যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নতুন শুল্ক আরোপের প্রতিক্রিয়ায় চীন পাল্টা জবাবে বাণিজ্য যুদ্ধের আশঙ্কা বেড়ে গেছে এবং বৈশ্বিক অর্থনীতিতে পড়েছে নেতিবাচক প্রভাব। বিশ্বজুড়ে শেয়ারবাজারে নেমেছে বড় ধরনের ধস, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রে। দেশটির স্টক মার্কেট ২০২০ সালের কোভিড মহামারির পর সবচেয়ে খারাপ সপ্তাহ পার করেছে। খবর বিবিসি।
যুক্তরাষ্ট্রের তিনটি প্রধান স্টক সূচকে একসঙ্গে ৫ শতাংশের বেশি পতন হয়েছে, যেখানে এসঅ্যান্ডপি ৫০০ প্রায় ৬% কমেছে। যুক্তরাজ্যে এফটিএসই ১০০ সূচক প্রায় ৫% কমে পাঁচ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বড় পতনের মুখে পড়েছে। জার্মানি ও ফ্রান্সের বাজারেও একই রকম ধস দেখা গেছে।
বৈশ্বিক বাণিজ্য ব্যবস্থাকে পুনর্গঠনের প্রতিশ্রুতি দেয়া ট্রাম্প অবশ্য শেয়ারবাজারের পতন নিয়ে উদ্বিগ্ন নন। তিনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লিখেছেন, ধৈর্য ধরুন, আমরা হারতে পারি না।
ট্রাম্পের ঘোষিত ১০% আমদানি শুল্কের কারণে বিশ্বের নানা দেশের পণ্যের ওপর, বিশেষ করে চীন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং ভিয়েতনামের মতো গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য অংশীদারদের বিরুদ্ধে বড় ধরনের শুল্ক আরোপ হয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে এই হার আরো বেশি, যা ১৯৬৮ সালের পর যুক্তরাষ্ট্রে সর্ববৃহৎ কর বৃদ্ধি হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
চীন পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের পণ্যের ওপর ৩৪% শুল্ক আরোপ করেছে, গুরুত্বপূর্ণ খনিজের রফতানি সীমিত করেছে এবং কিছু মার্কিন কোম্পানিকে করেছে কালো তালিকাভুক্ত। চীন ট্রাম্পের এই পদক্ষেপকে ‘বুলিং’ এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্য নীতির লঙ্ঘন বলে মন্তব্য করেছে।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের ট্রেড কমিশনার মারোশ সেফচোভিচ জানিয়েছেন, মার্কিন কর্মকর্তাদের সঙ্গে তার দুই ঘণ্টার খোলামেলা আলোচনা হয়েছে। তিনি বলেন, ইইউ গঠনমূলক আলোচনায় আগ্রহী, তবে প্রয়োজনে নিজেদের স্বার্থ রক্ষায় প্রস্তুত।
এই পদক্ষেপগুলো বিশ্লেষকদের অনেকেরই ধারণার চেয়েও বড়। এর ফলে শুধু প্রযুক্তি বা পোশাক খাতই নয়, ভোগ্যপণ্য, স্বাস্থ্যসেবা ও ইউটিলিটি খাতেও বড় ধরনের পতন দেখা গেছে।
জেপি মর্গান জানিয়েছে, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার সম্ভাবনা ৪০% থেকে বেড়ে ৬০% হয়েছে। ট্রাম্পের শুল্কনীতি যুক্তরাষ্ট্রের প্রবৃদ্ধি দুই শতাংশ পর্যন্ত কমিয়ে দিতে পারে বলেও আশঙ্কা করছে প্রতিষ্ঠানটি।
অন্যদিকে কিছু বিনিয়োগকারী মনে করছেন, এই পতনের আগে যুক্তরাষ্ট্রের শেয়ারবাজার অতিমূল্যায়িত হয়ে পড়েছিল। টেনেসিভিত্তিক সংস্থা ক্যাপওয়েলথের সিইও টিম পাগলিয়ারার ভাষায়, বাজার ওঠার চেয়ে নামতে অনেক বেশি সময় নেয় না।
ফেডারেল রিজার্ভের প্রধান জেরোম পাওয়েল বলেন, অর্থনীতি এখনো মজবুত, তবে অনিশ্চয়তা অনেক বেশি। তিনি সতর্ক করে বলেন, শুল্কহার পূর্বাভাসের চেয়ে অনেক বেশি হওয়ায় দাম বাড়বে এবং প্রবৃদ্ধি কমবে।
নিউ জার্সির এক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী প্যাট মুসকারিটোলো জানান, শুল্ক বৃদ্ধির ফলে তিনি ৪০ বছর ধরে চালানো অ্যাপ্লায়েন্স দোকান বন্ধ করতে বাধ্য হতে পারেন। রেফ্রিজারেটরের মতো পণ্যের দাম ৩০% থেকে ৪০% পর্যন্ত বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন তিনি।
তবে কিছু খাত, যেমন গৃহঋণ-সম্পর্কিত কোম্পানি, সম্ভাব্য সুদের হার কমার আশায় সামান্য লাভ করেছে। ভিয়েতনামের নেতার সঙ্গে ট্রাম্পের কথোপকথনের পর পোশাক খাতেও কিছুটা পুনরুদ্ধার হয়েছে।
বাণিজ্য যুদ্ধের ফলে বিশ্বজুড়ে শেয়ারবাজারের দরে দেখা গেছে নেতিবাচক প্রভাব। ডাও জোনসের শেয়ারের দর ৫.৫% কমেছে। ফেব্রুয়ারির সর্বোচ্চ দর থেকে ১০% কমেছে। নাসডাকের দর ৫.৮% কমেছে। ফলে ডিসেম্বর থেকে দর কমেছে প্রায় ২০%। এফটিএসইয়ের (যুক্তরাজ্য) পতন ৪.৯%, যা ২০২০ সালের পর সর্বোচ্চ। সিএসি ৪০ (ফ্রান্স) ৪.৩% কমেছে। ডিএএক্সের (জার্মানি) পতন প্রায় ৫%। নিক্কেই ২২৫ (জাপান) এর দর কমেছে ২.৭%। দেশটির প্রধানমন্ত্রী একে “জাতীয় সংকট” বলেছেন। এছাড়া, ব্রেন্ট ক্রুড ওয়েলের শেয়ার দর কমেছে প্রায় ৬%।
টেক্সাসের রিপাবলিকান সিনেটর টেড ক্রুজ বলেন, এই পদক্ষেপে (শুল্ক যুদ্ধ) কিছু সুবিধা থাকলেও বিপদ অনেক বড়। যদি শিগগিরই এই বাণিজ্য যুদ্ধ না থামে, তবে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য এটি ভয়াবহ হবে বলে সতর্ক করেন তিনি।
ফকল্যান্ড দ্বীপপুঞ্জের একটি মৎস্য রফতানিকারক কোম্পানির ব্যবস্থাপক জানেট রবার্টসন জানান, যুক্তরাষ্ট্রে টুথফিশ রফতানির ওপর নতুন ৪২% কর বসায় তাদের ব্যবসা ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে।