ডেইরি শিল্পের করপোরেট রূপান্তর

গোলা ভরা ধান, গোয়াল ভরা গরু চিরায়ত বাংলার এটিই অতি পরিচিত রূপ। একটা সময় গ্রামবাংলার প্রতিটি ঘরেই গবাদি পশু লালন-পালনের প্রচলন ছিল। এটি ছিল বাঙালি কৃষক-গৃহস্থ ঘরের একটি ঐতিহ্য। নিজেদের পরিবারের জন্য খাঁটি দুধের চাহিদা মেটাতেই মানুষ গরু-ছাগল লালন-পালন করত। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সেই প্রথায় এখন পরিবর্তন এসেছে। মানুষ এখন আর আগের মতো ঘরে ঘরে গরু-গাভী লালন-পালন করে না। জনসংখ্যার বিরাট অংশ শহরবাসী আর শহুরে জীবনে গবাদি পশু পালনের তো কোনো সুযোগই নেই। কিন্তু ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে প্রাণিজ আমিষের চাহিদা ঠিকই বেড়ে চলেছে। তাই ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছে বাণিজ্যিকভাবে গবাদি পশু পালন ব্যবস্থা। গড়ে উঠেছে ছোট-বড় লাখো খামার।

গোলা ভরা ধান, গোয়াল ভরা গরু চিরায়ত বাংলার এটিই অতি পরিচিত রূপ। একটা সময় গ্রামবাংলার প্রতিটি ঘরেই গবাদি পশু লালন-পালনের প্রচলন ছিল। এটি ছিল বাঙালি কৃষক-গৃহস্থ ঘরের একটি ঐতিহ্য। নিজেদের পরিবারের জন্য খাঁটি দুধের চাহিদা মেটাতেই মানুষ গরু-ছাগল লালন-পালন করত। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সেই প্রথায় এখন পরিবর্তন এসেছে। মানুষ এখন আর আগের মতো ঘরে ঘরে গরু-গাভী লালন-পালন করে না। জনসংখ্যার বিরাট অংশ শহরবাসী আর শহুরে জীবনে গবাদি পশু পালনের তো কোনো সুযোগই নেই। কিন্তু ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে প্রাণিজ আমিষের চাহিদা ঠিকই বেড়ে চলেছে। তাই ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছে বাণিজ্যিকভাবে গবাদি পশু পালন ব্যবস্থা। গড়ে উঠেছে ছোট-বড় লাখো খামার।

১৯৭১-৯৭ সাল পর্যন্ত আমাদের দেশে মাথাপিছু দুধের প্রাপ্যতা ছিল ২৬-২৮ লিটার। সে সময় প্রতিটি গরু দিনে দুই লিটার দুধ দিত। ১৯৯৭ সাল থেকে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর কর্তৃক উন্নত জাতের বিকাশ কার্যক্রম জোরদার হয়ে ওঠে। ১৯৯৮ সাল থেকে এ খাত বিকশিত হতে থাকে। বাংলাদেশে ডেইরি শিল্প এখনো একটি ক্রমবর্ধমান শিল্প। বিগত দশকে ধারাবাহিকভাবে ডেইরি শিল্প উন্নত হয়েছে। ধীরে ধীরে বিকাশ ঘটেছে দুগ্ধ ও মাংস প্রক্রিয়াজাত খামারগুলোর। মিল্ক ভিটা, প্রাণ, আড়ং, ফার্ম ফ্রেশ ইত্যাদি বেসরকারি ডেইরি খামার সারা দেশে বাণিজ্যিকভাবে তরল ও পাস্তুরাইজ দুধ সরবরাহ করে চলেছে এবং কর্মসংস্থান হচ্ছে বেকার যুবকদের। এছাড়া উন্নত জাতের গবাদি পশু  পালন করে খামারিসহ গ্রামীণ নারীরাও স্বাবলম্বী হচ্ছে। কিন্তু বহুমুখী উন্নয়নের পরও এখনো এ শিল্প নানা  চ্যালেঞ্জের সঙ্গে লড়াই করে চলছে। আর সেসব চ্যালেঞ্জের কারণে মূলত সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে ছোট-মাঝারি পর্যায়ের খামারিরা। সম্প্রতি করোনা ও আম্পানের প্রভাবে অন্যান্য ক্ষেত্রের মতো ডেইরি শিল্পও আর্থিকভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। সেই ক্ষতি কাটিয়ে উঠে ডেইরি শিল্পকে নতুন উদ্যমে চাঙ্গা করে তুলতে বর্তমান চ্যালেঞ্জ ও সমস্যাগুলো সম্পর্কে আলোচনা আবারো নতুন করে সামনে এসেছে।

