ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সৌন্দর্যের তীর্থস্থান

ভুটান যেন এক সুখস্বপ্ন

লোকমুখে শুনেছি সুখী মানুষের দেশ ভুটান। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে অনন্য এ ছোট্ট দেশ আমাদের শেখায় বেঁচে থাকার মানে। এখানে মানুষে মানুষে কোনো ভেদাভেদ নেই। সবাই পরিশ্রমী ও অতিথিপ্রিয়। দেশের রাজা থেকে সাধারণ মানুষ, সবার একটাই উদ্দেশ্য। তা হলো, আনন্দে থাকা-সুখে থাকা। ভুটানের অধিকাংশ শহরের নাম নদীর নামে।

লোকমুখে শুনেছি সুখী মানুষের দেশ ভুটান। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে অনন্য ছোট্ট দেশ আমাদের শেখায় বেঁচে থাকার মানে। এখানে মানুষে মানুষে কোনো ভেদাভেদ নেই। সবাই পরিশ্রমী অতিথিপ্রিয়। দেশের রাজা থেকে সাধারণ মানুষ, সবার একটাই উদ্দেশ্য। তা হলো, আনন্দে থাকা-সুখে থাকা। ভুটানের অধিকাংশ শহরের নাম নদীর নামে।

পরিকল্পনা অনুযায়ী আমরা চারজনের দল সড়কপথে ভারত সীমানা দিয়ে ভুটান ভ্রমণের জন্য প্রয়োজনীয় ট্রানজিট ভিসা নিয়ে রওনা হই। সীমান্তে ইমিগ্রেশন শেষ করে ভুটানের ভারত সীমান্তঘেঁষা শহর ফুন্টশেলিং প্রবেশমুখে লোহার বিশাল একটি ড্রাগন যেন আমাদের স্বাগত জানায়। ইমিগ্রেশন অফিস থেকে দ্রুত অন-অ্যারাইভাল ভিসা নিয়ে রওনা হই রাজধানী থিম্পুর উদ্দেশে। গাড়ি কিছুদূর এগোতেই চারপাশের সুবিশাল পাহাড় মেঘেদের সংগম দেখে মনে মুগ্ধতা বাড়তে থাকে। দুই পাশে সারি সারি সবুজ পাহাড়ের মাঝখানে পিচঢালা চওড়া মসৃণ রাস্তা। ভুটানের সর্বত্রই রাস্তাঘাট রকম, কোথাও একটা পাতা পড়ে থাকতে দেখা যায় না। যাহোক, মাত্র চার কিলোমিটার ব্যবধানেই ভুটানযাত্রার প্রথম ব্রেক। হাজার ৫০০ ফুট উচ্চতায় খারবন্দি পাহাড়ের ওপর গোয়াবাড়ি টিলা, টিলার ওপর বর্তমান রাজার পিতামহীর তৈরি চমৎকার একটি বৌদ্ধ গুম্ফা। ২০ ফুট উঁচু পদ্মসম্ভবার মূর্তি রয়েছে এখানে। পাশেই খারবন্দি চেকপোস্ট। বিদেশীরা বিনা অনুমতিতে পর্যন্ত আসতে পারেন।


চারপাশের সুউচ্চ পাহাড় মেঘেদের ভেসে বেড়ানো দেখতে দেখতে আমরা এগিয়ে চলি। এভাবে দুপুর গড়িয়ে সূর্য তখন পশ্চিমে ঢলেছে, আমাদের স্বাগত জানালওয়েলকাম টু থিম্পুলেখা বিশাল তোরণ। বোঝা গেল আমরা থিম্পু শহরে প্রবেশ করছি। এখানেও আরেক প্রস্থ চেকিংয়ের মুখে পড়লাম। বাংলাদেশ থেকেই থিম্পুতে থাকার জন্য রুম বুক করা ছিল। শহর থেকে খানিকটা দূরে একটি কলেজের রেস্ট হাউজে গিয়ে উঠি। এটি ভুটানের প্রথম প্রাইভেট কলেজ, আন্তর্জাতিক মানের। রেস্ট হাউজে রাতের খাবার খেয়ে হিমাংক তাপমাত্রায় পুরো কলেজ ক্যাম্পাস ঘুরে দেখলাম। সবকিছু সাজানো-গোছানো। পরদিন ভোরে রুমের দরজা খুলতেই উত্তর দিকের দূর পাহাড়ের পাদদেশে ভুটানের বৌদ্ধ মন্দিরে চোখে পড়ল। পুব আকাশে সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে বরফাবৃত পাহাড়ের সোনালি আভায় প্রকৃতি যেন আরো অনন্য হয়ে উঠেছে।

