বঙ্গবন্ধু, বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ

বঙ্গবন্ধু স্বপ্ন দেখেছেন ‘সোনার বাংলা’র। স্বপ্ন বাস্তবায়নের প্রথম পদক্ষেপ স্বাধীন দেশ বাংলা, বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করা, তা তিনি করে গেছেন। সাত কোটি বাঙালিকে সঙ্গে নিয়ে ‘লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে’ তিনি বাঙালি জাতির প্রথম স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে গেছেন। স্বাধীন বাংলার তিনি ‘মহানায়ক’। রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি দেশের ভবিষ্যৎ রূপকল্প, তার স্বপ্নের ‘সোনার বাংলা’র চরিত্র নির্ধারণ করেছিলেন,

বঙ্গবন্ধু স্বপ্ন দেখেছেনসোনার বাংলার। স্বপ্ন বাস্তবায়নের প্রথম পদক্ষেপ স্বাধীন দেশ বাংলা, বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করা, তা তিনি করে গেছেন। সাত কোটি বাঙালিকে সঙ্গে নিয়েলক্ষ প্রাণের বিনিময়েতিনি বাঙালি জাতির প্রথম স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে গেছেন। স্বাধীন বাংলার তিনিমহানায়ক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি দেশের ভবিষ্যৎ রূপকল্প, তার স্বপ্নেরসোনার বাংলা চরিত্র নির্ধারণ করেছিলেন, ‘দেশটি হবে গণতান্ত্রিক, সমাজতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ’ (১০ জানুয়ারি, ১৯৭২) পরে আরেকটি বৈশিষ্ট্য যুক্ত করেছেনজাতীয়তাবাদী’ (আরো নির্দিষ্টভাবে বাঙালি জাতীয়তাবাদী) সংবিধানে অবশ্য চার মূলনীতির প্রথমটিই জাতীয়তাবাদ উল্লিখিত হয়েছে (বাংলাদেশের সংবিধান, অনুচ্ছেদ , মূলনীতিসমূহ, পঞ্চদশ সংশোধনীসহ, ২০১১) 

আমরা অত্যন্ত ভাগ্যবান যে একজন অসম সাহসী সংগ্রামী নেতা পেয়েছি, যার জীবনকাল ছিল মাত্র ৫৫ বছর; যিনি অন্তত তিনটি বইয়ের পাণ্ডুলিপি রেখে গিয়েছিলেন, সেগুলো এখন প্রকাশিত গ্রন্থ (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, কারাগারের রোজনামচা, আমার দেখা নয়া চীন) সেসব গ্রন্থ তাঁর সম্পর্কে সরাসরি জানতে সাহায্য করে। পাশাপাশি রয়েছে পাকিস্তান গণপরিষদ, বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ অন্যান্য মঞ্চে তাঁর দেয়া ভাষণের শ্রুতিলিপি। নানাজনকে দেয়া তাঁর বিভিন্ন সাক্ষাত্কার লেখা চিঠিপত্র থেকেও দেশ, দেশের মানুষ, দেশের নানা বিষয় নিয়ে তাঁর ধারণা, চিন্তা-চেতনা, পরিকল্পনা, তাঁর রাজনৈতিক দর্শন বিশ্বাস সম্পর্কে জানার সুযোগ রয়েছে।