বর্ধিত জনসংখ্যার খাদ্য ও পুষ্টি চাহিদা পূরণে কৃষি এবং অকৃষি উভয় ক্ষেত্রেই সমানে সমানে ভূমিকা পালন করা প্রয়োজন। ধান উৎপাদনে আমরা বর্তমানে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছি। মাছ উৎপাদনে আমরা বিশ্বে দ্বিতীয়। বিভিন্ন ধরনের সবজি ও ফল উৎপাদনেও বাংলাদেশের সাফল্য উল্লেখযোগ্য। পোলট্রি শিল্পের বিকাশের মাধ্যমে ডিম ও মুরগির উৎপাদনও আমাদের চাহিদা মেটাতে সক্ষমতা অর্জন করেছে। সেই তুলনায় কিছুটা পিছিয়ে আছে দুধ ও মাংসের উৎপাদন। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের প্রতিবেদন অনুযায়ী, একজন মানুষের দৈনিক ১২০ গ্রাম মাংসের প্রয়োজন। সেখানে উৎপাদন হচ্ছে ১২৫ গ্রাম। কিন্তু মাথাপিছু ভোগের পরিমাণ কম। যদিও বিগত দুই বছরে কোরবানির ঈদগুলোয় ভারত থেকে গরু আমদানি বন্ধ হওয়ার পরও দেশে কোরবানির গরুর চাহিদা পূরণ সম্ভব হয়েছে, কিন্তু একই সঙ্গে গত দুই দশকে দেশে গরুর মাংসের দাম বেড়েছে ১০ গুণের বেশি। বর্তমানে কেজিপ্রতি গরুর মাংস বিক্রি হয় ৬০০ টাকা করে, যা মধ্যবিত্তের জন্য বিলাসিতা আর নিম্নবিত্তের নাগালের বাইরে। এদিকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, মানুষের প্রতিদিন ২৫০ মিলিমিটার দুধ পান করা উচিত। সরকারি হিসাবে আমাদের দেশে দুধের মাথাপিছু প্রাপ্যতা ১৫৮-১৬০ মিলি। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে দেশে মোট চাহিদার ৬৪ দশমিক ৬৮ শতাংশ দুধ উৎপাদন হয়েছে। তাই দেশীয় চাহিদা পূরণে এখনো আমদানি করা গুঁড়ো দুধের ওপরই আমরা নির্ভরশীল। বছরে প্রায় ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকার বেশি মূল্যের বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় হচ্ছে শুধু দুধ আমদানির ক্ষেত্রে। সে কারণে দুধের দামও নিম্ন ও মধ্যবিত্তের জন্য সব সময় চড়া। আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোর গুঁড়ো দুধের কারণে দেশী দুধের চাহিদা কম। তাই খামারিরাও দাম কম পায়। গুঁড়ো দুধের ওপর আমদানি কর বৃদ্ধি করলে দেশীয় কোম্পানিগুলো ভালো করার সুযোগ পাবে।

আমাদের দেশে দুগ্ধ উৎপাদন বৃদ্ধির পথে প্রধান বাধাগুলো হচ্ছে  অপর্যাপ্ত জমি, গবাদি পশুর পর্যাপ্ত খাবারের স্বল্পতা ও অস্থিতিশীল খাদ্যমূল্য এবং গরুর উৎপাদন ক্ষমতা। খামারগুলোয় গাভীর জাত, বাসস্থান, খাদ্য ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা অপেক্ষাকৃত দুর্বল ও গতানুগতিক বিধায় দুগ্ধ উৎপাদন কম। দুগ্ধ বাজারজাতকরণেও আমাদের কোনো সমন্বিত বিপণন ব্যবস্থা নেই। এছাড়া   বাজেটে বাস্তবমুখী সমাধান পেতে উন্নত প্রযুক্তি, অর্থায়ন ও বিপণন সুবিধার পাশাপাশি নীতিসহায়তা নিশ্চিত করা প্রয়োজন।