ভুটান ভ্রমণে ছয়দিনের জন্য আমরা একটি প্রাইভেট ট্যাক্সি ভাড়া নিলাম। প্রথমেই গেলাম দেশটির প্রধান জং দেখতে। কী অসাধারণ সুন্দর! মুগ্ধ করার মতো স্থাপত্য সৌন্দর্য। এটির নাম তাশি চো জং। অতীতের বৌদ্ধ বিহারকে সংস্কার করে ১৬৪১ সালে এই বিশাল দুর্গটি গড়ে তোলা হয়েছে। বর্তমানে এটি ভুটান সরকারের সচিবালয়। এরপর নরজিন ল্যাম, টিভি টাওয়ার, চিড়িয়াখানা, থিম্পু গুম্ফা, তাসি জংয়ের পাশের সার্ক বিল্ডিং দেখা। থিম্পু চোর্তেন আরেকটি দর্শনীয় স্থান। ধবধবে সাদা রঙের বৌদ্ধ বিহারটির ভেতরে ধ্যানমগ্ন বুদ্ধ,

সামনে অজস্র প্রদীপ জ্বলছে, প্রার্থনা করতে করতে মন্দির প্রদক্ষিণ করছে অসংখ্য লামা। আমরা থিম্পুর নদীতীরে দাঁড়িয়ে প্রধান জং তাশি জংয়ের রাতের ভিউ দেখলাম।

পরদিন সকালে প্রথমেই ঘুরে দেখলাম একটি বৌদ্ধ পুরনো জংসিমতোখা জং। এরপর যাই থিম্পু শহরের কাছেই বুদ্ধা পয়েন্টে, এখানে রয়েছে পৃথিবীর সর্ববৃহৎ বুদ্ধমূর্তি। উচ্চ পাহাড়ের মধ্য পাদদেশে মূর্তিটি স্থাপিত। থিম্পু শহরের ভ্রমণপথে প্রত্যক্ষ করা যায় মূর্তিটি। এরপর আমরা ঘুরে দেখি ভুটান ফোক মিউজিয়াম, আর্ট সেন্টারসহ বেশকিছু স্থাপনা।

ভুটান ভ্রমণের চতুর্থ দিনে পুনাখা যাওয়ার অনুমতি নিয়ে রওনা হই। যাত্রাপথে বিরতি দিই থিম্পু থেকে ৩৫ কিলোমিটার দূরে দোচালে পাস দেখতে। এখানে সবসময় আবহাওয়া খুবই রহস্যময়। পরিষ্কার আকাশ তো এই মেঘ-বৃষ্টি। শীতের সময় তুষারে ঢেকে যায় পুরো পাস এলাকা। এরপর আমরা চলে যাই ৮৬ কিলোমিটার দূরের পুনাখা শহরে। উদ্দেশ্য, স্থানীয় পুনাখা জং সাসপেনশন ব্রিজের সৌন্দর্য দেখা, আর পুনাখার সানকোশ নদীতে রাফটিং করা। বেলা ৩টার মধ্যে পুনাখার সানকোশ নদীর উজান থেকে ১০ কিলোমিটার নদী রাফটিং করি। ফিরতি পথে অবশ্য আরেকবার দোচালা পাস দেখার সুযোগ হয়। দিনে যেখানে দোচালা পাসের প্রাণচাঞ্চল্য, রাতে সেখানকার পরিবেশ ভুতুড়ে, শান্ত। পুনাখা ভ্রমণ দিয়ে থিম্পু ভ্রমণ শেষ হয়।

