যেমন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা বলছেন, তেমনি বাইরের মানুষজনও বলছেন। সুতরাং এই রাজনৈতিকীকরণের একটি দিক হচ্ছে যে শিক্ষক নিয়োগ পদোন্নতির ব্যাপারে আমরা মধ্যমমানের শিক্ষককে অগ্রাধিকার দিচ্ছি, মেধামানের শিক্ষককে নয়। সত্যি কি মিথ্যা, সেটা আমাদের দেখতে হবে। 

চতুর্থত, মেধা তৈরির যে কথা বলা হচ্ছে, সেখানে মনে রাখা দরকার যে মেধা এমনি এমনি তৈরি হয় না। মেধা তৈরির জন্য একটি পরিবেশের প্রয়োজন হয়, একটি অঙ্গীকারের দরকার হয়, এজন্য সম্পদেরও প্রয়োজন হয়। সে ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের কি অঙ্গীকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে, রাষ্ট্র কীভাবে দেখতে চায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে, সেগুলো গুরুত্বপূর্ণ। পাকিস্তানের প্রশাসকরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে শত্রু হিসেবে দেখেছিল এবং সেভাবেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে ব্যবহার করেছে। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশে রাষ্ট্রযন্ত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে কী চায়, প্রত্যাশা কি তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে, তা ভেবে দেখতে হবে। 

পঞ্চমত, আবারো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ভূতপূর্ব ছাত্র শিক্ষক হিসেবে বলছি, আমি মনে করি যে সাম্প্রতিক সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শিক্ষকের সম্পর্কের মধ্যে একটি যান্ত্রিকতা ঢুকে গেছে। বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গনে ছাত্র-শিক্ষকের সম্পর্ক শুধু শ্রেণীকক্ষের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। ষাটের দশকে, সত্তরের দশকে যাঁরা আমার মতো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন, তাঁরা বলতে পারবেন যে শ্রেণীকক্ষের বাইরে, জ্ঞানার্জন ছাড়িয়ে আমাদের সঙ্গে আমাদের শিক্ষকদের যে সম্পর্ক ছিল, তা আমাদের ঋদ্ধ করেছে। সত্য আমরা যেন ভুলে না যাই।

আজকের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের যান্ত্রিকতার পরিপ্রেক্ষিতে কোনো রকম কার্যকারণ সম্পর্ক চিহ্নিত না করেই প্রশ্ন তুলছি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা কেন বেড়ে গেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার ছয় বছরের ছাত্রজীবনে একটি মাত্র ছাত্র-আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছিল। আজ শোনা যাচ্ছে যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের মধ্যে এক ধরনের বিষণ্নতা, এক জাতীয় নৈরাশ্য বিরাজ করছে। কিন্তু কেন? জিনিস দেখা দরকার।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে যে এই যে নানান সমস্যার কথা আমি বললাম, এগুলো থেকে উত্তরণের জন্য কী কী করা যেতে পারে। আমি পাঁচটি বিষয়ের কথা বলছি। সবগুলো বিষয় যে বলা হচ্ছে, তা নয়, কিন্তু আমার কাছে পাঁচ বিষয় গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়েছে।

এক. আমার মনে হয় যে ১৯৭৩ সালের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশটি আমরা নতুন করে ভেবে দেখতে পারি। এর অনেক সুফল আমরা ভোগ করেছি, কিন্তু কোনো কোনো ক্ষেত্রে এর কুফলও হয়তো আছে। সুতরাং পুরো বিষয়টির পুনর্মূল্যায়ন হওয়া দরকার। 

দুই. রাজনৈতিকীকরণের বলয় থেকে বেরিয়ে এসে মেধাভিত্তিক একটি কাঠামো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গড়ে তুলতে হবে। এবং মেধার ভিত্তিতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা করতে হবে। সেটা যেমন শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে করতে হবে, তেমনি শিক্ষকদের ক্ষেত্রেও করতে হবে। 

তিন. ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য একদিকে যেমন সম্পদ লভ্য করে দিতে হবে, তেমনি যথাযথ পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। আমি যখন পরিবেশের কথা বলছি, তখন প্রশ্ন তুলছি যে কেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্র দিনের পর দিন একটি ছাত্রাবাসের বারান্দায় থেকে অতি শীতের কারণে মৃত্যুবরণ করবে? প্রশ্ন আমাদের ভেবে দেখা দরকার। কেন রকম একটি অবস্থার সৃষ্টি হলো? সে কি পরিবেশের একটি অনাসৃষ্টি? এটি কি সম্পদের অপ্রতুলতার কারণে হলো? এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করতে হবে।

চার. ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু প্রাক্তন ছাত্র আজ পৃথিবীর নানান জায়গায় সুপ্রতিষ্ঠিত হয়ে ছড়িয়ে আছেন। বিশ্বের যেকোনো বিশ্ববিদ্যালয়ই তাদের পুরনো বা ভূতপূর্ব ছাত্রদের সঙ্গে একটি সংযোগ রক্ষা করতে চায় এবং তা শুধু একটি সমিতির মাধ্যমে নয়। আমার মনে হয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যাঁরা প্রাক্তন ছাত্র, তাঁরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান সমস্যাগুলো উত্তরণে এবং বিশ্ববিদ্যালয়কে ভবিষ্যতের পথে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে একটি বিরাট ভূমিকা পালন করতে পারেন এবং আমার মনে হয় যে সেই যোগাযোগটা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন।

আমি শেষ যে কথাটি বলে শেষ করতে চাই তা হচ্ছে বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০০ বছর হলো, বাংলাদেশের ৫০ বছর হলো। ১৯২১ সাল আর ২০২১ সাল এক নয়, ১৯৭১ সাল এবং ২০২১ সালও এক নয়। আমি মনে করি যে দীর্ঘ পথযাত্রায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নানান বিবর্তন হয়েছে, সমাজ রাষ্ট্রের নানান পরিবর্তন হয়েছে। আমার মনে হয় যে ১০০ বছর পরে একটা সময় এসেছে যখন আমার মনে হছে যে একটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কমিশন গঠন করা হোক না কেন। সেই কমিশনের কাজ হবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০০ বছরের ইতিহাসকে তুলে ধরা, সে বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০০ বছরের অর্জনকে তুলে ধরা এবং সেই সঙ্গে তার ব্যর্থতাকে চিহ্নিত করা। সেই কমিশনের কাজ হবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০০ বছর পূর্তির সীমারেখায় দাঁড়িয়ে দেশ জাতিকে বলা যে আগামী ১০০ বছরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কোথায় যেতে পারে, কী করে যেতে পারে, কী করা দরকার। জয়তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়!

 

সেলিম জাহান: নিউইয়র্কে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন কার্যালয় দারিদ্র্য বিমোচন বিভাগের সাবেক পরিচালক

আরও