বঙ্গবন্ধু

বঙ্গবন্ধুর জন্ম ১৭ মার্চ, ১৯২০ সাল। বঙ্গবন্ধু তরুণ বয়সে রাজনীতি শুরু করেছেন মূলত ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ শাসন থেকে উপমহাদেশের স্বাধীনতার জন্য আন্দোলনে সম্পৃক্ত হয়ে। নেতৃত্বে তখন ভারতীয় কংগ্রেস মুসলিম লীগ। ১৯৪০ সালে লাহোর প্রস্তাবে ভারতের পাশাপাশি মুসলিম প্রাধান্যমণ্ডিত দুটি পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার চিন্তা ছিল (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃ. ২২), কিন্তু শেষ পর্যন্ত (১৯৪৬ সালে) পশ্চিম পূর্বাঞ্চলের সমন্বয়ে একটি পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব পাস হলো। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট যে ভূখণ্ডগুলো নিয়ে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়, তা নিয়েই বাংলার নেতারা (এবং তরুণ রাজনৈতিক কর্মী শেখ মুজিব) সন্তুষ্ট থাকতে বাধ্য হন। শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর পাঁচ বছরের (১৯৪২-৪৭) একটানা কলকাতা জীবনের সমাপ্তি টেনে পাকিস্তান তথা ঢাকা চলে আসেন। ঢাকার জীবন শুরু করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হিসেবে রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে। পাকিস্তান আন্দোলনের একনিষ্ঠ সৈনিক শেখ মুজিবুর রহমান, সদ্য স্বাধীন পাকিস্তানে আসার অল্প দিনের মধ্যেই তাঁর স্বপ্নভঙ্গ হতে থাকে। তিনি ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলন থেকে বাঙালি জাতীয়তাবাদী বা বাংলা ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদী রাজনীতিতে তত্পর হন। পূর্ব বাংলার স্বার্থ চিন্তাই তাঁর মনে প্রাধান্য পেতে থাকে এবং দ্রুত তা স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে উন্নীত হয় এবং ১৯৭১- তাঁর আহ্বানে সংঘটিত নয় মাসের এক রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে ১৬ ডিসেম্বর চূড়ান্ত সাফল্য অর্জনে সক্ষম হয়। স্বাধীন রাষ্ট্র, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়। এই রাষ্ট্রের স্থপতি বঙ্গবন্ধু, তিনি জাতির জনক।

বঙ্গবন্ধু বেঁচে ছিলেন ৫৫ বছর, তাঁর রাজনৈতিক জীবন মাত্র ৩৪ বছর, যার এক-তৃতীয়াংশই ছিল কারাবাস। অর্থাৎ মাত্র বছর বিশেকের প্রত্যক্ষ মুক্ত রাজনৈতিক কর্মতত্পরতার মাধ্যমে তিনি ছাত্র, রাজনৈতিক কর্মী, জাতীয় নেতা তথা রাজনৈতিক মহানায়কে রূপান্তরিত হয়েছিলেন। ফিদেল কাস্ত্রোর ভাষায়, তিনিহিমালয়সদৃশবিশালত্ব অর্জন করেছিলেন। বিশ্বের আধুনিক রাজনৈতিক ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় চরিত্র শেখ মুজিবুর রহমান। এমনটি সম্ভব হয়েছিল তাঁর বিচক্ষণতা, দূরদর্শিতা, অসাধারণ সাংগঠনিক দক্ষতা, সর্বজনসম্পৃক্ততা, কর্তব্যনিষ্ঠা আন্তরিকতা, সততা, আত্মবিশ্বাস সর্বোপরি অপরিমেয় সাহসিকতার জন্য। তাঁর ব্যক্তিগত মানবিক গুণাবলি ছিল প্রবাদতুল্য। প্রাকৃতিকভাবে প্রাপ্ত বলিষ্ঠ ভরাট কণ্ঠস্বর আকর্ষণীয় দেহসৌষ্ঠব, উদ্দীপনামূলক হূদয়গ্রাহী বাগ্মিতা ইত্যাদি ছিল এক মহান নেতার আবশ্যিক উপাদান। সব মিলিয়েই তিনি কিংবদন্তি, অদ্বিতীয়। এমন এক নেতার মর্মান্তিক শেষ পরিণতি কখনই কল্পনা করা যায়নি। নানা সংকীর্ণ ব্যক্তিস্বার্থ, গোষ্ঠীস্বার্থ, আর্থসামাজিক-রাজনৈতিক পরিবেশ পরিস্থিতি আন্তর্জাতিক চক্রান্ত দায়ী ছিল মহানায়কের চরম বিয়োগান্তক আপাত সমাপ্তির জন্য। আপাত বলছি কারণে যে পরবর্তী দুই দশকের ব্যবধানেই বঙ্গবন্ধুর আদর্শের পুনর্জাগরণ সূচিত হয়েছিল এবং সাড়ে চার দশকের মধ্যে তার নানামাত্রিক সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে। অবশ্য কোনো কোনো ক্ষেত্রে বাস্তবতা স্বস্তিকর নয়, বরং বলা চলে সংকটময় এবং তা বহুলাংশে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক রাজনৈতিক জটিলতার কারণে। বৈশ্বিক পরিবেশ সংকটের ভূমিকাও অবহেলা করার মতো নয় (বর্তমান নভেল করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাব বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য হুমকি মনে করা হচ্ছে)

বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ

বঙ্গবন্ধুর জীবনের সার্বক্ষণিক চিন্তা ছিল বাংলাদেশ বাংলাদেশের মানুষ বাঙালির কথা। তাঁরসোনার বাংলাপ্রত্যয়ে দেশ বাংলা বাঙালি দুই ধারণাই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। দেশ বাংলা বা ভৌগোলিক অর্থে বাংলাদেশ বলতে ১৯৪৭-এর আগস্ট পর্যন্ত শেখ মুজিবুর রহমান বৃহৎ বাংলার কথাই ভেবেছেন। পূর্ব বাংলার ছেলে মুজিবুর রহমানের উচ্চশিক্ষা রাজনীতির হাতেখড়ি পশ্চিম বাংলার কলকাতা শহরে, ঢাকায় নয়। রাজনৈতিক চিন্তায়ও বৃহৎ বাংলার স্বপ্নে আপ্লুত ছিলেন তাঁর রাজনৈতিক গুরু সোহরাওয়ার্দী শরৎ বসুর অনুসরণে।

শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৪৭ পর্যন্ত প্রত্যক্ষভাবে কলকাতার বাইরে পশ্চিম বাংলার খুব কম জায়গাই দেখেছেন, বরং সুদূর আগ্রা, দিল্লি, আজমির দেখার সুযোগ পেয়েছেন (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃ., ৫৪-৬০), ট্রেনে ভ্রমণ করেছেন। পূর্ব বাংলায় তাঁর নিজ জেলা ফরিদপুরের গোপালগঞ্জ, মাদারীপুর সদর ফরিদপুর দেখেছেন। গোপালগঞ্জ ঘনিষ্ঠভাবে জেনেছেন। বঙ্গীয় -দ্বীপের এই এলাকার মধুমতী নদীর সৌন্দর্য উপভোগ করেন নৌকায় করে। বরিশালে সভা করতে গেছেন, নদীতে স্টিমারে ভ্রমণ করেছেন। ঢাকা-গোপালগঞ্জ করেছেন। ১৯৪৭- ভারতভাগের পূর্বলগ্নে বঙ্গবন্ধু তাঁর বাংলাদেশকে একেবারে নিজের হাতের তালুর মতো চিনতেন।আমার মতো করে বাংলাদেশকে কেউ চেনে না,’—এভাবেই তিনি বলতে পারতেন। একজন জননেতা দ্রুত মহান নেতায় উন্নীত হন তখন, যখন তাঁর অন্য গুণাবলির সঙ্গে তিনি জনগণের আস্থা অর্জন করতে পারেন। আর এই আস্থা অর্জনের জন্য নেতাকে জনগণের কাছে যেতেই হয়, তাদের চিনতে হয়, জানতে হয়। বঙ্গবন্ধু বারবার বাংলার মানুষের কাছে চলে গেছেন, তিনি সারা বাংলাদেশচষে বেড়িয়েছেন