প্রথমত, জমির পরিমাণ বৃদ্ধি করা যেহেতু সম্ভব নয়, সেহেতু উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির দিকেই নজর দিতে হবে। ক্রমবর্ধমান দুধ ও মাংসের চাহিদা  মেটাতে উন্নত প্রযুক্তির সমন্বয়ে তৈরি অধিক উৎপাদনশীল উন্নত জাতের গাভী লালন-পালন করা অত্যন্ত জরুরি। সাধারণত ভালো মানের একটি গরু দিনে ৬২ লিটার দুধ দেয়। আমেরিকায় গড়ে প্রতিটি গরু ৫২ লিটার দুধ দেয়। আমাদের খামারগুলোয় গড়ে প্রতিটি গরু পাঁচ-ছয় লিটার দুধ দেয়। এর বাইরে যে গরু আছে, সেসব দু-তিন লিটার দুধ দেয়। খামারে দেশী জাতের গরু রয়েছে ৮৫ শতাংশ। সংকর জাতের আছে ১৫ শতাংশ। সংকর জাতের গরুর সংখ্যা বাড়াতে পারলে দুধের উৎপাদন বাড়বে। গত পাঁচ বছরে লিটারপ্রতি দুধের উৎপাদন ব্যয় কমেছে। সংকর জাতের গরুর সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় এ খরচ কমেছে। কিন্তু এখনো সব খামারির কাছে সংকর জাতের গরু নেই। কৃষক পর্যায়ে এ জাতের গরু পৌঁছে দিতে পারলে দুধের উৎপাদন খরচ আরো কমবে। তখন ভোক্তারাও কম দামে দুধ ক্রয় করতে পারবে। এছাড়া আমাদের দেশে অস্ট্রেলিয়ান, জার্সি, ন্যাড়ামুন্ডো, হরিয়ানা ও সিল্কি জাতের গাভী বেশি পালন করা হয়। যদি কানাডা, ইংল্যান্ড, জার্মানি, আমেরিকার মতো দেশ থেকে উন্নত জাতের বীজ আনা যায়, সেক্ষেত্রে খামার ব্যবসায়ীরা আরো বেশি উপকৃত হবেন। তখন দুধ উৎপাদন আরো বৃদ্ধি পাবে। এছাড়া আমাদের প্রতিবেশী দেশগুলো যেমন ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলংকাসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর হাই-টেক ডেইরি খামার স্থাপন করে দুগ্ধ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করছে। আমাদেরও আধুনিক সুযোগ-সুবিধাসম্পন্ন হাই-টেক খামার স্থাপনে উদ্যোগ নিতে হবে।

দ্বিতীয়ত, পশুখাদ্যের মূল্য সহনীয় করতে পশুখাদ্যের নিয়ন্ত্রণ ও শুল্কমুক্ত আমদানি শুধু করোনাকালীন নয়, সব সময়ই উন্মুক্ত রাখা প্রয়োজন। পশু পালনের জন্য ব্রিডিং, ভ্যাকসিন ও সিমেন আমদানি বেসরকারি খাতের জন্য উন্মুক্ত রাখতে হবে। সেক্ষেত্রে বেসরকারি যত সিমেন প্রতিষ্ঠান আছে, তাদের কর্মীদের দক্ষতা, সিমেনের মান এবং সেই সিমেন সরকারি প্রজনন নীতিমালায় অনুমোদিত কিনা তা প্রাণিসম্পদ বিভাগকে কঠোর নজরদারির মাধ্যমে নিশ্চিত করতে হবে। সারা দেশে স্বল্প সুদে ডেইরি খামারি-ব্যবসায়ীদের পর্যাপ্ত ঋণ প্রদান, উদ্যোক্তাদের সহজ শর্তে ব্যাংক ও এনজিও কর্তৃক আর্থিক সহায়তা প্রদান এবং পশু বীমা চালুর ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন। ভারতে   দুধ উৎপাদনে খামারিদের ভর্তুকি দেয়া হয়। একইভাবে বাংলাদেশের খামারিদেরও সরকারের পক্ষ থেকে ভর্তুকি দেয়ার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এছাড়া সরকারি-বেসরকারি সহায়তায় দেশে বিভিন্ন অঞ্চলে খামারিদের সমবায়ের মাধ্যমে একত্র হয়ে গো-খাদ্য প্রক্রিয়াজাত কেন্দ্র, দুগ্ধ বিক্রয়কেন্দ্র ইত্যাদি গড়ে তুলতে সার্বিক সহযোগিতা প্রদান করতে হবে, যাতে স্বল্প খরচে স্থানীয় ও মাথাপিছু চাহিদা পূরণ সম্ভব হয়।

