গ্রিক দার্শনিক ডায়োজেনিসকে নিয়ে অনেক কাহিনী প্রচলিত আছে। জানা যায় রৌদ্রোজ্জ্বল এক দিনে দার্শনিক ডায়োজেনিস লণ্ঠন জ্বালিয়ে বাজারে গেলেন। দিনের আলোয় তার হাতে লণ্ঠন দেখে মানুষজন মজা পেল এবং জানতে চাইল, ‘দিনের বেলা লণ্ঠন জ্বালিয়ে কোথায় যাচ্ছেন?’ লোকজনের প্রশ্নের উত্তরে তিনি বললেন, ‘আমি আসলে মানুষ খুঁজছি, গ্রিসের কোন জায়গায় মানুষ পাওয়া যাবে বলতে পারো?’
গ্রিক দার্শনিক ডায়োজেনিস সেই কবে গ্রিসের রাস্তায় মানুষ খুঁজছিলেন, তারপর হাজার হাজার বছর কেটে গেল মানবসভ্যতায় কত পরিবর্তন এল, এখন বলা হচ্ছে মানবসভ্যতার চরম উৎকর্ষ চলছে। মানুষ বাহারি পোশাক পরছে, অত্যাধুনিক অট্টালিকায় থাকছে, আরাম-আয়েসের শেষ নেই। চারদিকে অর্থ-বিত্ত-বৈভবের পাহাড় আর সেসব সম্পদ নিজের পকেটগত করার প্রাণান্ত প্রচেষ্টা সারা বিশ্বজুড়ে। দখলদারত্ব আর ক্ষমতায় টিকে থাকার আদিম স্বভাব দিনে দিনে আরো প্রকট হচ্ছে। মানুষ তার আরাম-আয়েস আর বেঁচে থাকার পেছনে যা ব্যয় করছে তারও বেশি ব্যয় করছে ধ্বংসের জন্য, অন্যের ওপর নিজের কর্তৃত্ব বজায় রাখার জন্য। মানুষ সভ্যতা বিকাশের জন্য এত পরিকল্পনা, এত অর্থ বরাদ্দ করলেও আদতে কি মানবসভ্যতা মানবিক হয়েছে? তাহলে এত মারণাস্ত্র, এত যুদ্ধ কেন? আধিপত্য বিস্তার আর দখলদারত্বের নেশা যেটি সভ্যতার শুরুতে ছিল এবং ধারণা করা হচ্ছিল জ্ঞান-বিজ্ঞান আর প্রযুক্তির বিকাশে মানুষ সভ্য হবে, মানবিক বিষয়গুলো প্রকট হবে, বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে, কিন্তু সেটি কোথায়? সভ্যতার শুরুতে মানুষ গোত্রে গোত্রে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ত, খুনখারাবি করত, ধ্বংসযজ্ঞ চালাত। সময়ের পরিক্রমায় বিশ্বজুড়ে রাষ্ট্রের অভ্যুদয় হলো এবং এসব দ্বন্দ্ব-সংঘর্ষ অন্তঃরাষ্ট্র ও আন্তঃরাষ্ট্রে ব্যাপ্তি লাভ করল। মানবসভ্যতা প্রত্যক্ষ করল বিশাল ভয়াবহ প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। ১৯১৪-১৮ সাল পর্যন্ত প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ১৭-২০ মিলিয়ন মানুষ নিহত হয়। এছাড়া বাস্তুহীন, পঙ্গু কত হয়েছে তার সঠিক তথ্য পাওয়া দায়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরিণতি ছিল আরো ভয়াবহ। ধারণা করা হয়, এ যুদ্ধে ১৯৪০ সালে বিশ্বের মোট জনসংখ্যার (২ দশমিক ৩ বিলিয়ন) প্রায় ৩ শতাংশ প্রাণ হারায়, যার পরিমাণ ৭০-৮০ মিলিয়ন। তবে এ সংখ্যা বিভিন্ন সূত্রমতে ৫০-৫৬ মিলিয়নও মনে করা হয়। যুদ্ধে হতাহতদের প্রকৃত সংখ্যা কেবল অনুমান করা যেতে পারে। প্রকৃত সংখ্যা সত্যিকার অর্থে নিরূপণ করা সম্ভব নয়। সরাসরি নিহত হওয়ার বাইরে মহামারী, খাদ্যাভাব থেকে শুরু করে বিভিন্ন কারণে অনেক মানুষ মারা যায়। আদতে সে খবর অনেক ক্ষেত্রে হিসাবে নেয়া হয় না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষের দিকে জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকি শহরে আণবিক বোমার আক্রমণ ছিল মানবসভ্যতার ভয়াবহতম আঘাত, যার ক্ষত পৃথিবীর মানুষ এখনো ভুলতে পারেনি। হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে তেজষ্ক্রিয়ার শিকার ব্যক্তিদের মতো যুদ্ধে আঘাত বা অসুস্থতার কারণে যারা কয়েক বছর পর মারা গেছে তাদের যুদ্ধের মৃতদের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে কিনা জানা নেই।
ভিয়েতনাম ও কম্বোডিয়ায় মার্কিন হামলার কথা নিশ্চয়ই পৃথিবীবাসী এখনো ভুলে যায়নি। ১৯৬৫-৭৫ সাল পর্যন্ত এ দীর্ঘ যুদ্ধে নিহতের সংখ্যা আনুমানিক ৩০ লাখ। সঙ্গে যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর পুরনো গোলাবারুদ দ্বারা সৃষ্ট মারাত্মক দুর্ঘটনায় ৪২ হাজারেরও বেশি লোক মারা যায়। উত্তর ভিয়েতনামে মার্কিন বাহিনী ১৫ মিলিয়ন টন বোমা ও বিস্ফোরক ব্যবহার করে, যার প্রায় আট লাখ টন দীর্ঘ সময় ভিয়েতনামের মাটি, পানি ও বায়ুকে দূষিত করে চলছে এবং করছে প্রাণসংহার।
এমন অসংখ্য যুদ্ধ, হত্যার মাঝে স্মরণ করা যায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী ৩০ লাখ মানুষ হত্যা করে। নয় মাসের এ যুদ্ধে বাস্তুহারা হয় কোটি মানুষ, ধর্ষিত হয় লাখো নারী। অস্ত্রের এ দুনিয়া শক্তি আর ক্ষমতা প্রদর্শনের জন্য শুধু টাকাই ব্যয় করছে না, বরং অনেক জ্ঞানী-বিজ্ঞানীর মেধাকে ব্যবহার করছে, অনেক শিশু-কিশোরের স্বপ্নকে কোরবানি দিচ্ছে। আহা! এটা কি মানুষের চরিত্র হওয়ার কথা। কিছু যুদ্ধ ও তার ভয়াবহ ফলাফল উপস্থাপনের মূল কারণ হলো হত্যা আর ধ্বংসের যে সংস্কৃতি মানুষ বহন করে চলছে তা কতটা মানুষকে প্রতিনিধিত্ব করে সেটি উপলব্ধি করা।
বিশ্বব্যাপী সবসময় কোনো না কোনো যুদ্ধ লেগেই আছে। এসব যুদ্ধ মানেই বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র ব্যবহার। যুদ্ধ কিংবা শান্তি, যেকোনো পরিস্থিতিতে সমরাস্ত্র তৈরি এবং এর মজুদ একটি নৈমিত্তিক ব্যাপার এবং দেশগুলোর সশস্ত্র বাহিনী রাষ্ট্রের নিরাপত্তার প্রয়োজনে এটি বজায় রাখে। বেঁচে থাকার জন্য যতটা অর্থ ব্যয় হয় তার চেয়ে বেশি খরচ হচ্ছে হত্যা আর ধ্বংসের জন্য। রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে চলছে যুদ্ধ। এ যুদ্ধ কবে শেষ হবে তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই। যুদ্ধে কোন দেশ কতটা আক্রমণ করল কিংবা কে কতখানি এগিয়ে গেল অথবা পিছিয়ে পড়ল সে ডামাডোলের ভিড়ে কে খবর রাখে বাস্তুহারা, স্বজনহারা লোকগুলোর।
