বাংলাদেশের বর্তমান অর্থনৈতিক বাস্তবতার নিরিখে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির কিছু প্রাক্কলন করা হয়েছে। অতিসম্প্রতি বিশ্বব্যাংক আভাস দিয়েছে যে ২০২৪-২৫ সালের অর্থবছরে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ৪ দশমিক ১ শতাংশ হতে পারে। এর আগে একই অর্থবছরের জন্য এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট প্রাক্কলিত সংখ্যা ছিল ৫ দশমিক ১ শতাংশ। এসব উপাত্ত থেকে তিনটি বিষয় খুব স্পষ্ট: এক. প্রাক্কলিত প্রবৃদ্ধি বাংলাদেশের বর্তমান বাস্তবতারই প্রতিফলন। দুই. যদিও দেয় উপাত্তের মধ্যে পার্থক্য আছে, কিন্তু বিশ্বব্যাংক ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক উভয়ই তাদের পূর্ব প্রাক্কলিত উপাত্তকে কমিয়ে নিয়ে এসেছে। তিন. বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির প্রাক্কলন আন্তর্জাতিক দুটি সংস্থা করেছে, কিন্তু বাংলাদেশের কোনো সরকারি সংস্থা এখনো এ-জাতীয় প্রাক্কলন করেনি।
গত অর্থবছরে বাংলাদেশের অর্থনীতির বেশকিছু দুর্বলতা বেশ সুস্পষ্ট ছিল এবং উপর্যুক্ত প্রাক্কলনে তা বেরিয়ে এসেছে। যেমন বর্তমান অর্থবছরের জন্য বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের আগের প্রাক্কলন ছিল ৬ দশমিক ৬ শতাংশ, যা বর্তমানে ৫ দশমিক ১ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়েছে। একইভাবে বিশ্বব্যাংকও তাদের আগের প্রাক্কলিত সংখ্যা ৫ দশমিক ৭ শতাংশকে ৪ দশমিক ১ শতাংশে নামিয়ে এনেছে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি-স্থবিরতার তিনটি দিক আছে—গত চার-পাঁচ বছরের বৈশ্বিক ঘটনাগুলোর প্রভাব; সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের ঘটনাপ্রবাহ; এবং দেশের বর্তমান অবস্থা। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি প্রসঙ্গে দুটি পর্যবেক্ষণ অত্যন্ত জরুরি—এক. যদিও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মূল চালিকাশক্তি অর্থনৈতিক, তবুও অর্থনীতিবহির্ভূত বিষয়গুলোও সেই প্রবৃদ্ধিকে প্রভাবিত করে। দুই. দেশের প্রবৃদ্ধি আলোচনায় বর্তমান প্রবৃদ্ধিই শুধু গুরুত্বপূর্ণ নয়, ভবিষ্যৎ প্রবৃদ্ধি সম্ভাবনাও প্রাসঙ্গিক।
এটা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই যে বিশ্বের আর দশটা অর্থনীতির মতোই গত চার-পাঁচ বছরে বৈশ্বিক ঘটনাপ্রবাহ বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি সম্ভাবনাকে প্রভাবিত করেছে। কভিড-১৯ তিন পথে বাংলাদেশ অর্থনীতির ওপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া ফেলেছে। প্রথমত, দেশজ অর্থনীতির পরিপ্রেক্ষিতে, যেখানে মানুষের জীবন ও জীবিকা বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল। দ্বিতীয়ত, অতিমারীর কারণে সরকারি সম্পদের একটি বিরাট অংশ অতিমারী মোকাবেলায় ব্যয়িত হচ্ছিল। ফলে দেশের উৎপাদন খাত ও সামাজিক খাতে সম্পদের ঘাটতি পড়ে যায়। তৃতীয়ত, বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে এ অতিমারী বাংলাদেশের রফতানি বাণিজ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। উদাহরণস্বরূপ, কভিড-১৯-এর কারণে বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের উৎপাদন ও রফতানি উভয়ই ব্যাহত হয়। এসব কারণ বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি গতিধারায় বিরূপ প্রতিক্রিয়া ফেলে। এর পরই এল ইউক্রেন যুদ্ধ, যা বৈশ্বিক জোগান ব্যবস্থাকে পঙ্গু করে দেয়। ফলে বৈশ্বিক বাজারে খাদ্যসামগ্রী ও জ্বালানির মূল্য বেড়ে যায়। যেহেতু বাংলাদেশ খাদ্যসামগ্রী ও জ্বালানি দুটিই আমদানি করে, ফলে এ দুই সামগ্রীর বৈশ্বিক মূল্যবৃদ্ধি বাংলাদেশর অভ্যন্তরীণ মূল্যস্ফীতিকেও বাড়িয়ে দেয়। ফলে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনা বিঘ্নিত হয়।
বিগত কয়েক বছরে বিগত সরকারের প্রবৃদ্ধি পরিপ্রেক্ষিতটি দুটি দিক থেকে দেখা দরকার। তার প্রথমটি হচ্ছে, প্রবৃদ্ধির ওপর প্রকাশিত সরকারি উপাত্তের সঠিকতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা। সে সময়ে প্রবৃদ্ধি বিষয়ে একাধিক উপাত্ত বারবার পরিবর্তিত হয়ে প্রকাশিত ও উপস্থাপিত হচ্ছিল। সেই সঙ্গে বিভিন্ন সরকারি সংস্থা প্রবৃদ্ধি বিষয়ে তাদের নিজ নিজ সংখ্যা উপস্থাপন করছিল। ফলে যেকোনো অর্থবছরের জন্য বিশ্বাসযোগ্য ও অর্থবহ একক একটি সংখ্যা পাওয়া যাচ্ছিল না। দ্বিতীয়টি হচ্ছে, বিগত সরকারের বিশাল অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অত্যন্ত নাজুক হয়ে পড়েছিল। রাষ্ট্রের হঠাৎ হঠাৎ অকারণ ও অযৌক্তিক সিদ্ধান্ত, ব্যাংকিং ব্যবস্থায় সংকট, খেলাপি এবং কু-ঋণ, অর্থ পাচার, অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত এবং বাস্তবায়নে দৃশ্যমানতা ও জবাবদিহিতার অনুপস্থিতি বাংলাদেশ অর্থনীতিতে ব্যাপ্ত দুর্নীতি, অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা এবং নানা ভঙ্গুরতার জন্ম দেয়। স্বাভাবিকভাবেই এ অবস্থায় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি প্রস্ফুটিত হতে পারে না।
বাংলাদেশের বর্তমান রাষ্ট্র কাঠামোর কাছে দায় হয়ে দাঁড়িয়েছে অতীত অর্থনীতির বিশাল এবং গভীর বহু সমস্যা। এসব সমস্যা ও অন্তরায় নানা ধরনের নাজুকতা এ ভঙ্গুরতার জন্ম দিয়েছে এবং এগুলোর সমাধান প্রয়োজন। তবে এরই মধ্যে নানা বিষয়ে উন্নতি লক্ষ করা যাচ্ছে। যেমন বাইরে থেকে অর্থপ্রবাহ বেড়েছে, বৈদেশিক মুদ্রার মজুদের উন্নতি হয়েছে, সম্পদ পাচার আটকানো গেছে। ব্যাংক খাতে, ভেঙে পড়া ব্যাংকগুলো পুনর্গঠনে সহায়তা দেয়া হয়েছে, ব্যাংক পরিচালনা পর্ষদগুলোকে পুনর্বিন্যস্ত করা হয়েছে এবং দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থায় জনগণের আস্থা ও বিশ্বাস অনেকটাই ফিরে এসেছে।
এ সত্ত্বেও বাংলাদেশের বর্তমান অর্থনীতিতে বহু অর্থনৈতিক ও অর্থনৈতিকবহির্ভূত কারণ বিদ্যমান, যা অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির হারকে শ্লথ করেছে। অর্থনৈতিক বলয়ে উচ্চ মূল্যস্ফীতি প্রবৃদ্ধি হারের ওপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া ফেলেছে। বাংলাদেশে বর্তমান মূল্যস্ফীতির হার প্রায় ১০ শতাংশ। বাংলাদেশের প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় এ হার বেশ উঁচু। গত দুই বছরে শ্রীলংকা তার মূল্যস্ফীতির হার ৭০ শতাংশ থেকে ১ শতাংশে নামিয়ে আনতে পেরেছে। যদিও বৈশ্বিক পর্যায়ে মূল্যস্ফীতি হারের প্রবণতা নিম্নমুখী, বাংলাদেশে এ হার বেশ কিছুদিন ধরেই বেশ উঁচু মানে আটকে আছে। মূল্যস্ফীতি প্রবৃদ্ধিকে ক্ষয় করে।