তৃতীয়ত, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর কর্তৃক প্রতিটি উপজেলায় ডেইরি বা অন্যান্য পশুপালন ও প্রযুক্তির ওপর প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা রাখতে হবে। প্রাণীর রোগ চিকিৎসায় গ্রাম পর্যায়ে পর্যাপ্ত সংখ্যক চিকিৎসক ও দক্ষ কর্মী নিয়োগ বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। ভ্যাকসিনের সহজলভ্যতা ও গবাদি পশুর যথেষ্ট চিকিৎসা সুবিধা নিশ্চিত করতে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর কর্তৃক বিশেষ রক্ষণাবেক্ষণের ব্যবস্থা রাখতে হবে।

আমাদের দেশের মানুষদের মাঝে দুধ জনপ্রিয় না হওয়ার পেছনে প্রচারণার অভাব রয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রচার করা হয়। আবার কখনো কখনো বাজারে আসলেই পর্যাপ্ত পরিমাণ মানসম্পন্ন দুধের ঘাটতি দেখা যায়। যেমন দুধে বেশি পরিমাণ ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি। আন্তর্জাতিক নিয়ম হলো, প্রতি মিলি লিটার দুধে সর্বোচ্চ দুই লাখ ব্যাকটেরিয়া থাকতে পারবে। বাংলাদেশে প্রতি মিলিলিটার দুধে ব্যাকটেরিয়ার পরিমাণ ২০ লাখের বেশিও পাওয়া যায়। তাই নিরাপদ খাদ্য সরবরাহের বিষয়টিও মাথায় রাখতে হবে। ডেইরি প্রক্রিয়াজাত খামারগুলোর বিভিন্ন দুগ্ধজাত পণ্য বাজারে আনার চেষ্টা চালাতে হবে। গরমে তৃষ্ণা মেটাতে আমরা যে বিভিন্ন ঠাণ্ডা ও কোমল পানীয় পান করি, তাতে পুষ্টি পরিপূরক কোনো উপাদান নেই। কিন্তু পরিশুদ্ধ ও প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে যদি এসব পানীয়র বিকল্প হিসেবে বিভিন্ন ফ্লেভারযুক্ত গরুর দুধ বাজারজাত করা যায়, তাহলে জনপ্রিয়তা লাভের পাশাপাশি আমরা আর্থিকভাবে এবং স্বাস্থ্যগতভাবে লাভবান হতে পারব। যেমন ভারতে মহিষের দুধ হিসেবে আমুল, কুল ইত্যাদি বোতলজাত দুধ খুবই জনপ্রিয়। এছাড়া আমাদের দেশে গুঁড়ো দুধ আমদানিতে প্রতি বছর ব্যয় হওয়া অর্থ সাশ্রয় করা সম্ভব হবে।

নানা প্রতিবন্ধকতার ভিড়েও আশার কথা হচ্ছে, ডেইরি শিল্পের অগ্রগতির লক্ষ্যে বর্তমান সরকারের প্রচেষ্টায় সপ্তম পরিকল্পনা মেয়াদে নেয়া বেশকিছু পদক্ষেপ ইতোমধ্যে বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে। যেমন ডেইরি খাতে সমবায়ের উপস্থিতি, ডেইরি চাষীদের উন্নত প্রযুক্তি সরবরাহ, গবাদি পশুর খাদ্য উৎপাদন, প্রাণী স্বাস্থ্য রক্ষায় ভেটেরিনারি সেবা বৃদ্ধি  ও ক্ষুদ্রকায় খামারিদের ঋণ সুবিধা প্রদানসহ বিপণন ব্যবস্থা জোরদারকরণ। এ বিষয়গুলোর সুষ্ঠু বাস্তবায়নে প্রয়োজন সরকারের নিরবচ্ছিন্ন সহযোগিতা ও বাজেট বরাদ্দ। এছাড়া প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে এলডিডিপি (লাইভস্টক অ্যান্ড ডেইরি ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট) প্রকল্প নেয়া হয়েছে। আশা করি, এ প্রকল্পের মাধ্যমে ৬০ লাখ মেট্রিক টন দুধের যে ঘাটতি আছে, তা পূরণ করা সম্ভব হবে। সরকারের একার পক্ষে ডেইরি শিল্পের সব সমস্যা সমাধান করে পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটানো সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে বেসরকারি খাতগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে। পোলট্রি খাতে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। ডেইরি শিল্প খাতেও সেই রূপ বড় বড় প্রতিষ্ঠানকে এগিয়ে আসতে হবে। সর্বোপরি সরকারের প্রাণিসম্পদ বিভাগ সক্রিয় হলে ডেইরি শিল্পের উৎপাদন  বৃদ্ধি ও চাহিদা পূরণ করে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন সম্ভব হবে।

