দুই মাসের যুদ্ধবিরতির পর ইসরায়েলি সেনাবাহিনী গাজায় নতুন করে হামলা চালাচ্ছে। গত মঙ্গলবার থেকে শুরু করা এ হামলায় নিহতের সংখ্যা পৌঁছে গেছে প্রায় হাজারের কাছাকাছি। এরই মধ্যে ইসরায়েলের সামরিক ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব আরো বড় মাত্রার অভিযান চালানোর পরিকল্পনা করছে। এই পরিকল্পনায় গাজার পুরো অংশ দখলে নিয়ে দীর্ঘ সময়ের জন্য সামরিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে। খবর দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট।
বর্তমান ও সাবেক ইসরায়েলি কর্মকর্তাদের বরাতে জানা গেছে, নতুন কৌশলের মধ্যে মানবিক সহায়তার ওপর সামরিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা, হামাসের বেসামরিক নেতাদের লক্ষ্যবস্তু করা এবং নিরপরাধ নারী, শিশু ও বেসামরিক নাগরিকদের সরিয়ে ‘মানবিক সুরক্ষা অঞ্চল’ তৈরি করে বাকিদের অবরুদ্ধ রাখা থাকতে পারে।
তবে চলমান যুদ্ধবিরতির আলোচনার ফলাফলের জন্য তারা অপেক্ষা করছেন এবং এখনো বড় ধরনের অভিযানের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া হয়নি বলে জানান ইসরায়েলি কর্মকর্তারা। তবে আবারো বড় ধরনের আক্রমণ শুরু হলে গাজার বর্তমান পরিস্থিতি নিঃসন্দেহে আরো গুরুতর হয়ে ওঠবে।
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ১৭ মাস ধরে চলমান এই যুদ্ধে প্রায় ৫০ হাজার ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন, যার অর্ধেকের বেশি নারী ও শিশু। অন্যদিকে, ইসরায়েলের ৪০০-এর বেশি সেনা নিহত হয়েছে।
ইসরায়েলি সামরিক নেতৃত্ব আগে গাজায় দীর্ঘস্থায়ীভাবে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি নিতে চায়নি। তবে এবার ইসরায়েল পূর্ণমাত্রায় হামলা চালালে তা দখলদারিত্ব এবং সন্ত্রাসবিরোধী অভিযানের নতুন পর্যায়ে চলে যাবে। বিশ্লেষকদের মতে, এই ধরনের একটি অভিযান পরিচালনার জন্য ইসরায়েলের পাঁচটি সামরিক ডিভিশনের প্রয়োজন হতে পারে এবং এর ফলে সেনাবাহিনীর ওপর পড়তে পারে অতিরিক্ত চাপ।
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বলেছেন, হামাসকে সম্পূর্ণ নির্মূল করাই তার প্রধান লক্ষ্য। দেশটির সাবেক সামরিক কর্মকর্তা আমির আভিভি বলেন, রাজনৈতিক ও সামরিক নেতৃত্বের মধ্যে মতপার্থক্যের কারণে ২০২৪ সালে ইসরায়েলের অভিযান বাধাগ্রস্ত হয়েছিল এবং বাইডেন প্রশাসন ফিলিস্তিনি বেসামরিক নাগরিকদের ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে নিয়মিত উদ্বেগ প্রকাশ করেছিল। কিন্তু নতুন মার্কিন প্রশাসন ও ইসরায়েলি সামরিক নেতৃত্বের পরিবর্তনের ফলে এই ধরনের সীমাবদ্ধতা আর থাকছে না।
তিনি বলেন, এখন নতুন আইডিএফ নেতৃত্ব, মার্কিন প্রশাসনের সমর্থন, পর্যাপ্ত অস্ত্র মজুদ এবং উত্তরাঞ্চলে আমাদের প্রধান অভিযান শেষ হওয়ায় গাজার দিকে মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করা সম্ভব। এবার হামাসকে সম্পূর্ণ নির্মূল না করা পর্যন্ত অভিযান থামবে না।
ইসরায়েলি কর্মকর্তারা বলছেন, তারা হামাসের সঙ্গে মধ্যস্থতাকারীদের মাধ্যমে আলোচনার জন্য এখনো প্রস্তুত। তবে হামাসের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের হত্যা করার লক্ষ্যে মঙ্গলবার সকালে ইসরায়েল ব্যাপক বিমান হামলা চালায়। প্রতিক্রিয়ায় তেল আবিবে রকেট হামলা চালায় হামাস।
ইসরায়েলি কর্মকর্তারা দাবি করেছেন, যুদ্ধবিরতির চুক্তির একটি ধারা অনুযায়ী আলোচনা ব্যর্থ হলে যুদ্ধ পুনরায় শুরু করা যেতে পারে। হামাস ৪০ দিনের যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে এবং নতুন একটি প্রস্তাব বিবেচনা করছে বলে জানায় নেতানিয়াহু প্রশাসন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পুরো গাজা দখলে নেয়া ইসরায়েলের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। যুদ্ধ বিশেষজ্ঞ সাশা-ডমিনিক ডোভ বাচমান বলেন, আলজেরিয়ায় ফরাসিরা, ইরাকে মার্কিন বাহিনী এবং আফগানিস্তানে ন্যাটো বাহিনীর অভিজ্ঞতা বলছে যে, এমন অভিযান সাধারণত ব্যর্থ হয় এবং এটি ইসরায়েলের নৈতিক অবস্থানকে দুর্বল করবে।
তবে সামরিক অভিযান চালানোর পক্ষে থাকা ব্যক্তিরা বলছেন, হামাস গত বছরের অভিযানের পরেও আবার শক্তি অর্জন করেছে, তাই এবার আরো বড় ধরনের অভিযান চালানো উচিত। নতুন মার্কিন প্রশাসনের সমর্থনের ফলে ইসরায়েল এখন আর বড় ধরনের অস্ত্র সরবরাহের সীমাবদ্ধতার সম্মুখীন হচ্ছে না।
ইসরায়েলের নতুন প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ইসরায়েল কাটজ এবং আইডিএফের চিফ অব স্টাফ ইয়াল জামির আগের তুলনায় অনেক বেশি আগ্রাসী অবস্থানে আছেন। নেতানিয়াহু আগে থেকেই গাজায় মানবিক সহায়তার নিয়ন্ত্রণ সামরিক বাহিনীর হাতে নেয়ার পরিকল্পনা করছিলেন, যা এখন বাস্তবায়নের পথে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, গাজা দখলে নেয়ার ফলে ইসরায়েলকে দীর্ঘমেয়াদে সেখানে সামরিক শাসন চালাতে হবে, যা তৈরি করবে নতুন জটিলতা। সাবেক আইডিএফ গোয়েন্দা কর্মকর্তা ইয়োসি কুপারওয়াসার বলেন, সরকার হামাসকে ক্ষমতা থেকে সরানোর অঙ্গীকার করেছিল। কিন্তু এতে দ্বিধাগ্রস্ত ছিল সামরিক নেতৃত্ব। তবে এখন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ও সামরিক বাহিনীতে পরিবর্তন এসেছে। তাই অভিযান আরো ব্যাপক হতে পারে।