১৯১৬ সাল। ‘ইনটলারেন্স’ সিনেমার চিত্রধারনের সময় পরিচালক ডি. ডব্লিউ. গ্রিফিথ কোনোভাবেই অভিনেত্রী সিনা ওয়েনের চোখ ক্যামেরায় ফুটিয়ে তুলতে পারছিলেন না। অগত্যা নকল পাপড়ি তৈরির জন্য একজন পরচুলা প্রস্তুতকারককে নিযুক্ত করা হলো। সেই ব্যক্তির বানানো পাপড়ি আঠা দিয়ে চোখে লাগিয়ে দেয়া হলো অভিনেত্রীর । এই সিনেমা মুক্তির পরপরই শুরু হয় চোখে নকল পাপড়ি লাগানোর চল।
১৯১১ সালে কানাডীয় উদ্ভাবক আনা টেলর কৃত্রিম পাপড়ি পেটেন্ট করেন। টেলরের বানানো পাপড়ি মানুষের চুল থেকেই তৈরি করা হয়েছিল। এরপর জার্মান হেয়ারড্রেসার কার্ল নেসলার নিউইয়র্ক শহরের একটি সেলুনে কৃত্রিম পাপড়ি লাগানোর সেবা চালু করেন।
এ হিসাবে চোখের পাতার আঠা লাগানো নকল পাপড়ির ইাতহাস পৃথিবীতে খুব বেশিদিনের নয়। তবে এর আগে কীভাবে তৈরি করা হতো নকল পাপড়ি তা জানলে গা শিউরে উঠবে সবারই।
ঘন চোখের পাপড়ির কদর সৌন্দর্য চর্চায় বরাবরই বেশি। পাপড়ি ঘন করতে তাই যুগে যুগে ব্যবহৃত হতো নানা পদ্ধতি। ৩ হাজার ৫০০ খ্রিস্টপূর্বে পুরুষ ও নারী উভয়েই চোখের পাপড়ি ঘন দেখানোর জন্য বিভিন্ন ধরনের মলম ব্যবহার করত। এগুলো চিরুনি দিয়ে আঁচড়ানোর হতো। চোখের পাপড়ি কালো করার জন্য ম্যালাকাইটের মতো উপকরণ ব্যবহার করা হতো। পুরুষ ও নারীরা সিসা সালফাইড দিয়ে তৈরি করা কৃত্রিম রঙ প্রয়োগ করতো চোখে।
আবার চোখের পাপড়ি ছোট হওয়াকে বার্ধক্যের লক্ষণ বলে মনে করত রোমানরা। তাই পোড়া কর্ক ও কয়লা ব্যবহার করা হতো চোখের পাপড়ি লম্বা করতে। লম্বা-ঘন পাপড়ি নৈতিকতা এবং কুমারীত্বের প্রতীক বলেও বিশ্বাস করা হতো।
তবে প্রাচীন আমলে পাপড়ি বড় করার নানান পদ্ধতি থাকলেও নকল পাপড়ির ধারণা ছিল না কারো। প্রথমবারের মতো নকল পাপড়ির ধারণা গড়ে ওঠেছিল সভ্যতার ইতিহাসে নিজেদেরকে মানদণ্ড হিসেবে দেখানো ইউরোপে। আর এতে সংক্রমণ, ব্যথা, চোখের ক্ষতি—সবই ছিল সম্ভাব্য পরিণতি!