বাংলাদেশ ভূখণ্ডে কারখানাভিত্তিক ডেইরি শিল্প গড়ে তোলার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয় ১৯৪৬ সালে। পাবনা-সিরাজগঞ্জ জেলায় নামমাত্র মূল্যে দুধ বিক্রয় হতো, সেহেতু দুগ্ধ ব্যবসায়ীরা কোলকাতাকে মার্কেট হিসেবে চিহ্নিত করে ১৯৪৬ সালে তত্কালীন ভারতীয় উপমহাদেশের ন্যাশনাল নিউট্রিয়েন্টস ইনস্টিটিউট কর্তৃক বর্তমানে সিরাজগঞ্জ জেলার লাহিরমোহনপুরে প্রথম দুগ্ধ কেন্দ্রটি স্থাপন করে। ১৯৪৮ সালে   মুখলেছুর রহমান তার নিজস্ব বিনিময় সূত্রে কারখানাটির মালিকানা গ্রহণ করেন ও নামকরণ করেন ইস্টার্ন মিল্ক প্রোডাক্টস। ১৯৫২ সালে তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তানে দুগ্ধ ও দুগ্ধপণ্যের বিপণন সংস্থা মিল্ক ভিটা ব্র্যান্ড নামে যাত্রা  করে। দুধ, ঘি, মাখন ইত্যাদি দুগ্ধজাত পণ্যসামগ্রী উৎপাদন করে কলকাতা শহরে স্বল্প পরিসরে কিছু দিন মিল্ক ভিটা নামে বাজারজাতও করা হয়। ১৯৬৬ সালে প্রতিষ্ঠানটি সমবায় ব্যবস্থাপনায় এনে সমবায়ভিত্তিক প্রাথমিক দুগ্ধ উৎপাদনকারী সমিতি গড়ে তোলার উদ্যোগ গ্রহণ করে এবং পুরনো নাম সংশোধন করে প্রতিষ্ঠানটির নাম রাখা হয় ‘ইস্টার্ন মিল্ক প্রডিউসার্স কো-অপারেটিভ ইউনিয়ন লিমিটেড। কিন্তু প্রাথমিকভাবে সমবায় ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি ফলপ্রসূ না হওয়ায় ১৯৬৮ সালে সমবায় বিপণন সমিতি কর্তৃক ওই কারখানার দায়িত্বভার গ্রহণ করা হয়। একই সময়ে আর্থিকভাবে দেউলিয়াত্বের কারণে সমবায় বিপণন সমিতি কর্তৃক ঢাকার তেজগাঁওয়ে ‘অষ্টো ডেইরি’ নামে বোতলজাত দুগ্ধ উৎপাদন ও বিপণনের আরেকটি প্রতিষ্ঠানেরও দায়িত্বভার গ্রহণ করা হয়। প্রতিষ্ঠান দুটি সীমিতভাবে কিছুদিন উৎপাদন ও বিপণন কর্মকাণ্ড পরিচালনা করলেও সঠিক ব্যবস্থাপনা ও আর্থিক সহযোগিতার অভাবে ১৯৭০ সালের প্রথমদিকে  এগুলোর উৎপাদন ও বিপণন কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়।