বাংলাদেশ (বা দেশ বাংলাকে) তিনি ব্যাপকভাবে এবং অত্যন্ত নিবিড়ভাবে দেখেছেন, এমন কোনো জায়গা ছিল না তিনি দেখেননি। বাংলাদেশের ভৌগোলিক পরিবেশ তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন। তবে তাঁর লেখালেখিতে বিশদভাবে বর্ণনা করেননি। বরং উত্তর ভারত, (পশ্চিম) পাকিস্তান, চীন দেশ ভ্রমণ করে সেসব দেশ সম্পর্কে বেশ বিস্তারে লিখেছেন, চীনের ওপর তো গোটা একটি বই- লিখেছেন। সেসব জায়গার কথা লিখতে গিয়ে তুলনায় বাংলাদেশের কথা লিখেছেন। যেমন বালুময় করাচির কথা লিখতে গিয়ে বাংলার সবুজ প্রকৃতির কথা লিখেছেন। রেঙ্গুনের ফুলের সৌন্দর্য দেখে বাংলাদেশের ফুলের সৌন্দর্যের কথা বলেছেন। চীন দেশে লেকের পানি দেখে নিজ দেশের পানির কথা লিখেছেন। বাংলাদেশ পলি মাটির দেশ, লিখেছেন। উর্বর কিন্তু আরো কেন অধিক উৎপাদনশীল নয়, প্রশ্ন তুলেছেন।

বঙ্গবন্ধু বলেছেন, বাংলাদেশ পলি মাটির দেশ, সবুজ দেশ, নদী পানির দেশ, ফুল-ফলের দেশ। বাঙালি পলি মাটির দেশের মানুষ, তাই তাদের মনও নরম। বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ, তাই নৌবাহিনীর গুরুত্ব রয়েছে, বলেছেন।

আয়তনে ছোট দেশ, জনসংখ্যায় বিশাল

স্বাধীনতা অর্জনের পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের ভৌগোলিক আয়তন জনসংখ্যা নিয়ে কথা বলেছেন। বারবার উল্লেখ করেছেন বাংলাদেশ একটি ছোট দেশ, মাত্র৫৪ হাজার স্কয়ার মাইল’ (দু-এক জায়গায় ৫৫ হাজার বর্গমাইল বলেছেন)-এর একটি দেশ, যে দেশের জনসংখ্যা সাড়ে সাত কোটি (১৯৭২) বঙ্গবন্ধু অত্যন্ত দুর্ভাবনায় ছিলেন, এই ছোট দেশে এত বিশাল জনসংখ্যার খাদ্য চাহিদা কীভাবে পূরণ করবেন। জনসংখ্যা উচ্চহারে বৃদ্ধি পাচ্ছিল। তিনি বলেছেন, ‘বছরে ৩০ লাখ নতুন মানুষ যুক্ত হচ্ছে’, ২০-২৫ বছরে জনসংখ্যা ২০ কোটি হয়ে যাবে।বাঁচতে পারবেন না, যেইখানে গিয়ে থাকুন, বাঁচার উপায় নেই। পপুলেশন কন্ট্রোল করতে হবে’ (সমবায়ের ওপর ভাষণ, এপ্রিল, ১৯৭২; বাংলাদেশ বেতার)

দেশের সীমিত ভৌগোলিক আয়তন জনসংখ্যার বিশাল ক্রমবর্ধমান আকার তাঁকে ভীষণভাবে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত করত। তিনি সমস্যা সমাধানের চিন্তায় জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ, পরিবার পরিকল্পনা পাশাপাশি উৎপাদন বৃদ্ধির কথা, সমবায় ব্যবস্থা চালুর কথা বলেছেন। স্বাধীনতা-উত্তর যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের ভৌত অবকাঠামোর সমস্যা, দারিদ্র্য, খাদ্য সমস্যা, শিল্প, স্বাস্থ্য, আবাসন সব ক্ষেত্রেই সমস্যার তীব্রতা অনুভব করেছেন। তা সত্ত্বেও তিনি তাঁর স্বপ্নেরসোনার বাংলাবাস্তবায়নের কথা বলতেন।

