গ্যাস্ট্রোপেরেসিস

পাকস্থলীর প্যারালাইসিস গ্যাস্ট্রোপেরেসিস

আমাদের দেহের পরিপাকতন্ত্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ পাকস্থলী। অন্ননালি ও ক্ষুদ্রান্ত্রের মাঝে এটি অবস্থিত। আমরা প্রতিদিন যে খাবার খাই তা পাকস্থলীতে জমা হয়। অতঃপর পাকস্থলীর পেশিগুলোর সংকোচন ও প্রসারণের মাধ্যমে খাদ্য পিষ্ট হয়ে ক্ষুদ্রান্ত্রে পৌঁছায়। কোনো কারণে পাকস্থলীতে খাদ্য পরিপাক প্রক্রিয়া ব্যাহত হলে বা পাকস্থলী থেকে খাদ্য নির্দিষ্ট সময়ে ক্ষুদ্রান্ত্রে না গেলে গ্যাস্ট্রোপেরেসিসের নানা উপসর্গ দেখা দেয়।

গ্যাস্ট্রোপেরেসিস কী?

গ্যাস্ট্রোপেরেসিস হলো পাকস্থলী স্থবির বা নিষ্ক্রিয় হয়ে যাওয়ার মতো একটি অবস্থা। পাকস্থলীর প্যারালাইসিস নামেও রোগটি পরিচিত। এ রোগে পাকস্থলীর পেশিগুলোর সংকোচন ও প্রসারণ বাধাপ্রাপ্ত হয়। ফলে পাকস্থলী থেকে খাবার ক্ষুদ্রান্ত্রে পৌঁছাতে দীর্ঘ সময় লাগে। কখনো কখনো খাবার পাকস্থলীতেই জমা হয়ে থাকে। দীর্ঘদিন গ্যাস্ট্রোপেরেসিসের সমস্যায় ভুগলে নানা শারীরিক জটিলতা দেখা দিতে পারে।

গ্যাস্ট্রোপেরেসিসের কারণ

আমাদের শরীরের স্নায়ুতন্ত্রে ভেগাস নার্ভ নামে একটি স্নায়ু রয়েছে। এটি মস্তিষ্ক, হৃৎপিণ্ড ও পাকস্থলীর মধ্যে সংযোগ রক্ষা করে। ভেগাস নার্ভ পাকস্থলীর পেশিগুলোকে সংকুচিত হতে এবং খাদ্যকে ক্ষুদ্রান্ত্রে পৌঁছাতে ভূমিকা রাখে। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি ডায়াবেটিসের কারণে অটোনমিক নিউরোপ্যাথি হয়ে ভেগাস নার্ভ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। আবার পাকস্থলী ও ক্ষুদ্রান্ত্রে কোনো অস্ত্রোপচারের সময়ও এ নার্ভের ক্ষতি হতে পারে। ফলে খাদ্য পরিপাকে বিঘ্ন ঘটে এবং গ্যাস্ট্রোপেরেসিসের সমস্যা দেখা দেয়। এছাড়া পারকিনসন ও মাল্টিপল স্কেলেরোসিসের মতো কিছু স্নায়ুরোগের কারণেও এ রোগ হওয়ার আশঙ্কা থাকে। অনেক সময় ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণও গ্যাস্ট্রোপেরেসিসের কারণ হতে পারে। পাশাপাশি নিয়মিত ব্যায়াম বা হাঁটাচলার অভ্যাস না থাকলে পাকস্থলীতে খাবার হজমে সমস্যা হয়। ফলে এ রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়। সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, ওজন কমাতে ব্যবহৃত কিছু ওষুধ পাকস্থলীর কার্যকলাপে বাধা সৃষ্টি করে। এ ওষুধ পাকস্থলীর পেশিগুলোকে দুর্বল করে দেয়, ফলে খাবার ক্ষুদ্রান্ত্রে পৌঁছতে পারে না।

লক্ষণ ও উপসর্গ

গ্যাস্ট্রোপেরেসিসের লক্ষণগুলোর মধ্যে রয়েছে—

  • বমি ভাব বা বমি
  • খাবারে অরুচি
  • পেট ফুলে থাকা
  • পেটে ব্যথা ও অস্বস্তিকর অনুভূতি
  • অল্প পরিমাণ খাবার খেলেই পেট ভরে যাওয়া
  • টক ঢেঁকুর ওঠা ও অম্বল
  • ওজন কমে যাওয়া
  • রক্তে শর্করার মাত্রার পরিবর্তন

গ্যাস্ট্রোপেরেসিসের কারণে যেসব জটিলতা দেখা দেয়

সঠিক সময়ে যথাযথ চিকিৎসা ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে গ্যাস্ট্রোপেরেসিসের কারণে বিভিন্ন শারীরিক জটিলতা দেখা দিতে পারে। যেমন—

অপুষ্টি: গ্যাস্ট্রোপেরেসিস রোগে খাবার পরিপাকে দেরি হওয়ায় খাবার থেকে পর্যাপ্ত পুষ্টি গ্রহণ করা যায় না। ফলে রোগী অপুষ্টিতে ভোগে।

পানিশূন্যতা: এ রোগে কিছু খেলেই বমি হয় বা বমি হওয়ার উপক্রম হয়। ফলে দেহে তরলের ঘাটতি হয়ে পানিশূন্যতা দেখা দেয়।

