গ্যাংটক শহরের প্রাণকেন্দ্র মূলত এমজি মার্গ। ছবির মতো সাজানো-গোছানো এ শহরের কোথাও নেই কোনো শব্দ, যানজট কিংবা ময়লা-আবর্জনা। ঝকঝকে এ শহরের কেন্দ্রবিন্দুতে আছে মহাত্মা গান্ধীর প্রায় ৩০ ফুট উচ্চতার সুবিশাল এক ভাস্কর্য
ভ্রমণপ্রেমীদের কাছে সিকিম এক নৈসর্গিক সৌন্দর্যের নাম। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় এ রাজ্য এশিয়ার অন্যসব পর্যটন এলাকার চেয়ে অনেক আলাদা। সুউচ্চ পাহাড়, ঝরনা, লেক আর হিমশীতলের পরশ পেতে প্রতি বছর লাখ লাখ পর্যটক ছুটে যান সিকিমে। চীন-নেপাল আর ভুটানের স্থলসীমায় এ রাজ্য পর্যটকদের কাছে যেন অচিনপুরীর দেশ।
সিকিমের সৌন্দর্য, রূপ-রহস্য দেখতে যোগ দিয়েছিলাম ঢাকার ‘বিজয়ের পদযাত্রা’ নামে একটি দলের সঙ্গে। পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী, প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ঝক্কি-ঝামেলা শেষে গত ১২ ডিসেম্বর এ দলের সঙ্গে রওনা দিলাম সিকিমের উদ্দেশে। ঢাকা থেকে রাত ১২টায় ‘পঞ্চগড় এক্সপ্রেস’ ট্রেনে সোজা চলে যাই উত্তরের সর্বশেষ জেলা পঞ্চগড়ে। বিজয়ের পদযাত্রার ১৫ সদস্যের এ দলে যুক্ত হওয়ায় মোট সদস্য হলো ১৬ জন। ঢাকা থেকে ট্রেনে উত্তরের সর্বশেষ জেলা পঞ্চগড়ে পৌঁছতেই যেন পর্বতের ঠাণ্ডা বাতাস আমাদের স্বাগত জানাল। এরপর মাইক্রোবাসে চেপে সরাসরি উত্তরে বাংলাদেশের ইমিগ্রেশন পয়েন্ট বাংলাবান্ধায়।
পঞ্চগড় শহর থেকে বাংলাবান্ধার দূরত্ব প্রায় ৬৩ কিলোমিটার। ৩ হাজার টাকা দিয়ে একটি মাইক্রোবাস ঠিক করে আমরা রওনা হলাম। বাংলাবান্ধায় পৌঁছতে সময় লাগল ৪৫ মিনিট। নেমেই পাসপোর্ট নিয়ে সরাসরি ইমিগ্রেশনের লাইনে। তখন বাজে সকাল সাড়ে ১০টা। ইমিগ্রেশনের কাজ সারতে সন্ধ্যা ৬টা। এখানেই বিপর্যয় হলো ট্যুর প্লানের। বাংলাদেশ ইমিগ্রেশনে আমাদের সময় নষ্ট হওয়ায় শিলিগুড়ি শহরে এক রাত যাপন করতে হলো। যেটি আমাদের পরিকল্পনায় ছিল না। হোটেল থেকে পরের দিন ভোর ৫টায় রওনা হলাম সিকিমের রাজধানী গ্যাংটকের উদ্দেশে। ভোরের ঘন কুয়াশা, হাড় কাঁপানো শীত আর আকাশের মৃদু কান্না উপেক্ষা করে চলতে থাকল আমাদের গাড়ি। পাহাড়ি বাঁক আর খাঁড়া রাস্তায় উঠতে উঠতে গাড়ির জানালা দিয়ে উঁকি দিতেই যেন প্রাণটা কেঁপে উঠল।
সিকিমের প্রবেশদ্বার র্যাংপো চেকপোস্ট
শিলিগুড়ি শহর থেকে সিকিমে ঢুকতেই পথে পড়বে র্যাংপো চেকপোস্ট। মূলত এটিই সিকিমের প্রবেশদ্বার। এখান থেকেই পর্যটকদের সিকিম ভ্রমণের অনুমতি নিতে হয়। আর হ্যাঁ, সিকিম ভ্রমণে অবশ্যই পাসপোর্ট ও ভিসার অন্তত ২০ কপি ফটোকপি রাখবেন। সিকিমে যেখানেই ঘুরবেন, প্রতিটি জায়গায় প্রবেশের জন্য আপনাকে আলাদা আলাদা অনুমতি নিতে হবে। সেক্ষেত্রে পাসপোর্ট, ভিসা ও দুই কপি পাসপোর্ট সাইজের ছবির প্রয়োজন পড়বে।
