পাহাড়ি সাজেকে রুইলুই ও কংলাক নামে দুটি বসতি বা পাড়া আছে। এখানে লুসাই, পাংখোয়া ও ত্রিপুরা জাতিগোষ্ঠীর বাস। প্রকৃতির মতো সুন্দর পাহাড়ের এ সহজ-সরল মানুষের সংগ্রামী জীবন থেকে হয়তো অনেক কিছু শেখার আছে
যত দূর দৃষ্টি যায়, চারদিকে কেবল সবুজ আর সবুজ। ছোট-বড় সবুজ পাহাড়ের সঙ্গে ধবধবে সাদা তুলার মতো মেঘ যেন আটকে আছে। দেশের মধ্যে পর্যটনের নৈসর্গিক এক নাম সাজেক। এটি রাঙ্গামাটির বাঘাইছড়ি উপজেলার একটি ইউনিয়ন। সাজেক থেকে রাঙ্গামাটির অনেকটা অংশ দেখা যায় বলে একে বলা হয় ‘রাঙ্গামাটির ছাদ’। পাহাড়ি সাজেকে রুইলুই ও কংলাক নামে দুটি বসতি বা পাড়া আছে। এখানে লুসাই, পাংখোয়া ও ত্রিপুরা জাতিগোষ্ঠীর বাস। প্রকৃতির মতো সুন্দর পাহাড়ের এ সহজ-সরল মানুষের সংগ্রামী জীবন থেকে হয়তো অনেক কিছু শেখার আছে।
সাজেক থেকে ভারতের লুসাই পাহাড় দেখা যায়। সাজেকের পূর্বে ভারতের মিজোরাম, উত্তরে ত্রিপুরা রাজ্য, পশ্চিমে খাগড়াছড়ির দীঘিনালা এবং দক্ষিণে রাঙ্গামাটির লংগদু।
এমন সৌন্দর্য উপভোগ করতেই গত বছরের ১ নভেম্বর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের মাস্টার্সের শিক্ষার্থীদের যাত্রা শুরু হয়। উদ্দেশ্য সাজেক, কক্সবাজার ও সেন্ট মার্টিন ভ্রমণ। রাজশাহী থেকে রাতের বেলা তেপান্তরী মাঠ পেরিয়ে ফেনীর দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। পথে একবার ৩০ মিনিটের বিরতির পর রাতের প্রকৃতি দেখতে দেখতে ভোর সাড়ে ৫টায় ফেনীতে পৌঁছাই। ফেনী থেকে শান্তি পরিবহনের বাসে করে চট্টগ্রামের মিরসরাই হয়ে খাগড়াছড়ির উদ্দেশে যাত্রা।
রাস্তার দুই ধারে প্রথম পাহাড়ের ছোঁয়া পেলাম চট্টগ্রামে। উঁচু-নিচু পাহাড় পাড়ি দিয়ে আমরা খাগড়াছড়িতে পৌঁছালাম সকাল সাড়ে ৮টায়।
খাগড়াছড়ি থেকে সাজেকের পথে
খাগড়াছড়িতে নাশতা করে ‘চাঁদের গাড়ি’ করে দীঘিনালা সেনানিবাসে পৌঁছাই সকাল ১০টার দিকে। খাগড়াছড়ি থেকে দীঘিনালার দূরত্ব ২৩ কিলোমিটার। সেখান থেকে আমাদেরকে সেনাবাহিনীর এসকোর্টে যেতে হয়। দীঘিনালা থেকে সেনাবাহিনীর এসকোর্ট শুরু হয় সকাল সাড়ে ১০টায় ও বেলা সাড়ে ৩টায়। সাম্প্রতিক সময়ে পাহাড়ে কিছু অপ্রীতিকর ঘটনার পর নিরাপত্তার স্বার্থে সেনাবাহিনীর এ পদক্ষেপ। তাই ওই সময়ের আগেই পৌঁছে যেতে হবে খাগড়াছড়ি থেকে দীঘিনালায়। না হলে একবার সকালের এসকোর্ট মিস করলে আবার তা পেতে অপেক্ষা করতে হবে বিকাল পর্যন্ত। ঠিক সময়ে পৌঁছাতে পারা নিয়ে চিন্তা হচ্ছিল, তবে সঠিক সময়েই আমরা পৌঁছে যাই ক্যাম্পে।
