বাজারজাতে মধ্যস্বত্বভোগীদের বিবর্তন

স্বাধীনতার জন্মলগ্ন থেকেই এ দেশ কৃষির ওপর নির্ভরশীল ছিল, ৮৫ শতাংশ জনসংখ্যা কৃষির ওপর নির্ভর করেই জীবিকা নির্বাহ করত। জীবিকা নির্বাহের কৃষির বৈশিষ্ট্যই ছিল যে এখানে উৎপাদন করা হতো পরিবারের খাদ্যচাহিদা মেটানোর জন্য। কখনো যদি উৎপাদিত পণ্য পারিবারিক চাহিদা মেটানোর পর উদ্বৃত্ত থাকত, তবেই তা বাজারে বিক্রি করা হতো। এ ধরনের কৃষিতে কখনই লাভ মুখ্য বিষয় ছিল না, এখানে যন্ত্রপাতির ব্যবহার প্রায় ছিল না বললেই চলে; সার, বীজ এসবের ব্যবহারও ছিল অল্প।

স্বাধীনতার জন্মলগ্ন থেকেই দেশ কৃষির ওপর নির্ভরশীল ছিল, ৮৫ শতাংশ জনসংখ্যা কৃষির ওপর নির্ভর করেই জীবিকা নির্বাহ করত। জীবিকা নির্বাহের কৃষির বৈশিষ্ট্যই ছিল যে এখানে উৎপাদন করা হতো পরিবারের খাদ্যচাহিদা মেটানোর জন্য। কখনো যদি উৎপাদিত পণ্য পারিবারিক চাহিদা মেটানোর পর উদ্বৃত্ত থাকত, তবেই তা বাজারে বিক্রি করা হতো। ধরনের কৃষিতে কখনই লাভ মুখ্য বিষয় ছিল না, এখানে যন্ত্রপাতির ব্যবহার প্রায় ছিল না বললেই চলে; সার, বীজ এসবের ব্যবহারও ছিল অল্প।

কৃষিপ্রধান বিপুল জনসংখ্যার ছোট দেশটিতে কৃষিই আয়, খাদ্য কর্মসংস্থানের আশ্রয়স্থল। বিভিন্ন প্রকার শস্য চাল, ডাল, গম, তেলবীজসহ নানা ধরনের গ্রীষ্মকালীন শীতকালীন শাকসবজি, ফল, মাছ, মাংস, ডিম, দুধ ইত্যাদি কৃষিপণ্য দেশের কৃষক খামারিরা উৎপাদন করে। দেশের কৃষি বিজ্ঞানীদের প্রচেষ্টায় কৃষিপণ্যের মনোন্নয়ন উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়ে চলছে ক্রমশ। ১৯৬০-৮০ সালের মধ্যে কৃষি গবেষণা, উন্নয়ন প্রযুক্তির ব্যবহারের ফলে একদিকে যেমন বেড়েছে উৎপাদন ঠিক তেমনি কৃষি জীবিকা নির্বাহের চেয়ে বাণিজ্যিক খাত হিসেবে বিবেচিত হয়েছে, কৃষিক্ষেত্রের পরিবর্তন গ্রিন রেভল্যুশন বা সবুজ বিপ্লব নামে পরিচিত। সবুজ বিপ্লবে কৃষিতে উচ্চফলনশীল জাতের বীজ, রাসায়নিক সার, সেচ, বিভিন্ন প্রযুক্তির ব্যবহার শুরু হয়েছিল। সবুজ বিপ্লব এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে তথা বাংলাদেশেও খাদ্য উৎপাদনকে - গুণ বৃদ্ধি করেছে, বিশেষ করে ধান গম উৎপাদনে। খাদ্যশস্যের পাশাপাশি অন্যান্য শস্য, ফল সবজি উৎপাদন উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্ধিত উৎপাদন পারিবারিক চাহিদা মিটিয়ে কৃষক যখন বাজারে বিক্রি করতে শুরু করল তখনই কৃষক লাভের অংশ পেতে শুরু করল এবং কৃষি জীবিকানির্ভর সেক্টর হতে লাভজনক বাণিজ্যিক সেক্টরে রূপান্তরিত হতে থাকল। এখন কৃষি অন্যান্য শিল্প খাতের মতো বিনিয়োগনির্ভর খাতে রূপান্তরিত হচ্ছে। বর্তমানে বাংলাদেশে জনসংখ্যার ৪০. শতাংশ কৃষির ওপর নির্ভর করে জীবিকা নির্বাহ করে। মূলত খাদ্য, আয়, কর্মসংস্থান জীবিকার জন্য দেশের জনসাধারণ কৃষির ওপর নির্ভর করে। তাই কৃষি দেশের অর্থনীতিতে বৃহত্তম উৎপাদনশীল খাত হিসেবে বিবেচিত।

খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করার পরও দেশে কৃষিতে এখনো নানাবিধ সমস্যা বিদ্যমান, যা কৃষকের উন্নয়নে বাধা হয়ে আছে আর ভোক্তাদেরও সেসব সমস্যার কারণে দুর্ভোগ মোকাবেলা করতে হচ্ছে। কৃষির উৎপাদন বেড়েছে, আয়ও বৃদ্ধি পেয়েছে তবুও কৃষি তুলনামূলকভাবে অলাভজনক ব্যবসা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। কৃষক তার উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য পাচ্ছে না। কারণ হিসেবে অনেকেই মধ্যস্বত্বভোগীদের কথা বলছে।

আমাদের দেশে কৃষি ব্যবসার বিকাশ কৃষিপণ্যের আধুনিকায়ন শুরু হয়েছে খুব বেশি দিন হয়নি। দেশের অধিকাংশ কৃষকই ক্ষুদ্র প্রান্তিক পর্যায়ের কৃষক। তাই তাদের সক্ষমতাও সীমিত। সরকারি বেসরকারি সহায়তা ছাড়া তাদের পক্ষে উৎপাদন থেকে শুরু করে বাজারজাতের প্রতিটি পর্যায়ের সুষ্ঠু পরিকল্পনা ব্যবস্থাপনা কঠিন। উৎপাদন পর্যায়ে নানা রকম ভর্তুকি প্রাপ্তি সরকার কর্তৃক কৃষকের কাছ থেকে ধান-চাল কিনে নেয়ার প্রক্রিয়া চালু থাকলেও অন্যান্য পর্যায়ে যেমনফসল সংগ্রহোত্তর সংরক্ষণ, প্রক্রিয়াকরণ, বাজারজাতের মাধ্যমে ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তি প্রভৃতি ক্ষেত্রে কৃষকদের নানাবিধ সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়, ফলে তারা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কৃষকরা ধারদেনা করে চক্রবৃদ্ধি হারের উচ্চসুদে ঋণের টাকা এনে নানা কৃষিপণ্য উৎপাদন করলেও যথাযথ সংরক্ষণ বাজারজাতের প্রয়োজনীয় সুযোগের অভাবে তারা ন্যায্যমূল্য পায় না। বিশেষত আমাদের দেশে প্রতি বছরই বিভিন্ন মৌসুমি শাকসবজির ক্ষেত্রে দেখা যায়, উৎপাদন মৌসুমে পণ্যের দাম কম থাকে এবং পরবর্তী সময়ে সেসব কৃষিপণ্য শহরাঞ্চলে চড়া দামে বিক্রি হয়। গ্রামাঞ্চলে উৎপাদিত কৃষিপণ্য কৃষকরা বেশি দিন মজুদ করে রাখতে পারে না। এক্ষেত্রে কৃষকরা তাদের পণ্যের ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হয়। নিচু এলাকা চরাঞ্চলের হাজার হাজার একর জমিতে প্রতি বছর উৎপাদিত শত শত কোটি টাকার মৌসুমি ফল শাকসবজি নষ্ট হয়। প্রতি বছর শত শত কোটি কোটি টাকার আম, জাম, কাঁঠাল, লিচু, তরমুজসহ নানা জাতের মৌসুমি জাতের ফল প্রচুর উত্পন্ন হয়। কিন্তু অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে কৃষকরা তাদের উৎপাদিত পণ্য যথাসময়ে বাজারজাত করতে পারে না। পরিস্থিতিতে কৃষকরা আর্থিক ক্ষতির ভারে দিন দিন কৃষির ওপর থেকে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে।