বিভিন্ন কারণে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে শ্লথতা এসেছে। বাংলাদেশের বর্তমান অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড এখনো তার আগের পর্যায়ে যেতে পারেনি। যেমন পোশাক শিল্প খাতের উৎপাদন এখনো স্বাভাবিক হয়নি। অন্যান্য শিল্প খাতেও উৎপাদন হ্রাস এখনো কাটিয়ে ওঠা যায়নি। যেহেতু অর্থনীতিতে নানা অনিশ্চয়তা বিদ্যমান, তাই কাঙ্ক্ষিত দেশজ ও বিদেশী বিনিয়োগ বাংলাদেশ অর্থনীতিতে অনুপ্রবেশ করছে না। ব্যাংক খাতও খুব যে একটা ভালো অবস্থায় আছে, তাও নয়। ফলে প্রবৃদ্ধির সুযোগও হ্রাস পেয়েছে। দেশের সাম্প্রতিক বন্যাও একদিকে যেমন মানুষের জীবন ও জীবিকা বিনষ্ট করেছে, সম্পদের ক্ষতি করেছে, তেমনি অন্যদিকে উপদ্রুত অঞ্চলের উৎপাদন কাঠামো নষ্ট করেছে। যদিও প্রবৃদ্ধির ওপর বন্যার অর্থনৈতিক প্রভাব এখনো যথাযথভাবে নিরূপিত হয়নি, কিন্তু দেশের বিস্তৃত অঞ্চলের ব্যাপ্ত বন্যা যে ভবিষ্যৎ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে বিরূপ প্রতিক্রিয়া ফেলবে, তাতে সন্দেহ নেই।
অর্থনৈতিক শ্লথতা যে শুধু দেশের উৎপাদন খাতের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে, তা-ই নয়, এটা দেশের সামাজিক খাতকেও প্রভাবিত করবে। অবশ্য অর্থনীতির কোন খাতে অর্থনৈতিক শ্লথতা সবচেয়ে বেশি আঘাত হেনেছে, তার ওপর এ শ্লথতার সামগ্রিক প্রতিক্রিয়া নির্ভর করবে। বিগত সময়ে শিল্প খাতে কর্মশূন্য প্রবৃদ্ধি পরিলক্ষিত হয়েছে, যেখানে খাতের প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে কর্মনিয়োজনের প্রবৃদ্ধি দেখা যায়নি। এ অবস্থায় শিল্প খাতে উৎপাদন হ্রাস পেলেও হয়তো কর্মনিয়োজন তেমন একটা কমবে না তবে সেবা খাতের কর্মকাণ্ড হ্রাস পেলে মানুষের কর্মনিয়োজন এবং আয়ের ওপর গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব পড়তে পারে।
এসব প্রবণতাই হচ্ছে বাংলাদেশ অর্থনীতির বর্তমান বাস্তবতা। কিন্তু অর্থনীতির এসব অনিশ্চয়তা, নাজুকতা ও ভঙ্গুরতা সত্ত্বেও আশা করা যাচ্ছে যে আগামী দিনগুলোয় বাংলাদেশ এসব অন্তরায় কাটিয়ে উঠতে পারবে। সবার প্রত্যাশা যে বিভিন্ন ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার চলমান উন্নতি এবং সেই সঙ্গে আইন-শৃঙ্খলা অবস্থার উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশ একটি উচ্চতর প্রবৃদ্ধির পথে স্থিত হবে। এর ফলে অর্থনীতি বিষয়ে জনগণের আস্থা ও বিশ্বাস আরো মজবুত হবে, স্থানীয় এবং বিদেশী বিনিয়োগ বাড়বে। ব্যাংক খাতে সংস্কার, বৈদেশিক বাণিজ্য খাতে স্থিতিশীল নীতিমালা এবং শিল্প খাতে স্থিতিশীলতা নিশ্চিতকরণ এ প্রক্রিয়াকে আরো জোরদার করবে। কৃষি খাতে যদি বীজ, সার এবং অন্যান্য উপকরণের জোগান নিশ্চিত করা যায়, তাহলে কৃষি খাতের ৪ শতাংশের বিগত প্রবৃদ্ধি অর্জন সম্ভব। চূড়ান্ত বিচারে, বর্তমান দেয় অবস্থায় বাংলাদেশ অর্থনীতি যদি ৫ শতাংশের মতো প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে পারে, তবে সেটাকেই অনুকূল প্রবৃদ্ধি বলে বিবেচনা করা যেতে পারে।
সেলিম জাহান: ভূতপূর্ব পরিচালক, মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন দপ্তর এবং দারিদ্র্য দূরীকরণ বিভাগ, জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি
নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র