ক্যাম্প থেকে চাঁদের গাড়িতে সাজেক ভ্যালির দিকে উঁচু-নিচু পাহাড়ের বুক চিরে এগিয়ে চললাম। ঘন সবুজ পাহাড়ের মাঝে কালো পিচঢালা পথ, সর্পিল আঁকাবাঁকা। কোথাও কোথাও পাহাড়ের উচ্চতা এত বেশি যে, উপরে উঠতে গাড়ির ত্রাহি অবস্থা, যেন দম ফুরিয়ে যাওয়ার উপক্রম। পাহাড়ের সৌন্দর্য দেখতে গাড়িতে কয়েকজন দাঁড়িয়ে গেলাম। ‘চাঁদের গাড়ি’র ছাদ থেকে মনে হচ্ছিল এ যেন রোলার কোস্টার। এক পাহাড় থেকে নেমে তীব্র গতিতে উঠতে হচ্ছে আরেক পাহাড়ে। দুই পাশে তাকালে চোখে পড়ে কেবল সবুজ আর সবুজ। দিগন্তজোড়া পাহাড় আর সবুজের সমারোহ।
পথে চলতে চলতে সড়কের দুই পাশে দেখলাম নৃগোষ্ঠীর বসবাস। বিশেষভাবে বাঁশের মাচানের ওপর তৈরি করা বাড়িঘর। প্রশস্ত পরিচ্ছন্ন বাঁধানো পথঘাট, বাঁশ, কাঠের উপকরণাঢ্য পরিপাটি বাড়িঘর, কিন্তু সবগুলো বাড়িঘর একই ধাঁচের, একেবারে হুবহু, যেন ছাঁচে ঢালা সিসার টাইপ। আর রাস্তার পাশে পিচ্চি বাচ্চারা হাত নেড়ে নেড়ে যেন স্বাগত জানাচ্ছিল আমাদেরকে।
সাজেকে পৌঁছানো
অবশেষে সাজেকে পৌঁছাতে দুপুর প্রায় ১টা। আগে থেকে কটেজ ঠিক করা ছিল আমাদের। কটেজটাও খুব সুন্দর। সেখান থেকে চারদিকে সবুজের সমারোহ দেখা যাচ্ছিল। চোখ জুড়ানো সবুজ আর নির্মল বাতাসে মুহূর্তেই সব ক্লান্তি দূর হয়েছিল। সবাই অল্প বিশ্রাম নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম খাবারের সন্ধানে। সাজেকে নৃগোষ্ঠী ও বাঙালি দুই রকমের হোটেলে খাবারের ব্যবস্থা আছে। আমরা ‘পেদা টিং টিং’ নামক হোটেলে খেতে বসলাম। সেখানে নৃগোষ্ঠীদের খাবার ব্যাম্বু চিকেনের স্বাদ নিলাম। আর সবগুলো সবজিতেই একটি সাধারণ উপাদান হলো ব্যাম্বু। তবে মুরগি ছাড়া ডিম, ডাল, ভর্তাসহ অন্যান্য নন-ভেজ খাবারও পাওয়া যায় সাজেকে। খাবারগুলো বেশ সুস্বাদু। খাওয়া শেষে হোটেল মালিককে জিজ্ঞেস করলাম ‘পেদা টিং টিং’-এর বাংলা অর্থ কী? তিনি বললেন, এর অর্থ ভরপেট খাও। হোটেলে খাওয়া শেষে আমরা চায়ের দোকানে গেলাম। সেখানে আমরা ব্যাম্বু চা খেলাম। এ চায়ের বিশেষত্ব হলো বাঁশের কাপে এক ধরনের চা।
রুইলুই পাড়া ও তাদের সংস্কৃতি
খাওয়া শেষে সাজেকের আশপাশের দোকানগুলো ঘুরে দেখতে লাগলাম। জানতে পারলাম এ গ্রামের নাম রুইলুই পাড়া। যা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১ হাজার ৭২০ ফুট উঁচুতে অবস্থিত। আর এ গ্রামের বেশির ভাগ মানুষ ত্রিপুরা ও লুসাই। এখানকার বেশির ভাগ দোকানিই দেখলাম মেয়ে। এ অঞ্চলের মেয়েদের পোশাক, পরিচ্ছদ পরিপাট্য ও কাপড় পরার মধ্যে বাঙালিদের সঙ্গে বিশেষ পার্থক্য রয়েছে। তবে আমাকে একটা বিষয় খুব মুগ্ধ করেছে। তা হলো এ অঞ্চলের মেয়েদের দেহের তনুত্ব ও মুখের সৌকুমার্য। তাদের সবার চেহারা ও উচ্চতা প্রায় একই। একের সঙ্গে অন্যের অমিল যেমন স্পষ্ট, তেমনি মিলও খুব স্পষ্ট।
সাজেকে রবি ও টেলিটক ছাড়া অন্য অপারেটরের নেটওয়ার্ক নেই। এ সিম না থাকায় প্রকৃতি ছাড়া বাইরের কোনো পৃথিবীর সঙ্গে যান্ত্রিক যোগাযোগ থাকল না। ফলে প্রকৃতিকে আরো ভালো করে উপভোগ করার আরেকটু সুযোগ পেলাম আমি। এছাড়া সাজেকে কোনো বিদ্যুৎ সংযোগ নেই, সবকিছু চলে সোলার পাওয়ারে।
কংলাক পাহাড়ে সূর্যাস্ত
বিকালে চাঁদের গাড়িতে করে রওনা দিলাম কংলাক পাহাড়ের উদ্দেশে। লক্ষ্য সূর্যাস্ত দেখা। পাহাড়টি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১ হাজার ৮০০ ফুট উঁচুতে। রুইলুই পাড়া থেকে ২০ মিনিটের মধ্যে আমরা কংলাকপাড়ায় পৌঁছালাম। পাহাড়ে ওঠার জন্য বাঁশের লাঠি কিনলাম, যাতে সুবিধা হয়। পাহাড়ে উঠতে একটু কষ্ট হলেও যখন এর সর্বোচ্চ উঁচুতে পৌঁছালাম, তখন আনন্দে লাফ দিতে ইচ্ছে করছিল। এত সুন্দর দৃশ্য! যতদূর চোখ যায় ছোট-বড় শুধু পাহাড় আর পাহাড়! সবুজের সমারোহ। নিঃশব্দ প্রকৃতি। মাঝে মধ্যে মনে হয় এতটা নিস্তব্ধতা কি স্বাভাবিক না সুন্দর? গোধূলির লাল রঙের নীলাভ আকাশ এতটা মায়াচ্ছন্ন করেছিল আমাকে যে, চোখ ফেরাতে পারছিলাম না। সে আকাশ এতই নীল আর এত সুন্দর যে, চাতকের মতো দিবারাত্র অনিমেষ চেয়ে থেকে সাধ মেটে না, মনে হয় এ এক মহার্ঘ বিলাসিতা, শুধু এর জন্যই এতদূর সীমানা পাড়ি দিয়ে বারবার আসা যায়। এত সুন্দর আমাদের বাংলাদেশ। চিত্কার করে সৃষ্টিকর্তাকে বলতে ইচ্ছে করে, ‘না
চাহিতে মোরে যা করেছ দান, আকাশ আলোক তনু মন প্রাণ।’
পাহাড় থেকে নেমে আসতে আসতেই সন্ধ্যা নামে। তখন আরেক অপরূপ দৃশ্যের সৃষ্টি হয়। মেঘমুক্ত নীল আকাশে একটু একটু করে অন্ধকারে আচ্ছন্ন হয়ে যাচ্ছে, আর মিটিমিটি করে জ্বলে উঠছে একটি দুটি তারা। সেখান থেকে হ্যালিপ্যাডে পৌঁছাতে পৌঁছাতেই অল্প কিছুক্ষণের মধ্যে একটি-দুটি থেকে সহস্র তারা চোখের সামনে জ্বলজ্বল করে উঠল। সন্ধ্যার তারাভরা আকাশ দেখতে দেখতে মৃদুমন্দ হাওয়ায় চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে হূদয়ে যে অনুভূতি এসেছে, সেটাই ভ্রমণের বড় আনন্দ।
মেঘের রাজ্যে সূর্যোদয়
পরদিন খুব সকালে ঘুম থেকে উঠলাম। সূর্যোদয় দেখব বলে এত সকালে ওঠা। রুমের দরজা খুলে বারান্দায় গিয়ে নিজের চোখকেই বিশ্বাস হচ্ছিল না। চারদিকে সারি সারি পাহাড় আর মাঝে মধ্যে ধবধবে সাদা তুলার মতো মেঘমালা। যতদূর চোখ যায়, শুধু তুলার মতো মেঘ পাহাড়ে ভেসে বেড়াচ্ছে। মনে হচ্ছে পায়ের নিচ দিয়ে মেঘ সুড়সুড়ি দিয়ে যাচ্ছে। আর হাত দিয়ে এসব মেঘ স্পর্শ করা যাবে। এ যেন এক টুকরো স্বর্গ! মেঘের ভেলায় নিজেকে ভাসিয়ে নিতে পারলে আরো ভালো লাগত। তাড়াহুড়ো করে চলে গেলাম হ্যালিপ্যাডে সূর্যোদয় দেখতে। নীলাভ আকাশে সাদা মেঘ ভেদ করে লালচে সূর্য উঁকি দিচ্ছে ধীরে ধীরে। সবুজাভ প্রকৃতি আর সূর্যের আলোয় এক ধরনের খেলা চলছে মনে হলো। বেলা যতই বাড়তে থাকল, মেঘের ভেলা ধীরে ধীরে ততই কমতে লাগল। সেখান থেকে আমরা সকালের নাশতা সেরে আবার ১০টার দিকে চাঁদের গাড়িতে রওনা দিলাম পরবর্তী গন্তব্যস্থলের দিকে।
ইয়াজিম পলাশ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
ছবি: মোল্লা মোহাম্মদ সাঈদ