আমাদের দেশে এই মধ্যস্বত্বভোগী শ্রেণী অনেকটাই সুসংগঠিত। তাদের গুরুত্বও কোনোভাবেই উপেক্ষা করা যায় না। তার প্রধান কারণ হচ্ছে আমাদের দেশের কৃষক শ্রেণী অত্যন্ত দুর্বল অসংগঠিত। তাদের অধিকাংশই ক্ষুদ্র প্রান্তিক চাষী। তাদের রয়েছে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের অভাব, অর্থনৈতিকভাবে তারা সবসময়ই দুর্বল শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত। তাদের নেই কোনো সুসংগঠিত প্লাটফর্ম, পর্যাপ্ত সংরক্ষণাগার পরিবহন ব্যবস্থা। এসব কারণে কৃষক উৎপাদক শ্রেণী সর্বদাই তাদের পণ্য বাজরজাতে মধ্যস্বত্বভোগীদের ওপর নির্ভরশীল হতে হয়। কথা স্বীকার করতেই হবে যে মধ্যস্বত্বভোগীদের অনুপস্থিতিতে আমাদের বাজার ব্যবস্থা পরিচালনা করা অসম্ভব, যদি না তাদের বিকল্প কোনো মাধ্যম বা ব্যবস্থা গড়ে তোলা যায়। যেমন আমাদের দেশে এখনো কোল্ড স্টোরেজের সংখ্যা অনেক কম। বিশেষ করে সবজির মতো পচনশীল পণ্য স্টোরেজ করার পর্যাপ্ত অবকাঠামো নেই। সরকারি স্টোরেজ থাকলেও চাহিদার তুলনায় অনেক কম। স্টোরেজ করার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা থাকলে কৃষক পণ্য ধরে রেখে পরে বিক্রি করতে পারত। এতে কৃষক লাভবান হতো। যেহেতু পর্যাপ্ত পণ্য স্টোরেজের সুযোগ নেই, তাই মধ্যস্বত্বভোগীদের সহায়তায় দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা ক্ষুদ্র প্রান্তিক কৃষকরা তাদের পণ্য সংরক্ষণ পরিবহনের মাধমে সারা দেশে সরবরাহ তথা বিক্রির সুযোগ নিতে হয়। কিন্তু অনেকসংখ্যক মধ্যস্বত্বভোগীদের মাঝে লভ্যাংশের বণ্টন, তাদের মাঝে থাকা অসাধু ব্যবসায়ীদের কর্তৃক অতিরিক্ত মুনাফা লাভে কৃষকদের কম মূল্য পরিশোধ স্থানীয় বাজারে চাপ সৃষ্টি এবং যোগাযোগ ব্যবস্থাপনায় চাঁদাবাজদের কারণে বাজারে কৃষিপণ্যের মূল্য নিয়ে অস্থিতিশীলতা কৃষকদের ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তিতে বড় বাধা সৃস্টি করছে, সেই সাথে বাড়ছে ভোক্তাদের দুর্ভোগ।

করোনা পরিস্থিতিতে বাজারজাত সংকট আরো পরিষ্কারভাবে উঠে এসেছে। এছাড়া গত বছরও পেঁয়াজের বাজারের আগুন বছরে মরিচের বাজারে অতিরিক্ত ঝাল আবারো আমাদের জানান দিয়েছে যে এখনই দেশের নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকে শুরু করে কৃষকের হাট পর্যন্ত প্রতিটি স্তরে কৃষিপণ্যের বিপণন বাজারজাত সম্পর্কিত সমস্যা চিহ্নিতকরণ সমাধানে বাস্তবসম্মত, প্রায়োগিক যুগোপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণ না করলে কৃষক কৃষির সামগ্রিক উন্নয়ন অধরাই রয়ে যাবে।