বিকাল ৫টায় জিপ থেকে গ্যাংটক শহরে নামতেই তীব্র শীতের প্রকোপ জেঁকে ধরল সারা শরীরে। খাড়া পাহাড়ের উপত্যকায় অবস্থিত এ শহরের চারদিকে মেঘের জলরাশি। যেদিকে তাকাবেন শুধুই মেঘ আর পাহাড়ের সারি। শিলিগুড়ি থেকে ছেড়ে আসা জিপগুলো যেখানে নামিয়ে দেয় সেটি মূলত গ্যাংটকে ‘শিলিগুড়ি ট্যাক্সি স্ট্যান্ড’ নামে পরিচিত। সিকিমের স্থানীয় ভাষায় যেটিকে ‘ভাজরা ট্যাক্সি স্ট্যান্ড’ বলা হয়। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় সাড়ে ৪ হাজার ফুট উপরে এটা যেন আজব এক শহর। গাড়ি থেকে নেমে হোটেলে যেতেই মনে হলো এ যেন আকাশ ভ্রমণে নভোচারী হয়েছি আমরা।
গ্যাংটক শহরের প্রাণকেন্দ্র মূলত এমজি মার্গ। ভারতীয় জাতির জনক মহাত্মা গান্ধীর (এমজি) নামে নামকরণ করা হয়েছে এই মার্গের। ছবির মতো সাজানো-গোছানো এ শহরের কোথাও নেই কোনো শব্দ, যানজট কিংবা ময়লা-আবর্জনা। ঝকঝকে এ শহরের কেন্দ্রবিন্দুতে আছে প্রায় ৩০ ফুট উচ্চতায় মহাত্মা গান্ধীর সুবিশাল এক ভাস্কর্য। যেখানে এসেই পর্যটকরা প্রথমত ছবি তোলার কাজটি সেরে নেন। এমজি মার্গের রাস্তার মাঝে আইল্যান্ডের দুধার দিয়ে পর্যটকদের জন্য রয়েছে বসার সুব্যবস্থা। যেখানে বসে দালান-কোঠার ফাঁক দিয়ে দূরের সুবিশাল পাহাড় দেখে নিতে পারেন। গ্যাংটকের সোনালি বিকাল কিংবা সকালের সৌন্দর্য দেখতে শহরের প্রাণকেন্দ্রে রয়েছে কেবল কারের ব্যবস্থা। ট্যুরের চার সদস্য মিলে কেবল কারে চড়ে শহরের অপূর্ব দৃশ্য উপভোগ করলাম। পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে নান্দনিক কারুকার্যের স্থাপনা, সাপের মতো পেঁচিয়ে উপরে ওঠা খাঁড়া রাস্তা আর সবুজের ফাঁকে লাল-হলুদ রঙের বিল্ডিংগুলো যেন রূপকথার রাজ্যের মতো। এরই মধ্যে নেমে এল রাতের আঁধার।
প্লাস্টিকমুক্ত লাচুং
গ্যাংটকে রাত্রি যাপনের পর আমাদের পরবর্তী গন্তব্য নর্থ সিকিমের পর্যটন এলাকা ‘লাচুং’। এখানে আছে সুবিশাল বরফের আস্তরণ, তুষারপাত আর কাঞ্চনজঙ্ঘার অপূর্ব দৃশ্য দেখার সুবর্ণ সুযোগ। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে সাড়ে ৯ হাজার ফুট উচ্চতায় লাচুং গ্যাংটক শহর থেকে ১১৫ কিলোমিটার দূরে। খাঁড়া পাহাড়ের উচ্চতায় এ পর্যটন স্থাপনায় পৌঁছতে প্রতি মুহূর্তে আপনার গায়ের লোম নাড়া দিয়ে উঠবে। পাহাড়ের উঁচু-নিচু সরু রাস্তার বাঁক রীতিমতো এক মরণ ফাঁদ। লাচুংয়ে যেতে হলে অবশ্যই আপনাকে প্লাস্টিকের জিনিসপত্র নেয়া থেকে দূরে থাকতে হবে। এমনকি প্লাস্টিকের পানির বোতলও। লাচুং ‘মূলত প্লাস্টিক ফ্রি জোন’ এরিয়া। তাই পলিথিন কিংবা প্লাস্টিকের কোনো পাত্র থাকলে তা চেকপোস্টেই ফেলে যেতে হবে। মনে রাখবেন, সিকিমের আইন-কানুন ভারতের যেকোনো রাজ্যের চেয়ে আলাদা। ভুল হলেই গুনতে হবে বড় অংকের জরিমানা।
