ভ্রমণ বিষয়টা মূলত হাওয়া বদল! এক কথায় আমার কাছে ভ্রমণের যথাযথ অর্থ এটাই। ভ্রমণে যারাই যে কারণে যায়, তার প্রায় সবগুলোকেই এ ‘হাওয়া বদল’-এর মধ্যে ফেলা যায়। ভ্রমণের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় থাকে—নিজেকে সময় দেয়া, বিনোদন দেয়া, নিজের ভেতরের গুমোট আবহাওয়ার পরিবর্তন! আমরা যখন একই কাজ করতে করতে ক্লান্ত, বিরক্ত, অবসাদগ্রস্ত, তখনই ভেতরকার পরিস্থিতির অন্তত সাময়িক পরিবর্তনের নিমিত্তেই বের হয়ে পড়ি এদিক-সেদিক!
ভ্রমণ যে কারণে হাওয়া বদল, তার বড় একটা উদাহরণ দেয়া যায় এভাবে যে আমরা যেমন নিজের অভ্যস্ত জীবন থেকে হাঁপিয়ে উঠে পাহাড়, সমুদ্র কিংবা নিরিবিলি গ্রাম্য কোথাও ছুটে যেতে চাই, তেমনি ঠিক ওই জায়গার মানুষগুলোও তাদের হাওয়া বদল করার জন্য চাকচিক্যময় রঙিন ব্যস্ত শহরে আসার স্বপ্ন দেখে। ছোটবেলায় আমি যখন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অজপাড়াগাঁয় ঘুরতাম, দাপিয়ে বেড়াতাম খাল-বিল-মাঠ-নদী কিংবা মাইলের পর মাইল ধানক্ষেত, তখন আমার স্বপ্ন থাকত ঢাকায় আসার! বন্ধুরা মিলে গুনতাম কে কতবার ঢাকায় এসেছি! এর মধ্যে সর্বোচ্চবার যে এসেছে, সে হালকা একটু ভাবের মধ্যে থাকতাম! এখানকার বাণিজ্য মেলা, বইমেলা আর রঙিন ঢাকা ঘুরতে আসার জন্য কলেজ জীবনে কত কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে আমাদের! অথচ এখন ক’দিন গেলেই গ্রামে যাওয়ার জন্য ভেতরটা খুব হাঁসফাঁস লাগে, কাজকাম থেকে মন ছুটে যায়!
অভ্যস্ততার বাইরের জগৎই হচ্ছে হাওয়া বদল! এ হাওয়া বদলের জন্য কেউ ছুটছে পাহাড়ে, কেউ সমুদ্রে, কেউবা হাওড়-নদীতে, আবার কেউবা চাকচিক্যময় কোনো নগরীতে কিংবা অন্য কোনো দেশে! যে সারা বছর অনেক অনেক মানুষের সঙ্গে মিশে, গল্পগুজব করে, কথা বলে বিরক্ত; সে সেই হাওয়াটা বদল করতে হয়তো খোঁজে নির্জনতা। আবার কেউ নির্জনতায় ভাসতে ভাসতে হতাশায় পড়ে তার হাওয়া বদলের জন্য খোঁজে সঙ্গ! কেউ ঘোরে দল বেঁধে তো কেউ ঘোরে একা, কেউ তার খুব কাছের জনের সঙ্গেই ঘুরে আরাম পায় তো কেউ নতুন কারো সঙ্গে ঘুরে অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য। কেউ কেউ খরচ বাঁচাতেও দল বেঁধে ঘোরে, কেউ ঘুরতে গিয়ে একা বসে থাকে কোথাও তো কেউ গান-গল্পে নিজেকে ভোলায়। কেউ নতুন কিছুর সন্ধান করে তো কেউ অনেক আদিম কিছুতে মেতে থাকে। কেউ খুব কষ্ট করে হেঁটে-দৌড়ে কোথাও ঘুরে মনকে আরাম দেয়, তো কেউ খুব আয়েশ আর খরচ করে আরাম দেয় শরীর-মনকে! কেউ যায় ছবি তুলতে, কেউ আবার তোলাতে! কেউবা আবার খোলা জায়গা পেয়ে কিংবা সঙ্গ পেয়ে খেলাধুলায় নিজেকে সময় দেয়! সমুদ্রে ঘুরতে গিয়ে কেউ সমুদ্রের পাড়ে বসে থেকে আনন্দ পায়, তো কেউ আবার সমুদ্রের জলে লাফিয়ে গা ভিজিয়ে এটাতেই পৃথিবীর সর্বোচ্চ আনন্দ অনুভব করে।
এ সবই তার মনের হাওয়া বদল, যেভাবে তার মন প্রফুল্ল থাকে। এখানে কারো নিজের বানানো সংজ্ঞা বা নিয়ম খাটবে না তার মনের চাওয়ার ওপর, কারণ ঠিক ওই সময়ে তার মন কেমন পরিস্থিতিতে আছে; মন কি গানবাজনা চায়, পাহাড়ের নির্জনতা চায়, নাকি কোথাও নিথর হয়ে পড়ে থাকতে চায়, তা শুধু সে-ই জানে! কারণ তার হাওয়া বদলের প্রয়োজন, সেটা যেভাবেই হোক। কিন্তু বিষয় এখানে দুটো; এক হচ্ছে প্রকৃতির কোনো প্রকার ক্ষতি করা যাবে না। আরেক হচ্ছে, আশপাশে থাকা একজন মানুষেরও বিরক্তির কারণ হওয়া যাবে না। এ দুটি ঠিক রেখে বাদবাকি যা আছে, সেখান থেকে মনের ও শরীরের হাওয়া বদল করে ফেরার নামই ভ্রমণ!
ইমরানুল আলম
ট্যুর গ্রুপ বিডির ব্যবস্থাপনা পরিচালক