পলিসি কনক্লেভ

প্রত্যেক উপদেষ্টা একটি করে ভালো কাজ করলেও অনেক উপকার হতো

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে রাজনৈতিক সংস্কৃতি অনুযায়ী প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর সদিচ্ছা ছাড়া খাদ্যদ্রব্যের যৌক্তিক মূল্য নির্ধারণ করা সম্ভব নয়।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে রাজনৈতিক সংস্কৃতি অনুযায়ী প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর সদিচ্ছা ছাড়া খাদ্যদ্রব্যের যৌক্তিক মূল্য নির্ধারণ করা সম্ভব নয়। আমরা ব্যবসায়ী সমাজ, নাগরিক সমাজ, উপদেষ্টা পরিষদ যেভাবে যতটাই চাই না কেন, রাজনৈতিক সদিচ্ছা ছাড়া বাজারে সুস্থ ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনা যাবে না। তাই ব্যবসায়ী, সুশীল সমাজ, উপদেষ্টা—যতজনই থাকুক না কেন, প্রধান কয়েকটি রাজনৈতিক দলের অন্তত একজন করে মুখপাত্র এই কনক্লেভে থাকা দরকার ছিল। কারণ পরোক্ষভাবে কথা বলার যে সংস্কৃতি দেশে গড়ে উঠেছে তা থেকেও বেরিয়ে আসা প্রয়োজন। এখন সময় এসেছে, কার কী ভূমিকা ও কার কতটুকু দায়, তা নিয়ে সরাসরি কথা বলার। সেই সৎসাহস আমাদের সবার থাকা উচিত।

বাজারের কথায় আসা যাক। আমরা দেশের বিভিন্ন বাজার থেকে তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে দেখেছি, কারওয়ান বাজার থেকে শুরু করে দেশের সব বাজার গতানুগতিকভাবে আগের মতোই চলছে। আগের মতো চাঁদাবাজি সিন্ডিকেট এখনো আছে। রাজধানীর বড় বড় পাইকারি বাজারে এসে পণ্যের দাম দেড়-দুই গুণ বেড়ে যায় চাঁদাবাজির কারণে। এসব চাঁদাবাজি ও সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করে রাজনৈতিক দলগুলো। আবার রাজনৈতিক দলের পাশাপাশি বাজার ব্যবস্থায় জড়িত সবারই কিছু না কিছু দায় রয়েছে। আমরা দেখেছি, ব্যবসায়ীরা সুযোগ পেলে নানাভাবে তাদের প্রভাব কাজে লাগান।

এসব থেকে অল্প কিছুদিনের অভিজ্ঞতায় মনে হয়েছে, আমাদের সবচেয়ে বড় সীমাবদ্ধতা হলো নানা ফোরামে ভালো ভালো অনেক কথা হয়, গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টগুলো খাতায় নোট হয়। কিন্তু সেগুলো নোট হিসেবেই থেকে যায়। আমরা সেগুলোর বাস্তবায়ন খুব একটা দেখতে পাই না। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি আমাদের যে আশা বা প্রত্যাশা ছিল, সেটিও ধীরে ধীরে কমছে। বর্তমান উপদেষ্টা পরিষদে অনেক ভালো মানুষ আছেন। তারা হয়তো মনে করছেন, দেশের সব মানুষ ভালো বা মনে করছেন, সবাই ভালো হয়ে যাবেন। কিন্তু এটি তো আসলে বাস্তবে সম্ভব নয়।

যুগের পর যুগ ধরে আমাদের রক্তে অনিয়ম-দুর্নীতি জেনেটিক্যালি ঢুকে গেছে। সেগুলো থেকে বেরিয়ে নতুন সিস্টেমে আসা প্রয়োজন। কিন্তু এজন্য সরকারের যতটা কঠোর হওয়া প্রয়োজন সেটি দেখা যাচ্ছে না। বাজার ব্যবস্থাসহ বিভিন্ন খাতে নতুন ও বড় ধরনের পরিবর্তনের জন্য যে ধরনের আইন-কানুনের প্রয়োগ দরকার, সে রকম খুব বেশি কিছু আমরা সরকারের দিক থেকে দেখতে পাচ্ছি না।

হয়তো রাতারাতি সব বদলানো সম্ভব নয়। তবে সরকারের আরো কঠোর হওয়া প্রয়োজন। উপদেষ্টারা অনেক রক্তের বিনিময়ে এ জায়গাটা পেয়েছেন। তাই প্রত্যেক উপদেষ্টা যদি একটি করে ভালো কাজ করেন, তাহলেই অনেক বড় পরিবর্তন হবে এবং উপকার হবে। এ প্রত্যাশা আমরা করতেই পারি। শুধু সবার সদিচ্ছা দরকার। এ পরিবর্তন বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখবে বলে আমরা আশাবাদী এবং এ বাংলাদেশ যতদিন থাকবে, ততদিন মানুষ তাদের (উপদেষ্টাদের) স্মরণে রাখবে।

এই কনক্লেভে অনেক বিশেষজ্ঞ উপস্থিত আছেন। তবে আমরা আমদানি-রফতানি বাণিজ্যের কিছুটা বিচার-বিশ্লেষণ করে দেখেছি, গত ১৬ বছর কিংবা তার আগে পুরো বাণিজ্য খাতকে নিয়ন্ত্রণ করেছে কয়েকটি বৃহৎ কোম্পানি। কোনো মাঝারি বা ক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠান কোত্থেকে কী আমদানি করবে তা নির্ধারণ করে দেয় তারা। এ বড় প্রতিষ্ঠানগুলো যদি অনুমতি না দেয়, বন্দরে পণ্য নামে না। তাই আমদানীকরণ প্রক্রিয়ার বিকেন্দ্রীকরণ জরুরি।

