শখের কি আর শেষ আছে! কী
এক শখ জাগল সোনাইছড়ি ঝরনায় ক্যানিওনিং করব!
কাজেই তিনদিনের একটা ছুটি পেয়ে গেলাম সোনাইছড়ি
ঝিরির মুখে। আমার তখন ভীষণ শরীর খারাপ। কিন্তু পরিকল্পনা যেহেতু আমারই করা, তাই
সেটা ভণ্ডুল না করে খুঁটি গাড়লাম সোনাইছড়ির মুখে।
প্রথম দিনটা কেটে গেল ঝিরির মুখের
আশপাশেই আড্ডা দিয়ে। বাদুর গুহাটা পেরিয়ে খানিকটা এগিয়ে ভয়ংকর সুন্দর এক জায়গায়
শুয়ে, বসে, ঘুমিয়ে, গান গেয়ে আর আড্ডা দিয়ে কাটল দিন। দলে থাকা শোভন ভাই আর বাবু ভাই
এসেছেন পাখির ছবি তুলতে, তারা সেটা নিয়েই ব্যস্ত ছিলেন। সন্ধ্যা লাগার মুখে তাঁবুর কাছে ফিরে
এলাম। ফাগুনের আকাশে তখন আধখানি চাঁদ। আধখানি হলে হবে কি, ওইটুকু
চাঁদের আলোর জ্যেঅত্স্নায় ভেসে যাচ্ছিল চরাচর। রাতের খাবার খেয়ে আবার চলল
উকুলেলেতে দোতারার সুরে গানের টান। সকাল সকাল উঠে পড়তে হবে, তাই
আড্ডা ভেঙে ঘুমানোর আয়োজন করতে হলো।
সকালে উঠে দেখি মেঘলা আকাশ। এক পশলা
বৃষ্টিও হয়ে গেল। এ সোনাইছড়ি ট্রেইলটা ফ্ল্যাশ ফ্ল্যাডে ভয়ংকর হয় ওঠে। সে আশঙ্কায়
কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত হলো। খানিক বাদে আকাশ পরিষ্কার হয়ে রোদ খেলতে
শুরু করলে আমরা জিনিসপত্র গোছাতে শুরু করলাম ঝরনায় যাওয়ার উদ্দেশে। আমার তখনো শরীর
খারাপ বোধ হচ্ছিল। তাই ভাবলাম একা ধীরে এগোতে থাকি সামনে, কিছুদূর
যেতেই হয়তো দলের অন্যরা আমাকে ধরে ফেলবে। যেমন ভাবা তেমন কাজ। রওনা হয়ে গেলাম
একাই।
সোনাইছড়ি ট্রেইল সীতাকুণ্ডের অন্য সব
ট্রেইলের চেয়ে অপেক্ষাকৃত দুর্গম। বিশাল আকারের পাথরে ভরা, সামনে
এগোনোার পথ খুঁজে পাওয়াই দায়!
যা-ই হোক, ছোট বড় বোল্ডার ডিঙাতে ডিঙাতে আমি এগোতে লাগলাম সামনের দিকে। ঝিরিতে
ঢোকার পরপরই দেখা যায় বড় সব পাথর পথ আগলে ঠায় দাঁড়িয়ে। একটা পাথরে পা রাখার জন্য
খোদাই করা আছে, অনেকটা সিঁড়ির মতো। সেগুলো পেরোতেই সামনে বিশাল এক পাথর। সে পাথর বেয়ে
উপরে উঠতেই চোখে পড়ে নিচে গুহার মুখ। বাদুরে ভরা গুহা। কিন্তু সে গুহার ভেতরে ঢোকা
সম্ভব নয়, কারণ পানি। খানিকটা যেতে না যেতেই বুকসমান পানি হয়ে যায়, সাঁতার
না জানলে অথবা সঙ্গে ব্যাগ/ক্যামেরা ইত্যাদি থাকলে এ গুহা পেরোনো সম্ভব নয়। কাজেই বড় পাথরটা পর্যন্ত
না গিয়ে ডানে পাহাড় বেয়ে উঠতে শুরু করলাম। কিছু দূর মাটির পথ অতিক্রম করতেই, দুই
পাশেই পাথুরে পাহাড়ের দেয়ালের মাঝে এমন একটা জায়গায় এসে দাঁড়ালাম, মনে
হচ্ছিল যেন অদৃশ্য এক দরজা সামনে,
যার ওপাশে সম্পূর্ণ অন্য এক জগৎ।
