হামাস-ইসরায়েল যুদ্ধ

ট্রমা ও ধ্বংসযজ্ঞের এক বছর

২০২৩ সালের ৭ অক্টোরব। ফিলিস্তিনের সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাস গাজা উপত্যকা থেকে ইসরায়েলের দক্ষিণাঞ্চলে হামলা চালায়। জবাবে ইসরায়েলও পাল্টা হামলা চালায়। এক বছর পরে গাজা উপত্যকার বড় অংশ ধ্বংসাবশেষে পরিণত হয়েছে। গাজাবাসী এর কোনো শেষ দেখতে পাচ্ছে না। খবর ডয়চে ভেলে।

দিনটি সম্পর্কে মুঠোফোন বার্তায় ডয়চে ভেলেকে গাজা সিটির উত্তরাঞ্চলের ওয়ার্দা ইউনিস বলেন, ‘৭ অক্টোবর রকেটের শব্দে আমাদের ঘুম ভাঙে। ভয়ানক সে শব্দ ও পরিস্থিতির মধ্যে কী হয়েছে তা জানতে আমরা খবর দেখা শুরু করি। সেদিন থেকে যে ভয় শুরু হয়েছে তা এখনো শেষ হয়নি।’

গত বছর ইসরায়েলের দক্ষিণাঞ্চলে হামাসের হামলার পর গাজা উপত্যকার বাসিন্দাদের কিছুই আর আগের মতো নেই। তখন পর্যন্ত ইসরায়েল ও মিসর গাজা ছিটমহলের সীমানা কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করেছে। কিন্তু ৭ অক্টোবর হামাস নেতৃত্বাধীন গোষ্ঠীর রকেট হামলা চালিয়ে সীমান্ত প্রাচীর ভেঙে দক্ষিণ ইসরায়েলের বিভিন্ন সম্প্রদায় ও সামরিক ঘাঁটিতে তাণ্ডব চালায়। ওই হামলায় প্রায় ১ হাজার ২০০ মানুষ নিহত হয় এবং সশস্ত্র গোষ্ঠী ২৫০ জনকে জিম্মি করে গাজায় নিয়ে যায়। ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী একই দিনে পুরো ছিটমহলে ভারী বিমান ও আর্টিলারি হামলা চালায়।

ইউনিস বলেন, ‘যুদ্ধের তৃতীয় দিনে আমি আমার সবচেয়ে ভালো বন্ধুকে হারাই। বোমার আঘাতে তার বাড়ি সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যায়। ওই ঘটনায় আমি মানসিকভাবে সম্পূর্ণ ভেঙে পড়ি।’

২০০৭ সাল থেকে হামাস ও ইসরায়েলের মধ্যে চারবার যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে। সে বছর হামাস ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে গাজার নিয়ন্ত্রণ নিয়েছিল। এর পরও যুদ্ধ এত দীর্ঘস্থায়ী বা বিধ্বংসী হবে তা অনেকেই আশা করেননি।

গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুসারে, গত এক বছরে গাজায় ৪১ হাজার ৪০০ জনেরও বেশি নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে আরো ৯৬ হাজার এবং নিখোঁজ অন্তত ১০ হাজার। উল্লেখ্য, গাজা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় পরিসংখ্যান তৈরির সময় সামরিক ও বেসামরিক আলাদাভাবে গণনা করেনি।

গাজাকে ইসরায়েল অবরুদ্ধ করায় হামলা শুরুর প্রথম কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই সেখানে খাদ্য ও জরুরি সরবরাহ দ্রুত শেষ হয়ে যায়। কয়েক মাস ধরে জাতিসংঘ উত্তর গাজায় বিভিন্ন ত্রাণ সংস্থার দুর্ভিক্ষের আশঙ্কার বিষয় উল্লেখ করে আসছিল। তবে তা অস্বীকার করে ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ। এ অবস্থায় গাজাবাসীদের মধ্যে অনেকেই ঘাস ও গাছের পাতা খাওয়ার কথা জানায়।

উত্তর গাজায় প্রথম যখন সহায়তা পাঠানো হয়, তখন মানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়ে। হতাহতের ঘটনাও ঘটে। তবে আন্তর্জাতিক চাপেও ইসরায়েল সীমান্তে আরো বেশিসংখ্যক ক্রসিং খুলে দিতে রাজি না হলে আকাশপথে ত্রাণ পাঠানোর ব্যবস্থা করে সংস্থাগুলো। আকাশ থেকে ত্রাণ ফেলার সময় মৃত্যুর ঘটনা ঘটে।

ইউনিস বলেন, ‘আমি নিয়মিত ত্রাণসহায়তা নেয়ার জন্য যেতাম। কিন্তু সেখানে এমনভাবে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করা হতো যে দিনশেষে কিছুই পেতাম না। তবে তখন থেকে খাদ্যের অবস্থা উন্নত হয়েছে। কিন্তু তখন মৃত্যুর সংস্পর্শে যাওয়ার ভয় এখনো রয়ে গেছে।’

ইউনিস ও তার তিন সন্তানকে গত ১২ মাসে নয়বার বাস্তুচ্যুত হতে হয়েছে। গাজার অন্য অনেকের মতো তিনিও ক্রমাগত আশ্রয়ের সন্ধান করতে গিয়ে সময়ের হিসাব হারিয়ে ফেলেছেন।

২০২৩ সালের অক্টোবরের মাঝামাঝি সময়ে ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী উত্তর গাজাবাসীদের দক্ষিণে পালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেয়। উত্তর গাজা এখন নেটজারিম করিডোর থেকে প্রায় পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। করিডোরটি ইসরায়েলচালিত সামরিক চেকপয়েন্ট হিসেবে ব্যবহার হয়। ত্রাণসহায়তা সংস্থার তথ্যমতে, গাজা ছিটমহলের ২২ লাখ মানুষের বেশির ভাগই এখন বাস্তুচ্যুত। তারা গাজার দক্ষিণাঞ্চলে গাদাগাদি করে বসবাস করছে এবং অধিকাংশই দাতব্য সংস্থার ওপর নির্ভরশীল।

ত্রাণকর্মী আমজাদ বলেন, ‘‌গাজায় ত্রাণকর্মী হওয়া বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। অনেকেই সাহায্য করতে গিয়ে মারা গেছেন। গাজার ৬০ শতাংশেরও বেশি বাড়িঘর আগের যুদ্ধগুলোয় ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বর্তমান সংঘাতেও অনেক বাড়িঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী, ইসরায়েলি বিমান হামলা ও স্থল লড়াইয়ের কারণে গাজাজুড়ে চার কোটি টন ধ্বংসস্তূপ তৈরি হয়েছে।’

আরও