স্বাধীনতার পরই জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেহনতি মানুষের ভাগ্যের উন্নয়ন, কৃষকের উৎপাদিত দুধের ন্যায্যমূল্য এবং শহরের ভোক্তাশ্রেণীর মধ্যে নিরাপদ ও স্বাস্থ্যসম্মত দুগ্ধ সরবরাহের জন্য নিজস্ব উৎপাদন ক্ষেত্র দিয়ে দুগ্ধ চাহিদা মেটানোর লক্ষ্যে ভারতের ‘আমূল’ পদ্ধতি অনুসরণ করে দুগ্ধশিল্প গড়ে তোলার জন্য নির্দেশনা প্রদান করেন। তারই ফলে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা এবং ডেনিশ আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থার পরামর্শে বাংলাদেশ দুগ্ধ উৎপাদক সমবায় লিমিটেড গঠিত হয়। দুগ্ধ উৎপাদনকারী কৃষকদের স্বার্থ সংরক্ষণ করে দুগ্ধ উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য সরকারের ১৩ কোটি টাকা ঋণসহায়তায় দেশের পাঁচটি দুগ্ধ এলাকায় কারখানা স্থাপন করা হয়। পরবর্তী সময়ে ১৯৭৭ সালে ‘বাংলাদেশ দুগ্ধ উৎপাদনকারী সমবায় ইউনিয়ন লিমিটেড’ (মিল্ক ভিটা) নামে এর নামকরণ   হয়। ১৯৯০ দশকের গোড়ার দিকে মিল্ক ভিটা একটি লাভজনক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে রূপ নেয়। বর্তমানে মিল্ক ভিটার অধীনে বাংলাদেশের তরল দুধের ৭০ শতাংশ বাজার দখলে রয়েছে। মিল্ক ভিটা প্রতিদিন ৪০ হাজার দুগ্ধ উৎপাদনকারী কৃষকের কাছ থেকে দুধ সংগ্রহ করে। এর অধীনে রয়েছে ৩৯০টি প্রাথমিক কো-অপারেটিভ সোসাইটি। প্রতিদিন সদস্যদের কাছ থেকে গড়ে দু-এক লিটার উদ্বৃত্ত দুধ সংগ্রহ করে। তরল দুধের পাশাপাশি মিল্ক ভিটা ঘি, মাখন, আইস ক্রিম, মিষ্টি দই, মিষ্টিহীন দই, ক্রিম, চকোলেট, বিক্রি করে।

গ্রামীণ চাষীদের জন্য একটি সংগঠিত বাজার তৈরি করতে এবং তাদের  লাভজনক ব্যবসায় সহায়তার জন্য ১৯৯৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘ব্র্যাক ডেইরি’ তথা আড়ং। যখন গ্রামগুলোয় দুধের চাহিদা কম ছিল এবং ফ্রিজে সংরক্ষণের কোনো ব্যবস্থা ছিল না, তখন সেই প্রয়োজন মেটাতে ব্র্যাক গ্রামীণ দুগ্ধচাষীদের কাছ থেকে ন্যায্যমূল্যে দুধ সংগ্রহ করে শহরের বাজারে বিক্রির জন্য দুগ্ধ কারখানা স্থাপন করে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ব্র্যাক তাদের গ্রাহকদের কাছে উচ্চমানের প্যাকেটজাত দুধের পাশাপাশি প্রক্রিয়াজাত এবং প্যাকেজযুক্ত দুগ্ধজাত পণ্য সরবরাহ করে আসছে। সারা দেশে ২৮ হাজারেরও বেশি নিবন্ধিত কৃষকদের কাছ থেকে তারা প্রতিদিন ২ লাখ ৫০ হাজার লিটার দুধ সংগ্রহ করে আড়ং ব্র্যান্ডের অধীনে দেশব্যাপী বিক্রি করছে। এছাড়া ব্র্যাক দেশব্যাপী খামারিদের গবাদি পশুর বিকাশ ও প্রযুক্তি প্রশিক্ষণ, ভ্যাকসিন, ফিড চাষের সুবিধা এবং অন্যান্য সেবা সরবরাহ করে চলছে।

২০০২ সালে ল্যান্ড ও লেকস, টেট্রা প্যাক এবং মার্কিন কৃষি বিভাগের সঙ্গে অংশীদারিত্বের মাধ্যমে প্রাণ কোম্পানি বাংলাদেশের স্কুলগুলোয় পরিচালিত পুষ্টি প্রোগ্রামে অতি উচ্চ তাপমাত্রায় পরিশোধিত ইউএইচটি দুধ বিতরণ শুরু করে। বর্তমানে প্রাণ বাংলাদেশের তৃতীয় বৃহত্তম ডেইরি কোম্পানি পরিচালনা করছে, যা তরল দুধের বাজারের প্রায় ১০ শতাংশ দখল করে আছে।