কৃষিপণ্য বাজারজাতের সমস্যাগুলো সমাধানের উপায় হিসেবে যে বিষয়গুলোর ওপর বিশেষভাবে জোর দিতে হবে তার মধ্যে প্রধান হচ্ছে ফসল সংগ্রহোত্তর অপচয়রোধ মানসম্পন্ন পণ্য সরবরাহ করা। দেশের প্রতিটি জেলায় পর্যাপ্তসংখ্যক কৃষিপণ্য সংগ্রহাগার আধুনিক হিমাগার গড়ে তোলার উদ্যোগ নিতে হবে। কৃষিপণ্য সংগ্রহোত্তর প্রযুক্তি যেমনফসল সংগ্রহ পদ্ধতি, শর্টিং, গ্রেডিং, সংরক্ষণ, প্যাকেজিং, পরিবহন, গুণগত মান বজায় রাখা, প্রক্রিয়াকরণ এবং বিপণন কৌশলের ওপর প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কৃষক ব্যবসায়ীদের দক্ষ করে গড়ে তোলা। আর এক্ষেত্রে শুধু সরকারি নয়, বেসরকারি উদ্যোক্তা ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানগুলোতে নিজ নিজ তাগিদে এগিয়ে আসতে হবে।

উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা পরিবহন ব্যবস্থার সমস্যা সমাধানের পাশাপাশি গ্রাম, উপজেলা শহরের কৃষি বাজারগুলোর ভৌত অবকাঠামোগত সমস্যা সমাধানের পাশাপাশি গ্রাম, উপজেলা শহরের কৃষি বাজারজাতের উন্নয়ন সাধন করা। যেমন পণ্য রাখার জন্য প্লাটফর্ম, ওয়াশিং রুম, শর্টিং, গ্রেডিং, ড্রাইং রুম, স্টোর রুম, কুল হাউজ, পণ্য পরিমাপের সরঞ্জাম, ট্রেনিং রুম স্থাপন, ফল-মূল শাকসবজি পরিবহনের জন্য কুলিং ভ্যান সহজলভ্যকরণ বাজারের পাশে লোডিং-আনলোডিং পয়েন্ট স্থাপন করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করতে হবে।

ফসল উৎপাদনে আগ্রহী এবং সরাসরি বাজারজাতের মাধ্যমে মধ্যস্বত্বভোগীদের অপ্রয়োজনীয় প্রভাব কমানো সম্ভব। আবার চুক্তিভিত্তিক চাষাবাদ পদ্ধতিতে কৃষক ব্যবসায়ীদের যেমন সুপারশপ, রফতানিকারক প্রক্রিয়াজাতকারক বাজার সংযোগ তৈরি করা গেলে অপ্রয়োজনীয় প্রভাব ন্যূনতম পর্যায়ে নিয়ে আসা সম্ভব। এছাড়া প্রক্রিয়ায় উৎপাদিত কৃষিপণ্যের ওপর ভিত্তি করে প্রক্রিয়াকরণ শিল্প স্থাপন প্রক্রিয়াকরণ পণ্য রফতানির সুযোগও ত্বরান্বিত হবে।

মধ্যস্বত্বভোগীদের উপস্থিতি কমাতে হলে উৎপাদক ভোক্তা শ্রেণীর মাঝে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপনের এমন ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে উভয় পক্ষই লাভবান হতে পারে। এজন্য গ্রামীণ উৎপাদক শ্রেণীর কাছ থেকে পণ্য সেবা সরাসরি ক্রয়ের ব্যবস্থা করা গেলে সমস্যার সমাধান হতে পারে, এমন ধারণাকেই প্রাধান্য দেয়া হয়। ধারণাকে কেন্দ্র করে কৃষি বিপণন অধিদপ্তর কর্তৃক নর্থ ওয়েস্ট ক্রপ ডাইভারসিফিকেশন প্রজেক্ট সাউথ ওয়েস্ট ক্রপ ডাইভারসিফিকেশন প্রজেক্টের মাধ্যমে কৃষকের মাঠ থেকে সরাসরি পণ্য রাজধানী রাজশাহীর খুচরা বাজারে বিক্রির প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবে ধারণা কাজে আসেনি। সেখানে দেখা গেছে, কৃষকদের পণ্যের চেয়ে বাজারে পণ্যের দাম তুলনামূলক কম। আবার উন্নত দেশগুলোর অনুকরণে যদি দেশের বড় বড় কোম্পানি বড় পরিসরে বিনিয়োগ করে সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে পণ্য কিনে খুচরা বাজারে বিক্রি করার ব্যবস্থা গড়ে তোলে, তাহলেও স্থানীয় ব্যবসায়ীদের একচেটিয়া প্রাধান্য ভেঙে নতুন বাজার ব্যবস্থাপনা সৃষ্টি করার সুযোগ তৈরি করা যাবে।