ভ্রমণের পঞ্চম দিন রওনা হলাম ভুটানের তৃতীয় বৃহত্তম শহর পারোর উদ্দেশে। থিম্পু থেকে পারোর দূরত্ব মাত্র ৬৫ কিলোমিটার। পথে পথে পড়ল পারো চু আর থিম্পু চুর সঙ্গম। পারো চু সঙ্গী হয় পথে। পথ যত এগোয়, নদীর রূপও তত মোহময় হয়, শেষে পারো পৌঁছানোর কিছু আগে থেকেই সে নিজেকে সম্পূর্ণ মেলে ধরে। তখন আর কোনো দিকে তাকানোর অবকাশ থাকে না। পারো চু বাধ্য করে তার দিকে তাকিয়ে থাকতে। সম্মোহন জানে সে। সেই সম্মোহনের ঘোরে কখন পারো পৌঁছে যাই বুঝতেও পারি না। নিসর্গের অকৃত্রিম মাধুর্য, উচ্ছল নদী, ক্যাকটাস, ছোট ছোট গ্রাম, বাজার আর মেঘ-কুয়াশা নিয়ে হাজার ২৯০ মিটার উচ্চতায় চারপাশ পাহাড়ঘেরা এই গাঢ় সবুজ উপত্যকা নিঃসন্দেহে এক স্বপ্নের জগৎ। এমন নিসর্গের অকৃত্রিম মায়াপুরী দেখতে আমরা পারো শহরে পৌঁছে গেলাম সকাল ১০টা নাগাদ। হোটেল বুকিং পর্ব শেষ করে ব্যাকপ্যাক রেখে শুরুতে চললাম পারো শহর থেকে দেড় ঘণ্টার দূরত্বের এক পাহাড় চূড়ায়। নাম তার চেলে লা পাস। সবুজ অরণ্যঘেরা আঁকাবাঁকা পথ বেয়ে আমাদের গাড়ি এগিয়ে চলছে। কয়েক হাজার ফুট উচ্চতা ওঠার সঙ্গে তাপমাত্রা নেমে গেল হিমাংকে। সঙ্গে তীব্র বেগে বাতাস। পাসের আশপাশে যেতেই চোখে পড়ল রাস্তার দুই ধারে দাঁড়িয়ে থাকা পাইনগাছে তুষার পড়ে থাকার দৃশ্য। সড়কপথের চূড়ায় উঠতে গিয়ে উত্তর-পূর্ব দিক থেকে আমাদের স্বাগত জানাল ভুটানের সর্বোচ্চ তুষারাবৃত্ত পাহাড়চূড়া জোমলহরি। উচ্চতা ২২ হাজার ফুটের অধিক। কী অনন্য রূপ পর্বতের! সূর্যের আলোয় যেন ক্ষণে ক্ষণে রূপ বদলায়।


যাত্রাপথের শুরুতে অবশ্য আমাদের গাড়ি অর্ধচন্দ্রাকারে বাঁক নিয়ে খাড়া রাস্তায় বেশ খানিকটা উঠে এসে একটা হেয়ার পিন বাঁকের মুখে দাঁড়াল। এখান থেকে নিচে তাকালে বিস্তীর্ণ উপত্যকাজুড়ে ছবির মতো পারো এয়ারপোর্ট। এয়ারপোর্টের পেছনে ভুটানি শৈলীর এক বিশাল অট্টালিকা ব্যাকগ্রাউন্ড সিনারির মতো লটকে আছে পাহাড়ের গায়ে। প্রশান্ত উপত্যকায় পাহাড়ের ওপর চারকোনা প্রকাণ্ড সাদা দুর্গটি মজবুত পাথরের তৈরি, কাঠের দরজা-জানালায় রঙ-বেরঙের কারুকার্যময় একটি কাঠের পুল (সাসপেনশন ব্রিজ) পেরিয়ে জংয়ে যাওয়ার রাস্তা। বর্তমানে এটি অন্যতম জাতীয় মিউজিয়াম। আটতলা মিউজিয়ামের প্রথম পাঁচতলা মাটির নিচে, ওপরে তিনতলা। ভেতরে অস্ত্রশস্ত্র, পোশাক-পরিচ্ছদ এবং প্রাচীন মূর্তি সযত্নে রক্ষিত। এছাড়া আছে বিখ্যাত শিল্পীর হাতে আঁকা এক বিরাট তংখা। তংখাটি লম্বা চওড়ায় প্রায় ৪০ হাত। প্রতি বছর বসন্ত উৎসব বা সেচু উৎসবে এটি দেখানো হয় এবং এটি নিয়ে শোভাযাত্রা হয়। জংয়ের ভেতরে বিভিন্ন বয়সের লামারা বাস করেন। পারো মিউজিয়ামের পাশেই আছে কিছু লাখাৎ। এর আরেক নাম দুংগুলি লাখাং। বিভিন্ন দেবদেবীর অবস্থান এখানে। লোককাহিনী অনুযায়ী পারো জংয়ে রাখার জন্য মূর্তিগুলো লাসা থেকে আনা হয়েছিল এবং এখানে রাখা হয়েছিল। পরবর্তীকালে কোনো এক দৈবিক কারণে মূর্তিগুলো আর নাড়ানো যায়নি। সেই থেকে এখানেই আছে।