বর্তমানে দেশে শিক্ষিত বেকারদের কর্মসংস্থান ও নারীর ক্ষমতায়নে একটি সম্ভাবনাময় খাত হচ্ছে ডেইরি শিল্প। মিল্ক ভিটা, আড়ংয়ের মতো পরবর্তী সময়ে ডেইরি খাতে প্রাণ ডেইরি, ফার্ম ফ্রেশসহ প্রায় আটটি বড় কোম্পানি গড়ে উঠেছে। এছাড়া ব্যক্তিগত উদ্যোগেও প্রতিষ্ঠিত হয়ে চলেছে গবাদি পশু লালন-পালনের বাণিজ্যিক খামার। দেশে বর্তমানে এক লাখেরও বেশি নিবন্ধিত খামারি রয়েছেন, যার প্রায় অর্ধেকই উচ্চ শিক্ষিত যুবকদের উদ্যোগে পরিচালিত। পাবনা, সিরাজগঞ্জ, সাতক্ষীরা, কুড়িগ্রাম, নোয়াখালীসহ বিভিন্ন চরাঞ্চলে গড়ে উঠেছে বাথানবাড়ি। একসময় খামারিরা নিজেরা দুধ সংগ্রহ করে তা স্থানীয় ভোক্তার কাছে ঘরে ঘরে পৌঁছে দিয়ে আসতেন, ছিল না কোনো উন্নত প্যাকেজিং ব্যবস্থা। ফলে দুধের অপচয়ও হতো বেশি। নষ্ট হওয়া এড়াতে দুধ থেকে দই, ঘি, ছানা তৈরি করে বিক্রয় করা শুরু হয়। আবার মিষ্টান্ন প্রস্তুতিতেও বিভিন্ন মিষ্টির দোকানে দুধ আর ছানার চাহিদা রয়েছে। ডেইরি কোম্পানিগুলো গড়ে ওঠার পর খামারিরা পেয়েছে সুসংঘবদ্ধ হওয়ার সুযোগ, সেই সঙ্গে রক্ষা পেয়েছে দুধের গুণগত মান। ক্রমে  আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারে এসেছে পরিশোধন ব্যবস্থা, পাস্তুরিতকরণ, ম্যাটেরিয়ালে প্যাকেজিং ব্যবস্থা, দীর্ঘদিন সংরক্ষণ করে রাখার ব্যবস্থা, পর্যাপ্ত চিলিং স্টেশন ও উন্নত পরিবহন ব্যবস্থা। প্রাণ ও মিল্ক ভিটা গুঁড়ো দুধ তৈরির শিল্পও গড়ে তুলেছে। ফলে গুঁড়ো দুধ আমদানির চাহিদা কমার সঙ্গে সঙ্গে দেশীয় শিল্পে বিনিয়োগের সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে।

গত এক দশকে দেশে উৎপাদিত দুধের পরিমাণ প্রায় ৪ দশমিক ৫ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। একই সঙ্গে গবাদি পশুর মাংস উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় সাত গুণ। কোরবানির ঈদে নিজস্ব উৎপাদন দিয়েই গরুর চাহিদা মেটাতে সক্ষম হচ্ছি আমরা। দেশে দুধের মোট চাহিদার প্রায় দুই-তৃতীয়াংশই এখন দেশীয় উদ্যোক্তারা সরবরাহ করছেন। খামার ব্যবসায়ীদের মতে, উন্নয়নের এ ধারা অব্যাহত রাখতে সরকারের পাশাপাশি ডেইরি শিল্পসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান, যেমন দুগ্ধ খামারি, দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাত ও বিপণন প্রতিষ্ঠান, গবাদি পশুর কৃত্রিম প্রজননকারী প্রতিষ্ঠান, প্রাণিখাদ্য বাজারজাতকারী প্রতিষ্ঠান, বাণিজ্যিক ও বিশেষায়িত ব্যাংক, ব্যবসায়ী সংগঠন, গণমাধ্যম ও বেসরকারি সংস্থার সম্মিলিত উদ্যোগ জরুরি।


ড. মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম: অধ্যাপক, কৃষি ব্যবসা ও বিপণন বিভাগ, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়

আরও