কৃষকদের কালেক্টিভ প্রচেষ্টার মাধ্যমে আধুনিক পদ্ধতিতে ফসল উৎপাদন বাজারজাত করার প্রক্রিয়াকে উদ্বুদ্ধ সহায়তা প্রদান করতে হবে। ধরনের উদ্যোগ কার্যকরী করতে হলে প্রয়োজন প্রচেষ্টার সাথে সরকারি উদ্যোগ একীভূত করা। সরকারি উদ্যোগে প্রতিটি ইউনিয়নে একটি করে ক্রয়কেন্দ্র খোলা যেতে পারে। গ্রামীণ উৎপাদক শ্রেণী তাদের উৎপাদিত পণ্য সরাসরি এসব ক্রয়কেন্দ্রে নিয়ে আসবে। অথবা মাঠ পর্যায়ে চাষীদের কৃষিপণ্য বিক্রয় কালেক্টিভ প্রচেষ্টার মাধ্যমে করা যেতে পারে। কালেক্টিভ ব্যবস্থাপনায় পণ্য পাইকারি বাজারে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করা গেলে তা ফলদায়ক হবে। সেখান থেকে সরকারি কর্মকর্তাদের তদারকিতে শহরে চালান করা সম্ভব হলে কৃষক বা উৎপাদক শ্রেণী সঠিক মূল্যে তাদের উৎপাদিত পণ্য বিক্রি করার সুযোগ পাবে, আর শহরের ভোক্তা শ্রেণী ন্যায্যমূল্যে পণ্য ক্রয় করে ভোগ করার সুযোগ পাবে। এছাড়া কৃষি উৎপাদনে কালেক্টিভ প্রচেষ্টার ভিত্তিতে কৃষি উপকরণ সরবরাহ, উৎপাদিত ফসল সংরক্ষণ বাজারজাতের ব্যবস্থা করলে নিশ্চিত হবে খাদ্যোৎপাদন এবং নিশ্চিত করা যাবে খাদ্যনিরাপত্তা।

বর্তমানে অনলাইনের মাধ্যমে রাজধানীতে পণ্যের মূল্য সম্পর্কে কৃষকদের অবহিত করার ব্যবস্থা চলমান রেখে পণ্য বিক্রির নতুন নতুন উদ্যোগ সৃষ্টি করা হয়েছে। যেমন কৃষিপণ্য বাজারজাতে অনলাইন প্লাটফরম ফুড ফর ন্যাশন-এর অভিযাত্রা হয়েছে। উন্মুক্ত কৃষিপণ্য প্লাটফরমের উদ্দেশ্য হলো দেশের খাদ্যশস্য কৃষিপণ্যের সঠিক বিপণন, ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতকরণ, চাহিদা মোতাবেক সহজলভ্যতা তৈরি এবং জরুরি অবস্থায় খাদ্য সরবরাহ চেইন অব্যাহত রাখা। এতে ক্রেতা বিক্রেতার মধ্যে এক ধরনের সরাসরি সংযোগ স্থাপিত হয়েছে। ফলে কৃষক এখান থেকে পণ্যের ন্যায্যমূল্য পাবে বলে আশা করা যাচ্ছে। পাশাপাশি ভোক্তারা তাদের চাহিদা মোতাবেক সহজে, স্বল্প সময়ে সঠিক মূল্যে প্রয়োজনীয় কৃষিপণ্য কিনে ভোগ করতে পারবে।

এছাড়া করোনার লকডাউন সময়ে প্রান্তিক কৃষকের উৎপাদিত পণ্য ঢাকায় পাইকারি বাজারে বিনা মাশুলে পৌঁছে দিতে কৃষক বন্ধু ডাক সেবা চালু করেছিল ডাক অধিদপ্তর। প্রাথমিকভাবে মানিকগঞ্জ জেলার কৃষকদের উৎপাদিত শাকসবজি বিনা মাশুলে পরিবহনের মধ্য দিয়ে সেবাটি চালু করা হয়েছিল। সেবার আওতায় ডিজিটাল প্লাটফর্মের মাধ্যমে কৃষক ঘরে বসেই তার বিক্রয়লব্ধ পণ্যের টাকা পাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। ফলে কোনো মধ্যস্বত্বভোগী ছাড়াই কৃষক তার উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য পেতে পারত। ধরনের উদ্যোগ সারা দেশে সফলভাবে চালু রাখা গেলে কৃষিপণ্যের বাজার ব্যবস্থার অনেক সমস্যাই সমাধান করা সম্ভব হবে।