ইতিহাসবিদদের মতে, ১৮৯৯ সালে ‘ডান্ডি কুরিয়ার’ নামে একটি ব্রিটিশ পত্রিকায় একটি প্রতিবেদন ছাপা হয়। প্রতিবেদনটি হতবাক করে দিয়েছিল সবাইকে। সেখানে বলা হয়, মেয়েরা তাদের চোখের পাতায় মানুষের চুল দিয়ে তৈরি নকল পাপড়ি লাগাতেন—আর সেই চুলগুলো সুঁই দিয়ে চোখের পাতার কিনারে সেলাই করে বসানো হতো।
ওই সময়ে কৃত্রিম পাপড়ি চোখে লাগানোর জন্য সাধারণ সেলাই করার সুঁই ব্যবহার করা হতো। যার চোখে পাপড়ি লাগানো হতো তারই মাথা থেকে চুল সংগ্রহ করা হতো। এরপর চুলগুলো সুঁইয়ে ঢুকিয়ে চোখের পাতার নিচের সীমানা বরাবর সেলাই করে লাগানো হতো। ব্যথা যেন কম অনুভূত হয় এ জন্য চোখের পাপড়িতে কোকেইনের একটি দ্রবণ ব্যবহার করা হতো। তবে এ কাজ যারা করতেন তারা ছিলেন পেশাদার। দক্ষতার সঙ্গে তারা চোখের পাতার শেষ প্রান্ত দিয়ে বহিঃত্বক ও ট্র্যাগাসের তরুণাস্থির মধ্য দিয়ে সুঁই চালাতেন। এরপর একটি কার্লিং টংগস বা কোঁকড়ানো চিমটা দিয়ে চোখের পাপড়িগুলোকে সুন্দর আকার দেয়া হতো। এই অস্ত্রোপচারের পরের দিন পর্যন্ত চোখ ব্যান্ডেজ দিয়ে বাঁধা থাকত।
বরাবরই উচ্চবিত্ত শ্রেণির নারীরা বিউটি ট্রেন্ড অনুসরণ করতে আগ্রহী ছিলেন। সে জায়গা থেকে চোখে সেলাই করে পাপড়ি বসানোর ক্ষেত্রেও সে সময় এগিয়ে ছিলেন উচ্চবিত্ত ঘরের বউ-মেয়েরা। এছাড়া, থিয়েটার ও পারফর্মিং আর্টসের সঙ্গে যুক্ত নারীরা, নাটকীয় ও আকর্ষণীয় চেহারার প্রয়োজনীয়তা থেকে এই ভয়ানক পদ্ধতিতে নকল পাপড়ি বসাতেন।
মূলত ১৮৯০ এর দশকে এই ভয়ানক প্রক্রিয়াটি প্রচলিত ছিল ইউরোপে। এই প্রসাধন পদ্ধতিটি তখনকার কিছু বিউটি স্যালনে ‘অত্যাধুনিক’ মনে করা হতো। অথচ এ পদ্ধতি ছিল মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ। তবে সেই সময়ের সৌন্দর্য মানদণ্ড এমন ছিল যে, নারীরা এসব যন্ত্রণাকেও হাসিমুখে মেনে নিতেন। তাদের কাছে যেন দীর্ঘ, ঘন চোখের পাপড়ি পাওয়াই ছিল জীবনের একমাত্র লক্ষ্য!
সুখবর হলো, এখন আর চোখে সুঁই দিয়ে সেলাই করে পাপড়ি বসানোর প্রচলন নেই। বর্তমানে চোখের সৌন্দর্য বাড়াতে বাজারে গ্লু ল্যাশ , ম্যাগনেটিক ল্যাশ, এমনকি ল্যাশ এক্সটেনশন সবই আছে, যা অনেক নিরাপদ। এছাড়াও আছে ইকো-ফ্রেন্ডলি ও ভেগান ল্যাশ, যা ওয়াশেবল। আবার এখন কিছু ব্র্যান্ড মুখের মাপে কাটার বা ডিজাইন করে দিচ্ছে আইল্যাশ।
সোশ্যাল মিডিয়া ও বিউটি ইনফ্লুয়েন্সারদের কল্যাণে বর্তমানে কৃত্রিম পাপড়ি আরো জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। ২০২৪ সালের হিসাবে, গ্লোবাল আর্টিফিশিয়াল আইল্যাশ মার্কেটের মূল্য ছিল প্রায় ১৯০ কোটি মার্কিন ডলার। অনুমান করা হচ্ছে, ২০২৫ থেকে ২০৩০ সালের মধ্যে এই বাজার বার্ষিক ৭ থেকে ৮ শতাংশ পর্যন্ত বাড়বে। আর ২০৩০ সালের মধ্যে বাজারের আকার হতে পারে ৩০০ কোটি ডলারের বেশি!
২০২৫ সাল নাগাদ কৃত্রিম পাপড়ির বাজার ১৬০ কোটি ডলার হবে বলে ধারণা করা হয়।
লন্ডন ছিল এই ট্রেন্ডের একটি বড় কেন্দ্র। ঐ সময় লন্ডনের কিছু বিউটি স্যালন সেলাই করে আইল্যাশ বসানোর সেবা দিত। বার্লিন বা প্যারিসেও এরকম পরিষেবা দেয়া হতো বলে ধারণা করা হয়। তবে সেখানে ঐ সময়কার রেকর্ড বেশ সীমিত।