শ্রদ্ধাঞ্জলি

মহিউদ্দিন আহমেদ একটি প্রতিষ্ঠানের নাম

আমরা সাধারণ মানুষেরা মানুষই থেকে যাই, ‘প্রতিষ্ঠান’ হয়ে উঠতে পারি না। কিন্তু কোনো কোনো বিশেষ মানুষ তাদের অনন্যসাধারণ কর্মযজ্ঞের দ্বারা একটি প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত হন। তাদের প্রত্যেকেই হয়ে ওঠেন একেকটি বাতিঘর, যারা আমাদের পথনির্দেশ দেন। এ কথাগুলো বিশেষ করে মনে হলো সদ্যপ্রয়াত মহিউদ্দিন ভাইয়ের কথা ভেবে। বাংলাদেশের প্রকাশনা জগতে মহিউদ্দিন

আমরা সাধারণ মানুষেরা মানুষই থেকে যাই, ‘প্রতিষ্ঠানহয়ে উঠতে পারি না। কিন্তু কোনো কোনো বিশেষ মানুষ তাদের অনন্যসাধারণ কর্মযজ্ঞের দ্বারা একটি প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত হন। তাদের প্রত্যেকেই হয়ে ওঠেন একেকটি বাতিঘর, যারা আমাদের পথনির্দেশ দেন। কথাগুলো বিশেষ করে মনে হলো সদ্যপ্রয়াত মহিউদ্দিন ভাইয়ের কথা ভেবে। বাংলাদেশের প্রকাশনা জগতে মহিউদ্দিন আহমেদ ছিলেন একজন মহীরুহ।

মহিউদ্দিন ভাইয়ের সঙ্গে আমার পরিচয় সত্তরের দশকের প্রথম দিকে। আমার শিক্ষক প্রয়াত অধ্যাপক মুশাররফ হোসেনের ফুলার রোডের সেই বিখ্যাত বাড়ির দোতলার খোলা বারান্দায়। আমাদের স্নাতক পরীক্ষার ফল তখন সবে বেরিয়েছে। কেন জানি, ভালো ফলাফলের ছাত্রদের তিনি এক বিশেষ স্নেহার্দ্র দৃষ্টিতে দেখতেন। হয়তো তার বিদ্যানুরাগ এর পেছনে কাজ করেছে। সেই প্রথম দেখাতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে আমাদের আগের পাঁচ বছরের স্নাতকে প্রথম শ্রেণীপ্রাপ্ত সব কজনার নাম বলে তিনি আমাকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন। আমি নিশ্চিত যে ইংরেজি কিংবা ইতিহাস বিভাগের ক্ষেত্রেও কাজটি তিনি অনায়াসে করতে পারবেন। পরবর্তী জীবনে বহু পরেও বহুবার তিনি আমার বিশ্ববিদ্যালয় পরীক্ষার ফল এক গর্বিত মমতার সঙ্গে উল্লেখ করতেন।

আমার ব্যাপারে মহিউদ্দিন ভাইয়ের আরেক বলার বিষয় ছিল আমার বিতর্ক করা। তিনি ইংরেজি বিতর্ক যুগের মানুষ কিন্তু স্বাধীনতা-পরবর্তী যুগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিতর্ক প্রচলন তার জননন্দিতকরণের ক্ষেত্রে আমাদের জনার ভূমিকার কথায় উচ্চকিত ছিলেন। মনে আছে ১৯৭৪ সালে আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় বিতর্ক প্রতিয়োগিতায় আমার বিতর্ক শুনতে ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের মিলনায়তনে দর্শকদের প্রথম সারিতে তিনি বসেছিলেন। বড় ভালো লেগেছিল।

আশির দশকের প্রথম দিকে উচ্চশিক্ষা শেষে বিদেশ থেকে ফিরে এলে মহিউদ্দিন ভাইয়ের সঙ্গে আবার নতুন করে যোগসূত্র স্থাপিত হয়। মনে আছে, বাংলাদেশ অবজারভারে সম্পাদকীয় বিভাগে খণ্ডকালীন লেখক হিসেবে কাজ করার সময়ে মাঝেমধ্যেই সেখানে কাজ-আড্ডা শেষে বেতার অনুষ্ঠান নিয়ে আলোচনার জন্য চলে যেতাম কৌশিকের (বাংলাদেশ বেতারের স্বর্ণকণ্ঠ বালক কৌশিক আহমেদ) কাছে। কৌশিক তখন কাজ করত পদ্মা প্রিন্টার্সে। মতিঝিলে কৌশিকের দপ্তরের কৌণিক অবস্থানেই ছিল মহিউদ্দিন ভাইয়ের ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড (ইউপিএল) কৌশিকের ওখান থেকে রাস্তা পেরিয়ে চলে যেতাম ইউপিএলে।

দুটো জিনিস সেখানে অবধারিতভাবেই হতো। এক. মধ্যাহ্নভোজের সময়ে ওখানে গেলে কখনো না খেয়ে আসতে পারিনি এবং মহিউদ্দিন ভাই তার জন্য আনীত খাবার ভাগ করে দিতেন। এমন করে আর কাউকে আমি খাবার ভাগ করে দিতে দেখিনি। দুই. ইউপিএল প্রকাশিত নানা বই তিনি আমার সামনে মেলে ধরতেন। ছাপায়, বাঁধাইয়ে সেগুলো ছিল দৃষ্টিনন্দিত। কিন্তু সবচেয়ে বড় কথা ছিল, বিষয়ের গভীরতায় আর বৈচিত্র্যে প্রতিটি বই- ছিল অনন্য।