এমন প্রচেষ্টার পাশাপাশি আধুনিক প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে স্থানীয় পর্যায়ে ডিজিটাল তথ্যকেন্দ্র তৈরি করা যেতে পারে, যে তথ্যকেন্দ্রগুলোতে স্থানীয় যুবকদের সাহায্য নিয়ে অথবা উপজেলা পর্যায়ের কৃষি কর্মকর্তাদের সহায়তায় কৃষকদের পণ্যের বিজ্ঞাপন দেয়া এবং ওয়েবসাইট ব্রাউজিং প্রক্রিয়ার নির্দেশনা প্রদান করবে। তথ্যকেন্দ্রে থাকা একটি বড় কম্পিউটার স্ক্রিনে কৃষকরা সহজে বর্তমান পণ্যের চাহিদা জানতে পারবে, বাজারের দৈনিক দরের আপডেট দেখতে পারবে এবং সহজে পণ্য বাজারজাত করতে পারবে।

এছাড়া কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য নির্ধারণ কৃষক-উৎপাদক শ্রেণীর স্বার্থ সংরক্ষণে দৈনিক পত্রিকাগুলোতে, রেডিও, টিভি চ্যানেল, ইন্টারনেট মোবাইলে প্রতিদিনের কৃষিপণ্যের বাজার তথ্য সম্প্রচার ব্যবস্থা চালু করা যেতে পারে। দৈনিক বাজারদর কৃষকদের জানা থাকলে তারা ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হওয়ার সম্ভাবনা কমে আসবে। কৃষিপণ্যের ক্রয়-বিক্রয়মূল্য-বাজার অনুপাতে ঠিক রাখতে এবং ক্রেতার সন্তুষ্টি বিশ্বাস অর্জন করতে বাজার ব্যবস্থার দৈনিক মনিটরিং তথ্য সরবরাহ ব্যবস্থাকে জোরদার করতে হবে। কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে উপযুক্ত পরিবেশ তৈরিতে অনলাইন মার্কেটিংয়ের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে কৃষিপণ্য বিক্রির ব্যবস্থা করা এবং কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের আরো কার্যকর ভূমিকার মাধ্যমে উৎপাদন এলাকায় পাইকার বা বড় ক্রেতাকে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করতে পারলে তা ফলপ্রসূ ভূমিকা রাখবে।

সর্বোপরি, ব্যবসায়িক পরিকল্পনা করা এবং বাজার চাহিদা অনুযায়ী কৃষিপণ্য উৎপাদন করা, কৃষি উপকরণ ঋণ সহজলভ্য করা এবং সব বাণিজ্যিক ব্যাংকে কৃষিঋণের সুবিধা বৃদ্ধি, কৃষিপণ্য পরিবহনে গুণগত কাঠামোগত উন্নয়ন আনয়নের মাধ্যমে কৃষিপণ্যের উৎপাদন, সংরক্ষণ, প্রক্রিয়াকরণ, পরিবহন বিপণন সম্পর্কিত সমস্যা সমাধান করা সম্ভব হবে বলে আশা করছি।

মধ্যস্বত্বভোগীর দৌরাত্ম্য কমাতে হবে। পুরোপুরি মধ্যস্বত্বভোগীবিহীন বাজার ব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব নয়। যেটা সম্ভব সেটা হচ্ছে এদের সংখ্যা দৌরাত্ম্য কমিয়ে আনতে উপযুক্ত কার্যকর ব্যবস্থা গড়ে তোলা, যাতে উৎপাদক তথা কৃষকের স্বার্থ ভোক্তার স্বার্থ রক্ষা করা সম্ভব হয়। সেক্ষেত্রে যেসব মধ্যস্বত্বভোগী ছাড়া পণ্য সরবরাহ শৃঙ্খল অসম্পূর্ণ তাদের সঠিক ভূমিকা পালন মূল্যায়নের সুযোগও সৃষ্টি হবে।

 

ড. মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম: অধ্যাপক, কৃষি ব্যবসা বিপণন বিভাগ, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়

আরও