লাচুংয়ে দূর পাহাড়ের গা বেয়ে নেমে আসা ঝরনা, সূর্যের আলোকরশ্মিতে সুউচ্চ পর্বতের মোহনীয় দৃশ্য দেখে নিজের চোখকে বিশ্বাস করাতে পারবেন না। শেষ বিকালে সুউচ্চ পর্বতমালায় সূর্যের আলোক রশ্মি হীরার খনির মতো দেখতে। পথে যেতে যেতে চোখে পড়বে অমিতাভ বচ্চন ওয়াটারফল, ছোট-বড় পাহাড়ি ঝরনাসহ নানা দৃশ্য। লাচুংয়ে পৌঁছে ‘প্রেমা মাউনটেন’ নামে একটি হোটেলে রাত্রি যাপন করলাম। পাহাড়ের সমতায় অবস্থিত এ হোটেলের চারদিকে বরফে ঢাকা। হোটেলের ছাদ কিংবা রুমের পাশে তুষারপাতে ততক্ষণে জমাট বাঁধতে শুরু করেছে। তাপমাত্রা মাইনাস ১২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। প্রতি মুহূর্তে যেন জমে যাচ্ছিলাম। রাতে খাবার শেষে হোটেলের জানালার পর্দা সরাতেই পাহাড়ের গায়ে পূর্ণিমার চাঁদের লুকোচুরি।
ফুলের উপত্যকা ইয়ামথাং ভ্যালি
ইয়ামথ্যাং ভ্যালি মূলত ‘ভ্যালি অব ফ্লাওয়ার’ অর্থাৎ ফুলের উপত্যকা নামে পরিচিত। ফেব্রুয়ারি বা জুনের শেষ সময় এখানে পুরোটা সময়জুড়ে পাহাড়ি ফুলে ভরা থাকে। আমরা রাতটা লাচুংয়ে কাটিয়ে পরদিন সকালে ইয়ামথাং ভ্যালির উদ্দেশে যাত্রা করলাম। কিন্তু মন্দভাগ্য! তীব্র তুষারপাত আর নিরাপত্তাজনিত কারণে কর্তৃপক্ষের অনুমতি না মেলায় সেখানে যাওয়া হলো না।
বরফের খেলায় মাতবেন কাটাওয়েতে
লাচুংয়ে যাবেন আর বরফ খেলায় মাতবেন না, তা কি হয়? এই কাটাওয়ে খেলবেন বরফ ছোড়াছুড়ির খেলা। লাচুং থেকে কাটাওয়ের দূরত্ব মাত্র ২৮ কিলোমিটার। ইয়ামথাং যাওয়ার অনুমতি না মেলায় আমরা সরাসরি হোটেলে ফিরে রওনা দিলাম কাটাওয়ে। রাস্তার দুধারে বরফের স্তূপ আর দূরে বরফে ঢাকা পাহাড়গুলো দেখলে মনে হবে আপনি সুইজারল্যান্ড এসেছেন।
লাচুংয়ে এক রাত যাপন করে পরদিন আবারো ফিরলাম গ্যাংটক শহরে। পরদিন বেলা ১১টায় আমরা রওনা হলাম পূর্ব সিকিমের সাঙ্গু লেকের উদ্দেশে। এ লেক ভ্রমণে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে লাখ লাখ পর্যটক আসেন সিকিমে। রাজধানী গ্যাংটক থেকে পূর্বে অবস্থিত সাঙ্গু লেকের দূরত্ব ৪০ কিলোমিটার। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে যার উচ্চতা ১২ হাজার ৩১৩ ফুট (৩ হাজার ৭৫৩ মিটার)। শীত মৌসুমে এ লেকের পানি পুরোপুরি বরফ হয়ে যায়। এছাড়া বিভিন্ন মৌসুমে এ লেকের পানি নানা রঙ ধারণ করে। সাঙ্গু লেকের পাড়ে ‘গুরু পূর্ণিমা’ ও ‘রাখি বন্ধন’ উৎসব বসে প্রতি বছর। স্থানীয় বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা বিশ্বাস করেন সাঙ্গু লেকের পানি নানা রোগব্যাধি সারাতে পারে। যে কারণে প্রতি বছর নির্দিষ্ট একটি সময় স্থানীয়রা সেখানে ভিড় জমায়।
সিকিম ভ্রমণে খুঁটিনাটি
ছয় থেকে আটদিনের সিকিম ভ্রমণে কেনাকাটা বা বাড়তি খরচ বাদে আপনার ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা খরচ হবে। এর মধ্যে হোটেল ভাড়া, যাতায়াত, খাওয়া-দাওয়া, ভ্রমণ রিলেটেড প্রয়োজনীয় খরচ হয়ে যাবে। এছাড়া পাসপোর্ট, ছবি, এজেন্সির কাগজের ফটোকপি, অনুমতিপত্র সবসময় সঙ্গে রাখবেন। এর বাইরে সঙ্গে রাখবেন গরম কাপড়।
আবু তাহের
ছবি: আব্দুল্লাহ আল মামুন