আতিক ও আশরাফ হত্যাকাণ্ড

উত্তর প্রদেশে সাম্প্রতিক অস্থিরতার নেপথ্যে

ফেব্রুয়ারির ২৫ তারিখ। আইনসভায় বক্তব্য পেশ করছেন ভারতের উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ। এক পর্যায়ে তিনি শপথ করে বলেন, ‘আইনসভায় আমি বলছি যে, এ মাফিয়াকে আমি ধুলায় মিশিয়ে দেব।’

ফেব্রুয়ারির ২৫ তারিখ। আইনসভায় বক্তব্য পেশ করছেন ভারতের উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ। এক পর্যায়ে তিনি শপথ করে বলেন, ‘আইনসভায় আমি বলছি যে, এ মাফিয়াকে আমি ধুলায় মিশিয়ে দেব।’

গ্যাংস্টার থেকে রাজনীতিতে এসেছিলেন দুই ভাই। সমাজবাদী পার্টির প্রাক্তন লোকসভা সদস্য আতিক আহমেদ ও তার ভাই আশরাফ আহমেদ। গত শনিবার উত্তর প্রদেশের প্রয়াগরাজের এক হাসপাতালে তাদেরকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। পুলিশের কড়া পাহারা ছিল। পথিমধ্যে গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলার জন্য তারা থামেন। তখন তিনজন আততায়ী একেবারে কাছ থেকে তাদেরকে গুলি করে হত্যা করে। এ ঘটনায় একজন সাংবাদিক ও একজন পুলিশ কনস্টেবলও আহত হন। ভারতীয় গণমাধ্যম এনডিটিভির প্রতিবেদনে জানা যায়, আততায়ীরা গুলি করার সময়জয় শ্রীরাম’ বলে চিৎকার করেছিল। তাদের নাম জানা গেছে। লাভলেশ তিওয়ারি, সানি মৌর্য ও অরুণ মৌর্য। তারা প্রতিবেদকের ছদ্মবেশে গণমাধ্যমকর্মীদের ভিড়ে মিশে ছিল। পুলিশকে উদ্ধৃত করে ইনডিয়ান এক্সপ্রেস এক প্রতিবেদন জানায়, আততায়ীরা দাবি করেছে যে, তারা বিখ্যাত হওয়ার জন্য আতিক ও আশরাফকে হত্যা করেছে।

আতিক আহমেদের বিরুদ্ধে প্রায় ১০০টি মামলা ছিল। সবশেষ আইনজীবী উমেশ পালকে হত্যার অভিযোগে মামলা হয় তার বিরুদ্ধে। ২০০৫ সালে বহুজন সমাজ পার্টির এমএলএ রাজু পাল খুন হন। উমেশ পাল ছিলেন সে খুনের প্রত্যক্ষদর্শী। ২৪ ফ্রেব্রুয়ারি প্রয়াগরাজে উমেশ পালকে গুলি করে হত্যা করা হয়। কয়েকদিন পরেই উত্তর প্রদেশ পুলিশ আতিক আহমেদ, তার স্ত্রী শাহিস্তা পারভিন, তাদের দুই সন্তান এবং আশরাফ আহমেদকে উমেশ পালের হত্যায় জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেফতার করে। উমেশ পাল হত্যার পরের দিনই আইনসভায় দাঁড়িয়ে কথাগুলো বলেছিলেন যোগী আদিত্যনাথ। এখানে মাফিয়া বলতে তিনি আহমেদ ভাইদের দিকেই ইঙ্গিত করেছেন।

মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্যের কয়েকদিনের মধ্যেই উমেশ পাল হত্যায় অভিযুক্তরা পুলিশের এনকাউন্টারে মারা যেতে লাগলেন। ২৭ ফেব্রুয়ারি আরবাজ নামে এক অভিযুক্ত পুলিশের সঙ্গে এনকাউন্টারে মারা যান। ৭ মার্চ উত্তর প্রদেশ পুলিশের সঙ্গে এক বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন বিজয় চৌধুরী। সবশেষ শনিবার পালের গোদা আতিক আহমেদ ও তার ভাই আশরাফ আহমেদ সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত হন। সংসদে যোগীর বক্তব্য, পুলিশের এনকাউন্টার এবং সন্ত্রাসী হামলার মধ্যে যোগসূত্র আছে বলে বিভিন্ন মহলে গুঞ্জন চলছে।