সোনার বাংলা বাস্তবায়নের জন্য চার রাষ্ট্রীয় মূলনীতি নির্ধারণ করেছেন, ‘জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ধর্মনিরপেক্ষতা’, মূলনীতির আলোকে দেশ পরিচালনার জন্য স্বল্পতম সময়ে (স্বাধীনতা অর্জনের ঠিক এক বছরের মধ্যে) একটি প্রশংসনীয় সংবিধান প্রণয়ন অনুমোদন সম্ভব করিয়েছেন। অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পদ্ধতি বা কৌশল হিসেবে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার কথা বলেছেন, উন্নয়নে সমবায় পদ্ধতি অনুসরণের নির্দেশ দিয়েছেন। জাতীয় উন্নয়নের জন্যএকটা কম্প্রিহেনসিভ প্ল্যানেরপ্রয়োজনীয়তার কথা বলেছেন (১৫ ডিসেম্বর, ১৯৭২), সেই মতো পরিকল্পনা কমিশন গঠন করেছেন, শ্রেষ্ঠ অর্থনীতিবিদদের সমন্বয়ে। জাতীয় উন্নয়নের সব খাতে পাঁচসালা পরিকল্পনা প্রণয়ন করিয়েছেন। দারিদ্র্য দূরীকরণ সে পরিকল্পনায় গুরুত্ব পেয়েছিল। শিক্ষার গুরুত্ব স্বীকৃত হয়েছিল। শিক্ষা কমিশন গঠন করেছিলেন দেশের শ্রেষ্ঠ মনীষীদের সমন্ব্বয়ে। সর্বজনীন শিক্ষা, উচ্চশিক্ষা, বিশেষায়িত শিক্ষা, প্রয়োগমুখী শিক্ষাসবই সেই শিক্ষা কমিশন রিপোর্টে সুপারিশ লাভ করেছিল। একমুখী শিক্ষা ব্যবস্থা প্রবর্তনের সুপারিশ ছিল, শিক্ষার মাধ্যম হবে মাতৃভাষাএই সুপারিশ ছিল। প্রয়োজনে উচ্চশিক্ষার মাধ্যম দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে ইংরেজি থাকতে পারবে এমন সুপারিশও ছিল। পরিতাপের বিষয়, পরবর্তী সময়ে তাঁর মৃত্যুর পর সেই সব সুপারিশ তেমন বাস্তবায়ন হতে দেখা যায়নি, বরং অনেক ক্ষেত্রে ভুল পথেই পরিচালিত হয়েছে।

স্বাধীনতা অর্জনের মাত্র সাড়ে তিন বছরের মধ্যে স্বাধীনতাবিরোধীদের হাতে জাতির জনকের নিহত হওয়ার অবিশ্বাস্য ঘটনায় অনেকেরই হয়তো মনে হয়েছিল, তাঁর সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন বুঝি শেষ হয়ে গেল। কিন্তু পরবর্তী ইতিহাস ভিন্ন কথা বলছে। মহান নেতার সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনা, তাঁরই মতো অসম সাহসী বিচক্ষণ, তিনি তাঁর পিতার, আমাদের জাতির জনকের, স্বপ্নেরসোনার বাংলাগড়ার প্রত্যয় নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন। ক্ষুধামুক্ত, দারিদ্র্যমুক্ত, দুর্নীতিমুক্ত, সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন।

বঙ্গবন্ধু উপলব্ধি করেছিলেন, বাংলাদেশ ভৌগোলিক আয়তনে ছোট, জনসংখ্যায় বিশাল, দেশের মানুষকে বাঁচাতে হলে খাদ্যসহ সব ক্ষেত্রে উৎপাদন বাড়াতে হবে, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে, দুর্নীতি বন্ধ করতে হবে। অর্থনৈতিকভাবে শেখ হাসিনার বাংলাদেশ অবিশ্বাস্য উন্নয়ন সাধন করেছে। এতটাই যে দেশী-বিদেশী অনেক বিজ্ঞ অর্থনীতিবিদ উন্নয়নকেপ্যারাডক্স’, ‘পাজলবাধাঁধাইত্যাদি শব্দে চিহ্নিত করেছেন। দেশের মাথাপিছু জাতীয় আয় ২০১০ সালের ৭৫৮ ডলার থেকে ২০২০-এর শেষে হাজার ডলার ছাড়িয়ে গেছে, জিডিপির বার্ষিক গড় বৃদ্ধির হার পুরো দশক শতাংশের ওপরে ছিল; গত তিন বছর শতাংশের ওপর, এমনকি শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। দেশ মধ্যম আয়ের মর্যাদায় উঠে যাচ্ছে। তথ্য অবশ্যই শ্লাঘার বিষয়। এমনকি গত মার্চ থেকে আজ পর্যন্ত যে করোনা মহামারী পরিবেশ, তাতেও দেশের অর্থনীতি সচল রয়েছে।

বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা দারিদ্র্যপীড়িত থাকবে না, এমন আকাঙ্ক্ষা ছিল। দেশে দারিদ্র্যের মাত্রা অবশ্যই উল্লেখযোগ্যভাবে কমানো সম্ভব হয়েছে। ২০১০- ৩১ দশমিক শতাংশ থেকে ২০১৮ সালে কমে এসে দাঁড়িয়েছে মাত্র ২১ দশমিক শতাংশে। অতি দারিদ্র্য মাত্রা ২০১০-এর ১৭ দশমিক শতাংশ থেকে কমে ১১ দশমিক শতাংশে নেমেছে। অবশ্য লক্ষণীয় যে অতি দারিদ্র্য মাত্রা ১২ শতাংশে নামানো সম্ভব হলেও দেশে অতি দরিদ্র মোট জনসংখ্যা প্রায় পৌনে দুই কোটি এবং মোট দরিদ্র জনসংখ্যা প্রায় সাড়ে তিন কোটি। এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা ২০৩০-এর মধ্যে অতি দারিদ্র্য মাত্রা শূন্যের ঘরে নামিয়ে আনা বাংলাদেশের জন্য একেবারে অসম্ভব না- হতে পারে। অবশ্য দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিবেশ জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকি বিশেষ নেতিবাচক ভূমিকা পালন না করলে। কভিড-১৯ মহামারীও দারিদ্র্য পরিস্থিতির ওপর প্রভাব রাখতে শুরু করেছে।

বঙ্গবন্ধুর চিন্তা-চেতনায় এবং তার প্রতিফলন যে সংবিধান, তাতে (১৬ অনুচ্ছেদে) বলা হয়েছে, ‘নগর গ্রামাঞ্চলের জীবনযাত্রার মানের বৈষম্য ক্রমাগতভাবে দূর করিবার উদ্দেশ্যে কৃষি বিপ্লবের বিকাশ, গ্রামাঞ্চলে বৈদ্যুতিকরণের ব্যবস্থা কুটির শিল্প অন্যান্য শিল্পের বিকাশ এবং শিক্ষা, যোগাযোগ ব্যবস্থা জনস্বাস্থ্যের উন্নয়নের মাধ্যমে গ্রামাঞ্চলের আমূল রূপান্তর সাধনের জন্য রাষ্ট্র কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন।মনে করার কারণ রয়েছে যে বিগত দশকগুলোয় এমন ব্যবস্থা খুব কার্যকরভাবে নেয়া হয়নি। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তথা বর্তমান সরকারগ্রাম হবে শহরঅর্থাৎ শহরের সব সুবিধা সেবা গ্রামেই পাওয়া যাবে, এমন নির্বাচনী অঙ্গীকারে তথা উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণে উদ্যোগী হয়েছে। দৃঢ় প্রত্যয়ে এগিয়ে গেলে এর ইতিবাচক ফল অবশ্যই পাওয়া যাবে।

 

নজরুল ইসলাম: অধ্যাপক, শিক্ষাবিদ

নগরবিদ শিল্প সমালোচক

আরও