বর্তমানে আমাদের বাজার ব্যবস্থা অনেকটা সমঝোতা ও সহযোগিতাপূর্ণ। বড় বড় প্রতিষ্ঠান যেখানে একে অন্যের প্রতিযোগী হওয়ার কথা, সেটি না হয়ে তারা নিজেদের মধ্যে সমঝোতার মাধ্যমে টেরিটরি বা সীমানা নির্ধারণ করে নিয়েছে। অর্থাৎ বড় বড় কিছু প্রতিষ্ঠানই আমদানি বাণিজ্যের বড় অংশ নিয়ন্ত্রণ করছে। এমন সহযোগিতামূলক বাজার থেকে আমাদের প্রতিযোগিতামূলক বাজারের দিকে যেতে হবে। প্রতিযোগিতামূলক বাজার তৈরির ক্ষেত্রে যেসব প্রতিবন্ধকতা রয়েছে সেগুলো নির্মল করার মূল দায়িত্ব প্রতিযোগিতা কমিশনের। যদিও তারা গত ১৬ বছরে এক্ষেত্রে পুরোপুরি ব্যর্থ একটি প্রতিষ্ঠান। প্রতিযোগিতামূলক বাজার তৈরিতে আমাদের অনুরোধ থাকবে আপনাদের কাছে এবং রাজনীতিবিদদের কাছে। বিশেষ করে আগামীর বাংলাদেশে যারা রাজনীতি করবেন তাদের কাছে অনুরোধ, আপনারা নিজেদের জন্য সৎপথে উপার্জনের উপায় বের করুন, নয়তো বাজারে প্রতিযোগিতা বাড়াতে সহযোগিতা করুন। চাঁদাবাজির নামে লুটপাটের ঐতিহ্য বন্ধ হওয়া উচিত। রাজনীতিবিদদের পক্ষ থেকে এ কাজ তাদের করতে হবে। আর বড় বড় কোম্পানিরও প্রতিযোগিতাপূর্ণ বাজার সৃষ্টিতে এবং দেশের স্বার্থে অন্তত কিছু হলেও করা উচিত।

নির্দিষ্টভাবে যদি বলি, সরকার কাজ করছে মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনতে আর বড় বড় ব্যবসায়ীর কাজ করতে হবে লোভস্ফীতি কমাতে। লোভ দূর করে মানুষের জন্য কিছু একটা করতে হবে। কাগজের অর্থ থেকে শুরু করে সম্পদ ১০০ বছর পর নাও থাকতে পারে। কিন্তু আপনারা যদি একটি কারিগরি বিশ্ববিদ্যালয় বা মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় নির্মাণ করেন তাহলে আজ থেকে ২০০ বছর পরও হয়তো বাংলাদেশের নামের সঙ্গে আপনাদের নাম উচ্চারণ হবে। উন্নত দেশের দিকে লক্ষ করলে দেখা যায়, তাদের স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ব্যক্তি উদ্যোগে গড়ে উঠেছে।

বড় বড় অনেক কোম্পানি রয়েছে যাদের নামে-বেনামে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান রয়েছে। তবে অলাভজনক হিসেবে খুব বেশি প্রতিষ্ঠান নেই যেগুলো দেশ ও মানুষের মঙ্গলের জন্য কাজ করবে। আমরা আপনাদের থেকে এমন কিছু প্রত্যাশা করি যেখানে মানুষের প্রতি, দেশের প্রতি দরদ মিশ্রিত থাকবে। আর সরকারের দিক থেকে এসব কাজে তদারকি জোরদার করতে হবে, লোক দেখানো তদারকি হলে চলবে না। পাশাপাশি সরকারকে এমন কোনো উদ্যোগ নিতে হবে যাতে লোভ স্ফীত না হয়। সেটি মেডিটেশনের মাধ্যমে হতে পারে বা সেমিনারের মাধ্যমে হতে পারে। যেভাবেই হোক সবার ব্যক্তিস্বার্থ থেকে বেরিয়ে আসা জরুরি।

ব্যক্তিস্বার্থ থেকে বেরিয়ে আসার পাশাপাশি আমাদের আরেকটি বিষয় থেকেও বেরিয়ে আসতে হবে। তা হলো সমস্যা তৈরি হওয়ার পর কেন সমস্যা হলো সেটি খোঁজার সংস্কৃতি থেকে বের হতে হবে। আমাদের দীর্ঘমেয়াদি পূর্বপরিকল্পনা নেয়া প্রয়োজন। যাতে সমস্যা এড়ানো যায়। মোট কথা, প্রত্যাশা রইল যেন এ নীতি সংলাপ কেবল আলোচনা হিসেবেই সীমাবদ্ধ না থাকুক। অন্তত ১ শতাংশ হলেও যেন এর বাস্তবায়ন হয়।

সারজিস আলম: মুখ্য সংগঠক, জাতীয় নাগরিক কমিটি

[বণিক বার্তা আয়োজিত ‘‌খাদ্যপণ্যের যৌক্তিক দাম: বাজার তত্ত্বাবধানের কৌশল অনুসন্ধান’ শীর্ষক পলিসি কনক্লেভে অতিথির বক্তব্যে]

আরও