বিভিন্ন বিচিত্র বিষয নিয়ে বই প্রকাশ করতে ভালোবাসতেন তিনি। গভীর গবেষণামূলক যেকোনো কাজের প্রতি তার বড় রকমের আগ্রহ ছিল। কোনো এক নতুন বিষয়ের ওপরে কেউ একজন লিখছেন কিংবা কোনো একটি গবেষণা কাজের পাণ্ডুলিপি তৈরা হয়েছে জানলে তিনি তা প্রকাশের জন্য বিবেচ্য কিনা দেখতে চাইতেন। বাংলাদেশের ওপরে যেকোনো কাজের প্রতি তার মমতা আর আগ্রহের সীমা ছিল না। মনে আছে ১৯৯১ সালের দিকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা অধ্যাপক রেহমান সোবহানের উদ্যোগ নেতৃত্বে যখন বিভিন্ন অর্থনীতিবিদের সমন্বয়ে বাংলাদেশ অর্থনীতির নানা দিকের এক বিশ্লেষণধর্মী সমীক্ষা বেরোল, মহিউদ্দিন ভাই সাগ্রহে চার খণ্ডে তা প্রকাশ করলেন। ভাষা আন্দোলনের ওপরে গবেষণাও তিনি প্রকাশ করেছিলেন কয়েক খণ্ডে। প্রতিটি পাণ্ডুলিপি তিনি নিজে পড়তেন এবং ইউপিএল থেকে প্রকাশিতব্য প্রতিটি গ্রন্থের প্রকাশনা তিনি তদারক করতেন।

১৯৯২ সালে জাতিসংঘে যোগদানের পরে মহিউদ্দিন ভাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ কমে এল। বৈশ্বিকমানব উন্নয়ন প্রতিবেদনেরপ্রকাশক ছিল অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস (ওইউপি) এটা তাকে প্রীত করত, কারণ ওইউপি তার পুরনো কাজের জায়গা। মহিউদ্দিন ভাইয়ের সঙ্গে আবার নতুন করে যোগাযোগ স্থাপিত হলো ২০১৫ সাল নাগাদ, যখন তার সুযোগ্য কন্যা মাহরুখ মহিউদ্দিন আমার একটি গ্রন্থ প্রকাশে আগ্রহী হলো। মাহরুখ আমার কন্যা-জামাতারও বন্ধু এবং একত্রে ওরা অনেক সৃজনশীল কর্মকাণ্ডে সংযুক্ত ছিল।

সেই গ্রন্থের কাজ উপলক্ষে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে ইউপিএলের কার্যালয়ে গেলে বহুদিন বাদে মহিউদ্দিন ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হলো। ততদিনে তিনি দীর্ঘ অসুস্থতার শিকার, কিন্তু মন মননের দিক থেকে সেই আগের মতোই দৃঢ়চেতা। তখন তার বিশেষ খাবার বাড়ি থেকে আসে এবং সম্ভবত ভাবী (আমার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এককালীন সহকর্মী অধ্যাপক মেহতাব খানম) সেটা তৈরি করেন। স্বভাবসুলভভাবে সেদিনও মহিউদ্দিন ভাই আমার সঙ্গে খাবার ভাগ করে খেয়েছিলেন।

সেদিন নানান কথার মধ্যে প্রকাশক হিসেবে তার রীতি-নীতি মূল্যবোধ এবং আমাদের প্রকাশনা শিল্পের দায়িত্ব সততা সম্পর্কে তার চিন্তাচেতনার কথা বলেছিলেন মহিউদ্দিন ভাই। মাহরুখ আমি মুগ্ধ হয়েছিলাম। আমার মনে হয়েছিল তার অনেক কথায় সেদিন মাহরুখের জন্য পথনির্দেশ ছিল। ইউপিএলের ঐতিহ্য এবং মূল্যবোধ রক্ষার ব্যাপারে তিনি খুব জোর দিয়েছিলেন। পুরোটা সময় ধরে আমার মনে হয়েছিল, আমি একজন ব্যক্তির কথা শুনছি না, আমি একটি প্রতিষ্ঠানের বাণী শুনছি।

শেষ দেখা হয়েছিল বছর কয়েক আগে, আমি যখন ঢাকায় গিয়েছিলাম বৈশ্বিক মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন উপস্থাপনার জন্য। তিনি অনুষ্ঠানে এসেছিলেন, প্রতিবেদনটির প্রশংসা করেছিলেন এবং বিশেষভাবে বলেছিলেন কোনো কাগজ ব্যতীত আমার ঘণ্টার ইংরেজি বক্তব্যের, যাতে প্রচুর সংখ্যা উপাত্ত ছিল। আমি আপ্লুত হয়েছিলাম।

মহিউদ্দিন আহমেদের প্রয়াণে আমার বারবার মনে হচ্ছে, একটি প্রতিষ্ঠানের সমাপ্তি ঘটল, একটি মহীরুহ চলে গেলেন, যার স্নেহচ্ছায়ায় আমরা আর আশ্রয় পাব না প্রয়োজনে-সংকটে। অমন বাতিঘরের আমাদের এখন যে বড় প্রয়োজন।

 

. সেলিম জাহান: নিউইয়র্কে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন কার্যালয় দারিদ্র্য বিমোচন বিভাগের সাবেক পরিচালক

আরও