গুজরাটের জেলে ছিলেন আতিক ও আশরাফ। সেখান থেকে তাদেরকে উত্তর প্রদেশে নিয়ে যাওয়ার আদেশ দেওয়া হয়। কিন্তু এ আদেশকে চ্যালেঞ্জ করে তা প্রত্যাহারের জন্য সুপ্রিম কোর্টে আবেদন জানান তারা। কারণ হিসেবে তারা জীবনের ঝুঁকির কথা বলেন। তারা দাবি করেন, উত্তর প্রদেশ পুলিশ তাদেরকে এনকাউন্টারে মেরে ফেলতে পারে। কিন্তু বিচারপতি অজয় রাস্তোগি ও বেলা এম ত্রিবেদীর বেঞ্চ তাদের আবেদন খারিজ করে দেন।

আতিক আহমেদ ও আশরাফ আহমেদের হত্যাকাণ্ড যেন সিনেমার দৃশ্যকেও হার মানায়। উত্তর প্রদেশে তাদের পায়ের তলায় মাটি ছিল না। তাদের এ পরিণতি যেন অবশ্যম্ভাবীই ছিল। মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্যে তার আঁচ পাওয়া যায়। পাশাপাশি বিজেপির প্রাক্তন সংসদ সদস্য হরিনারায়ণ রাজভারের কথাও স্মরণ করা যেতে পারে। ৯ মার্চ তিনি বলেছিলেন যে, আতিক আহমেদকে এনকাউন্টারে হত্যা করা উচিৎ। তিনি বলেন, ‘জেল থেকে বের করে আতিক আহমেদকে এনকাউন্টারে হত্যা করা উচিৎ। যে পুলিশ কর্মকর্তা এটি করবে, তার জন্য স্বর্গের দুয়ার খুলে দেয়া হবে। বোঝাই যাচ্ছে, আহমেদ ভাইদের আশঙ্কা অমূলক ছিল না। একইভাবে প্রতিমন্ত্রী জেপিএস রাঠোর মার্চে বলেন যে, আতিক আহমেদকে বহনকারী গাড়ি উল্টে যেতে পারে। এ কথার মাধ্যমে ২০২০ সালের জুলাই মাসে গ্যাংস্টার বিকাশ দুবের হত্যাকাণ্ডের দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে। উত্তর প্রদেশ পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে মারা যান বিকাশ দুবে। কর্তৃপক্ষ তখন জানিয়েছিল, বিকাশকে বহনকারী গাড়িটি উল্টে যাওয়ার পর সে পালানোর চেষ্টা করেছিল। মোট কথা, রাঠোরের মন্তব্যেও আতিক আহমেদকে এনকাউন্টার করার দিকেই ইঙ্গিত। রাঠোরের কথায় প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিলেন সমাজবাদী পার্টির নেতা অখিলেশ যাদব। ২৬ মার্চ তিনি বলেন, ‘মুখ্যমন্ত্রী (আদিত্যনাথ) তাকে (রাঠোর) আগেই বলে থাকবেন, কোথায় এবং কীভাবে গাড়িটি উল্টে যাবে।’

তবে আতিক আহমেদ ও আশরাফ আহমেদ হত্যার ঘটনায় উচ্চপর্যায়ের তদন্ত করার আদেশ দিয়েছেন যোগী আদিত্যনাথ। তিনি তিন সদস্য বিশিষ্ট একটি জুডিশিয়াল কমিশন তৈরি করেছেন। উত্তর প্রদেশের সব জেলায় বড় ধরনের সকল জমায়েত নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

আতিক ও আশরাফ হত্যার ঘটনায় বিরোধীরা উত্তর প্রদেশ সরকারের সমালোচনা করছেন। তারা এটিকে রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির স্পষ্ট অবনতি বলে উল্লেখ করেছেন।

২০১৭ সালে বিজেপি সরকার উত্তর প্রদেশের ক্ষমতায় আসে। তারপর থেকেই বিচারবহির্ভূত হত্যার ঘটনা বেড়ে গেছে। অফিসিয়াল রেকর্ড থেকে জানা যায়, ২০১৭ সালের মার্চ থেকে ২০২১ সালের আগস্ট পর্যন্ত মোট ৮৫০০টি এনকাউন্টারের ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় প্রায় ১৫০ জন মারা যান। উত্তর প্রদেশের জনসংখ্যায় মুসলমানদের অনুপাত ২০ শতাংশেরও কম। কিন্তু পুলিশের তথ্য থেকে জানা যায়, এনকাউন্টারে মারা যাওয়া লোকদের ৩৭ শতাংশই মুসলমান। 


স্ক্রল.ইন অবলম্বনে। 

আরও