খানিকটা নিচে নামতেই সে অদৃশ্য দরজা পার হয়ে পা রাখলাম যেন আরেক জগতে। দুই পাশের পাথুরে দেয়া খাড়া উঠে গেছে বেশ খানি, বড় গাছের কারণে সূর্যের আলো প্রবেশ সীমিত হয়ে আলো-আঁধারিতে এক মায়াময় পরিবেশ তৈরি করেছে। এ জায়গায় যতবারই আসি, দু-দণ্ড হাত-পা ছড়িয়ে না বসলেই নয়। একা কিছুক্ষণ জিরিয়ে নিতে নিতে কত কিছু যে অবাস্তব কল্পনার জগতে ঢুকে গেলাম, সে আর বলার নয়! সামনে এগোতে হবে তাই জোর করে শরীরটাকে তুলে এগোলাম। কিছুদূর যেতেই দেখা হয়ে গেল শোভন ভাইদের সঙ্গে। ওনারা সেই আলো ফোটার আগেই বেরিয়েছিলেন পাখির ছবি তোলার জন্য। ওনাদের সঙ্গে সঙ্গে কিছুদূর হাঁটার পর বুঝলাম এই এত ধৈর্য ধরে পাখির ছবি তোলা আমার কাজ তো নয়ই, ছবি তোলা দেখার ধৈর্যও আমার নেই। এদিকে দলের অন্যদেরও টিকিটির দেখা নেই। ক্যানিওনিংয়ের সরঞ্জাম গুছিয়ে নিয়ে আসতে হয়তো সময় লাগছে ওদের; অগত্যা কী আর করা, শোভন ভাইদের ফেলে আবার একা সামনে এগোতে থাকলাম।
সীতাকুণ্ডের ট্রেইলগুলোর
নিরাপত্তাবিষয়ক বেশ দুর্নাম আছে। একা এ ট্রেইল পেরোতে গিয়ে তাই হাজারো ভাবনা জড়
হতে লাগল মাথায়। একেবারে নির্জন একটা ট্রেইল,
পাখির ডাক আর ঝিরিতে বয়ে যাওয়া পানির ঝির ঝির
শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই। মনে হচ্ছিল হঠাৎ যদি কেউ একটা দা হাতে নিয়ে সামনে এসে
দাঁড়ায়, কী করব আমি? আচ্ছা আজে বাজে চিন্তা বাদ দিই...
যদি গুঁইসাপ বা সাপের দেখা মেলে? হঠাৎ
যদি পা মচকে যায়! এসব ভাবতে ভাবতে বারবার পেছনে তাকাচ্ছিলাম, যদি
দলের বাকিরা এসে পড়ে ! কিসের কী... কারো খবর নেই। আমি আবারো আকাশ-পাতাল ভাবতে ভাবতে এগোতে থাকলাম। এত সুন্দর প্রকৃতি, অনুচ্চ
পাহাড়ে ঘেরা ঝিরিপথ, নানা রকম গাছ, সেসব গাছে সবুজ ছাড়াও হলদে,
লালচে রঙের পাতা দেখা যাচ্ছে। কিচিরমিচির পাখির
ডাকে আমি হারিয়ে গেলাম যেন এক স্বপ্নের জগতে। নিজেকে মনে হচ্ছিল যেন বন্দি এক
রাজকন্যা, যে হঠাৎ করে পালানোর সুযোগ পেয়ে চলে এসেছে এ ঝিরিপথে। এ খোলামেলা
প্রকৃতির যা দেখছি, তাতেই জাগছে বিস্ময়। এত সুন্দর কেন এ পৃথিবী? এ
প্রশ্নের জবাব খুঁজতে থাকি,
আর এগোতে গিয়ে মনে হলো আহ্! সামনে কোনো ছদ্মবেশী
রাজকুমারের দেখা পেলে মন্দ হতো না।
এভাবেই একা পুরোটা রাস্তা পাড়ি দিয়ে
একসময় পৌঁছে গেলাম ঝিরির শেষ মাথায় ঝরনাটার সামনে। না কোনো ছদ্মবেশী রাজকুমার
সেখানে আমার অপেক্ষায় নেই, বরং শীতের শেষের এক জীর্ণ ঝরনা ঠায় দাঁড়িয়ে আমার অপেক্ষায়। ঝরনাটার
সামনেই বেশ বড় একটা বোল্ডার আছে,
যার ওপরটা মোটামুটি সমতল। সেখানে গামছাটা বিছিয়ে
শুয়ে পড়লাম খোলা আকাশের নিচে। গাছের পাতার ফাঁকে ফাঁকে সাদা মেঘের ওড়াউড়ি দেখতে
দেখতে কখন যে ঘুমিয়ে গেছি, নিজেও জানি না! তীব্র রোদে বারবিকিউ হয়ে যাওয়ার আগে ঘুম ভাঙল যখন, তখনো
দলের অন্যরা এসে পৌঁছেনি। ঘুম ভেঙে পুরো ট্রেইলটার কথা যখন ভাবছিলাম, খেয়াল
হলো বাহ! এ ট্রেইল পুরোটাই তো দেখি আমি একাকী হাঁটলাম। দলবেঁধে ঘুরতে যাওয়ার এক
রকম আনন্দ। আবার এত সুন্দর পরিবেশে প্রকৃতির সঙ্গে মিশে গিয়ে একাকী শুধু নিজের
সঙ্গে কিছুক্ষণ কাটানোর এই যে অভিজ্ঞতা,
তাও তুলনাহীন।
ছবি: লেখক