হাইপোগ্লাইসেমিয়া ও হাইপারগ্লাইসেমিয়া: গ্যাস্ট্রোপেরেসিস হলে রক্তে শর্করার মাত্রা ক্রমাগত ওঠানামা করে। ফলে হাইপোগ্লাইসেমিয়া ও হাইপারগ্লাইসেমিয়ার মতো জটিলতা সৃষ্টি হয়, যা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীর জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ।

অন্ত্রে ব্যাকটেরিয়ার অতিরিক্ত বৃদ্ধি: পাকস্থলীতে জমে থাকা খাবারের কারণে ক্ষতিকারক ব্যাকটেরিয়ার সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। ফলে সংক্রমণজনিত রোগ ও অন্যান্য হজমসংক্রান্ত সমস্যা দেখা দেয়।

বিজ়োর তৈরি: গ্যাস্ট্রোপেরেসিসের কারণে অনেক সময় নির্দিষ্ট কিছু খাবার পাকস্থলীতে দীর্ঘদিন জমতে জমতে শক্ত চাকার মতো হয়ে যায়। এটিকে বিজোর বলে। পাকস্থলী থেকে এ বিজোর জাতীয় উদ্ভট আকৃতির জিনিস বের করতে অনেক সময় অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন হয়।

রোগ নির্ণয়

গ্যাস্ট্রোপেরেসিস নির্ণয়ে সবচেয়ে প্রচলিত ও গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা গ্যাস্ট্রিক এমটি সিনটিগ্রাফি। একজন বিশেষজ্ঞ রেডিওলজিস্ট পরীক্ষাটি করে থাকেন। পরীক্ষাটি করার কমপক্ষে ৪ ঘণ্টা আগে থেকে রোগীকে কোনো প্রকার খাবার বা পানীয় পান করা থেকে বিরত থাকতে হয়। এ পদ্ধতিতে হালকা কোনো খাবার যেমন ডিম বা বিস্কুটে সামান্য পরিমাণ সালফার কোলয়েড মিশিয়ে রোগীকে খেতে দেয়া হয়। তারপর একটি স্ক্যানিং মেশিনের সামনে রোগীকে শোয়ানো হয়। স্ক্যানারে নির্ণয় করা হয় খাদ্যদ্রব্যটি কত সময়ে পাকস্থলী থেকে অন্ত্রে যাচ্ছে। খাওয়ার ৪ ঘণ্টা পরও যদি ১০ শতাংশের বেশি খাবার পাকস্থলীতে থেকে যায় তাহলে রোগী গ্যাস্ট্রোপেরেসিসে আক্রান্ত। এছাড়া এন্ডোস্কোপির মাধ্যমেও এ রোগ শনাক্ত করা হয়।

গ্যাস্ট্রোপেরেসিসের চিকিৎসা

গ্যাস্ট্রোপেরেসিসের কারণ ও তীব্রতার ওপর ভিত্তি করে চিকিৎসা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। ডায়াবেটিসের কারণে ভেগাস নার্ভে সমস্যা হয়ে এ রোগ হলে রোগীদের প্রথম করণীয় হিসেবে রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখা জরুরি। পাশাপাশি গ্যাস্ট্রোপেরেসিসের ব্যথা কমাতে চিকিৎসকের পরামর্শে ননস্টেরয়েডাল অ্যান্টি-ইনফ্লামেটরি ওষুধ এবং ট্রাইসাইক্লিক অ্যান্টিডিপ্রেশেন্ট ওষুধ সেবন করা যেতে পারে। বমি ভাব নিয়ন্ত্রণে রাখতে প্রোমেথাজিন ও মেটোক্লোপ্রামাইড ওষুধ বিশেষ কার্যকর। এছাড়া এ রোগ উপশমে কিছু অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ রয়েছে, যা পাকস্থলীর পেশিগুলোকে সংকুচিত করে খাদ্য পরিপাকে সাহায্য করে। অনেক সময় রোগের তীব্রতা খুব বেশি ও দীর্ঘদিন হলে অস্ত্রোপচার বা গ্যাস্ট্রেক্টমি করার প্রয়োজন হতে পারে।

প্রতিরোধে করণীয়

গ্যাস্ট্রোপেরেসিস প্রতিরোধে দৈনন্দিন জীপনযাপনে আনতে হবে নিয়ন্ত্রণ এবং মেনে চলতে হবে কিছু নিয়ম। যেমন—

  • একবারে বেশি না খেয়ে অল্প করে বারবার খেতে হবে
  • খাবার ভালোভাবে চিবিয়ে খেতে হবে
  • সহজে হজম হয় এমন খাবার খেতে হবে
  • শাকসবজি, মাছ-মাংস ভালোভাবে সিদ্ধ করে রান্না করতে হবে
  • পর্যাপ্ত পানি পান করতে হবে
  • তরলের ঘাটতি পূরণে স্যুপ ও ফলের রস খাওয়া যেতে পারে
  • খাবার খাওয়ার অন্তত ২-৩ ঘণ্টা পর ঘুমাতে যেতে হবে
  • নিয়মিত ব্যায়াম করতে হবে
  • ধূমপান ও মদ্যপান ত্যাগ করতে হবে

লেখক: মেডিসিন, পরিপাকতন্ত্র ও লিভার ব্যাধি বিশেষজ্ঞ

ল্যাবএইড স্পেশালাইজড হাসপাতাল

আরও