প্রবীণ বলতে আমরা সাধারণত বুঝি ষাটোর্ধ্ব মানুষদের। এ সময় বার্ধক্য বা এ জাতীয় রোগ বাড়তে থাকে। প্রবীণরা বায়োলজিক্যাল কারণে বিভিন্ন দীর্ঘমেয়াদি জটিলতায় ভোগেন। এর মধ্যে প্রধান স্বাস্থ্য সমস্যাগুলো নন-কমিউনিকেবল ডিজিজ।
নন-কমিউনিকেবল ডিজিজগুলোর মধ্যে প্রথমেই আসে উচ্চ রক্তচাপ। উচ্চ রক্তচাপের পেছনে বয়সজনিত কারণে রক্তনালির যে পরিবর্তন তা দায়ী। উচ্চ রক্তচাপে আমাদের প্রবীণরা বেশি ভোগেন। এছাড়া আরো নানা ধরনের নন-কমিউনিকেবল ডিজিজে তারা আক্রান্ত হন। উচ্চ রক্তচাপ এ রোগগুলোর ঝুঁকির মাত্রা আরো বাড়িয়ে দেয়। যেমন হার্ট অ্যাটাক বা স্ট্রোক। রক্তচাপ একটি নন-কমিউনিকেবল ডিজিজ, যেটা বয়স্কদের মধ্যে বেশি দেখা যায়।
এর পরেই আসে ডায়াবেটিস। ডায়াবেটিস বর্তমানে আমরা বয়স্ক ছাড়াও তরুণদের মধ্যে দেখতে পাই। যারা তরুণ বয়সে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়, বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তাদের ডায়াবেটিস অনিয়ন্ত্রিত হয়ে যায়। এ অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস থেকে বিভিন্ন রকম শারীরিক জটিলতা তৈরি হয়। যেমন কিডনি, লিভার, হার্ট ও ব্রেনের নানা রকম জটিলতা। সেই সঙ্গে রক্তনালিতেও নানা রকম জটিলতা দেখা দেয়। হৃদরোগ একটি গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর। যাদের উচ্চ রক্তচাপ থাকে তাদের ক্ষেত্রেই দেখা যায় ডায়াবেটিসের আশঙ্কা বেশি। এছাড়া ৬০-৭০ বছর বয়সী অনেক রোগীর মধ্যে আমরা হৃদরোগের কারণে নানা রকম জটিলতা দেখি।
আরেকটি যে কারণ আমরা বলতে চাই সেটা হলো স্থূলতা। স্থূলতার কারণে নানা রকম জটিলতা তৈরি হয়। যেমন স্থূলতার কারণে হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ে, ডায়াবেটিস অনিয়ন্ত্রিত থাকে। স্থূলতার কারণে অস্টিওআর্থ্রাইটিস নামের একটি রোগ হয়। এটি হলো হাড়ের জয়েন্টে একধরনের ব্যথা। অস্টিওপোরোসিস নামের আরেকটি রোগ আছে। এর কারণে হাড়ের ক্ষয় হয়। এটার নানা কারণ থাকলেও বয়স্কদের এ রোগে বেশি আক্রান্ত হতে দেখা যায়। এছাড়া নারীরাও এ রোগে ভোগেন।
এছাড়া ক্রনিক ব্রংকাইটিস ডিজিজ অথবা ফুসফুসের নানা রকম প্রদাহ রয়েছে। যেমন দীর্ঘস্থায়ী অ্যাজমা বা সিওপিডি (ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজ)। বয়স্কদের এ ধরনের রোগে ভোগার প্রবণতা বাড়ে। প্রবীণদের সিওপিডি বা গ্যাস্ট্রিকের রোগ বেশি দেখা যায়। যারা ধূমপান করে তাদের এ ধরনের রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি। যারা ধূমপান ও তামাকজাত পণ্য ব্যবহার করেন, তাদেরও একইভাবে হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে। তাছাড়া বয়স্কদের মধ্যে শ্রবণশক্তি কমে যাওয়ার সমস্যা দেখা যায়। যার কারণে তারা যোগাযোগসংক্রান্ত নানা সমস্যার সম্মুখীন হয়। আরেকটি প্রধান রোগ হলো দৃষ্টিশক্তির সমস্যা। চোখে ছানি পড়ে, এটা আসলে বয়স্কদের সমস্যা। এছাড়া মূত্রথলিতে সমস্যা দেখা দেয়। প্রোস্টেট গ্রন্থির কারণে মূত্রথলিতে সমস্যা দেখা দেয়। তাদের প্রস্রাব ধরে রাখার ক্ষমতা কমে যায় বা বারবার প্রস্রাব করার প্রবণতা দেখা দেয়।
বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ক্যান্সারের ঝুঁকিও বেড়ে যায়। বয়স্কদের জন্য ক্যান্সার খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি নন-কমিউনিকেবল ডিজিজ।
বেশির ভাগ বয়স্কই বিষণ্নতায় ভোগেন। আর্থিক ও পারিবারিক নানা কারণে এ বিষণ্নতা বা হতাশা দেখা দেয়। সেই সঙ্গে ডিমেনশিয়া বা স্মৃতিশক্তি ক্ষয়ে যাওয়ার প্রবণতা থাকে। অনেক বিষয় তারা মনে রাখতে পারেন না, যার কারণে তারা পারিবারিক ও সামাজিক বিষয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকতে পারেন না।
প্রতিকার
যে ডিজিজগুলো মধ্যবয়সে বা বয়স্কদের মাঝে দেখা দেয় সেগুলো নানাভাবে প্রতিকার করা যায়:
ডায়াবেটিস থাকলে তা নিয়ন্ত্রণে রাখা।
উচ্চ রক্তচাপ থাকলে তা যতটা সম্ভব নিয়ন্ত্রণে রাখা।
স্বাস্থ্যসম্মত খাদ্যাভ্যাস গড়ে তোলা।
নিয়মিত শরীরচর্চা করা।
পর্যাপ্ত ঘুম ও বিশ্রাম নেয়া।
চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কোনো ওষুধ না খাওয়া।
পরিবারের সদস্যের সঙ্গে আনন্দময় সময় কাটানো।
শারীরিক কোনো সমস্যা হলে পরিবারের সদস্য এবং চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলে তাৎক্ষণিকভাবে তা সমাধান করতে হবে। চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। প্রবীণদের শারীরিক সমস্যা সমাধানের জন্য পরিবারের সদস্যরা অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। প্রবীণদের স্বাস্থ্যগত দিকে নজর রাখা হলে তারা আরো সুন্দর ও সুস্থভাবে জীবনযাপন করতে পারবেন। প্রবীণদের যথাযথ মূল্য দিতে হবে এবং তাদের স্বাস্থ্যবিষয়ক বিষয়গুলোয় গুরুত্ব দিতে হবে। পরিবার থেকে হোক, সমাজ থেকে হোক বা রাষ্ট্র থেকে—সেটা আমাদের নিশ্চিত করতে হবে।
লেখক: বিভাগীয় প্রধান,
কমিউনিটি মেডিসিন ও পাবলিক হেলথ বিভাগ ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