পারো ভ্রমণের দ্বিতীয় দিন ভোরে আমরা যাই আরেক দর্শনীয় ইউনেস্কো ঘোষিত বিশ্ব ঐতিহ্যের স্মারক সৌন্দর্য ভুটানের সবচেয়ে পুরনো গুম্ফা বা পর্বতের গুহা দেখতে। উদ্দেশ্য তাকসাং মনাস্ট্রি পৌঁছানো। পারো থেকে আট কিলোমিটার দূরে গুম্ফাটি অবস্থিত। ৬৫৯ সালে লাসার শাক্য মুনির গুম্ফারও আগে তৈরি এটি। কথিত আছে গুম্ফাটি এক রাতে তৈরি হয়েছিল। এছাড়া আছে ড্রুকগিয়েল জং। ষোড়শ শতাব্দীতে নওয়াং নামগিয়েল এটি তৈরি করেন। কথিত আছে গুরু পদ্মসম্ভব বাঘের পিঠে চড়ে পারোর পাহাড়ে এসে যে গুম্ফাটিতে বসবাস শুরু করেছিলেন, সেটিই আসলে তাকসাং মনাস্ট্রি বা তাকসাং গুম্ফা। গহিন অরণ্যঘেরা বন্ধুর পাহাড়ি পথ বেয়ে প্রায় চার কিলোমিটার চড়াই ভেঙে গুম্ফায় আমরা উঠি। ভুটানিদের কাছে এটি একটি পবিত্র তীর্থস্থান।

পারোকে সুন্দরী বললে কম বলা হবে। রূপে-গুণে সে স্বর্গের ঊর্বশী কিংবা রম্ভাকেও হার মানায়। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সঙ্গে তীর্থ, ধর্ম আর ইতিহাসের আশ্চর্য সমন্বয়। সবকিছুই নিয়মবদ্ধ, সুশৃঙ্খল। মলিনতা নেই এখানকার মানুষের মনেও। তাই বোধহয় ক্রাইম শব্দটাও পারোর অভিধানে নেই। তিব্বতি স্থাপত্যে নির্মিত ঘরবাড়ি আর রঙবেরঙের জাতীয় পোশাকে সজ্জিত নারী-পুরুষ নিয়ে সুন্দরী পারোকে স্বপ্নরাজ বলেই মনে হয়। যেকোনো সময়, যেকোনো ঋতুতে, যেকোনো দিকে তাকালেই মনে হবে বিশাল ক্যানভাসজুড়ে অসাধারণ শিল্পকর্ম। যেকোনো পথে, যেকোনো দিকে যতদূর ইচ্ছা হেঁটে যান, মনে হবে স্বপ্নের মাটিতে পদচারণা করছেন। ফিরে এসে বিশ্বাস করতে কষ্ট হবে। মনে হবে সবটাই একটা সুখস্বপ্ন। এক অন্য রকম অনুভূতি।

পারোর দ্বিতীয় দিন মোটামুটি সবকিছু দর্শন করে সন্ধ্যায় হোটেলে ফিরি। এবার ফেরার পালা। বেলা ১১টায় ফুন্টশেলিংয়ের ইমিগ্রেশনে গিয়ে আমরা পাসপোর্টে বহির্গমন সিল নিয়ে ভুটান ত্যাগ করি। এরপর ভারতের জয়গাঁও হয়ে চ্যাংড়াবান্দা সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশের মধ্য দিয়ে আমাদেরও ভুটান ভ্রমণ শেষ হয়। সঙ্গে ছিল কেবল রোমাঞ্চকর অনুভূতিগুলোর এক সুখস্বপ্ন।

 

ছবি: লেখক

আহমেদ রিয়াদ, শিক্ষার্থী

আরও