একবিংশ শতাব্দীর এ তথাকথিত মানবসভ্যতার উৎকর্ষের সময়ে ফিলিস্তিনের গাজায় যে শিশু, নারী হত্যা চলছে এবং সভ্য হিসেবে দাবি করা জাতিগুলো চেয়ে চেয়ে দেখছে এবং যারা মানবাধিকারের কথা বলছে তারা কি মানবসম্প্রদায়ের সদস্য? ইসরায়েল ও হামাস নেতৃত্বাধীন ফিলিস্তিনি গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে চলমান সশস্ত্র সংঘাত মূলত ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে গাজা উপত্যকা এবং এর আশপাশে প্রথম সংঘটিত হয়। সেদিন হামাস নেতৃত্বাধীন ফিলিস্তিনি মুক্তিকামী যোদ্ধারা গাজা উপত্যকা থেকে দক্ষিণ ইসরায়েলে বহুমুখী আক্রমণ শুরু করে এবং অনেককে হত্যা করে। হামলায় কমপক্ষে ৮৪৬ জন ইসরায়েলি বেসামরিক নাগরিক এবং ৪১৬ জন সৈন্য ও পুলিশ নিহত হয় এবং আনুমানিক ২৪০ জন ইসরায়েলি ও বিদেশী নাগরিককে গাজা উপত্যকায় জিম্মি করা হয়। হামাস বলেছে, গাজা উপত্যকায় অবরোধ, অবৈধ ইসরায়েলি বসতি সম্প্রসারণ, ক্রমবর্ধমান ইসরায়েলি বসতি স্থাপনকারীদের সহিংসতা এবং সাম্প্রতিক উত্তেজনার প্রতিক্রিয়ায় তাদের এ হামলা চালানো হয়েছে। হামাসকে নির্মূল করার জন্য ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী অনর্গল বোমা হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। পর্যালোচকদের মতে, ইসরায়েলের ঘোষিত এ চলমান আগ্রাসী যুদ্ধ ১৯৭৩ সালে সংঘটিত যুদ্ধের পর এ অঞ্চলে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য সামরিক উত্তেজনার সূচনা করে। ২০২৩ সালের ৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মতে, সাত হাজারেরও বেশি শিশুসহ ১৭ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে, যা অধুনা সময়ে বিশ্বের সবচেয়ে বড় শিশু হত্যার ঘটনা।
যুদ্ধের ফলে গাজায় মারাত্মক মানবিক সংকট দেখা দিয়েছে। ইসরায়েলের বোমা হামলা, হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, শরণার্থী শিবির কোনো কিছু বাদ রাখেনি। প্রতিদিন মৃত্যু হচ্ছে শত শিশু ও নারীর। স্বাস্থ্য ব্যবস্থা আংশিক পতনের অবস্থায় রয়েছে, বেশির ভাগ হাসপাতাল পরিষেবার বাইরে রয়েছে এবং পানীয় জল, খাদ্য, জ্বালানি ও চিকিৎসা সরবরাহের তীব্র ঘাটতি সৃষ্টি হয়েছে। বোমা আর গুলির আঘাতে আহত বেসামরিক নাগরিক চিকিৎসা সুবিধা না পেয়ে অসহনীয় যন্ত্রণা নিয়ে মারা যাচ্ছে। ইসরায়েলি সেনাদের দ্বারা গাজায় পানি, জ্বালানি, খাদ্য ও বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার কারণে এ অঞ্চলে অনাহার ও রোগ ছড়িয়ে পড়ার ‘তাৎক্ষণিক সম্ভাবনা’ সম্পর্কে সতর্ক করেছে জাতিসংঘ। জাতিসংঘের অসহায় বাণীই প্রকাশ করে কীভাবে অমানবিক পৃথিবী চোখ-কান সব বন্ধ করে আছে। কী ভয়াবহ পরিহাস! যাদের দেশ, যাদের জন্মভূমি তারাই বছরের পর বছর দখলদারদের হাতে মার খাচ্ছে, খুন হচ্ছে, বাস্তুহারা হয়ে সারা বিশ্বে শরণার্থীর পরিচয় নিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছে। একবার নিজেকে এমন অবস্থায় চিন্তা করে দেখতে পারে কেবল নামধারী এ মানুষগুলো যারা সকাল-বিকাল মানবাধিকারের সবক দেয়। এ যুদ্ধ বিশ্বব্যাপী অনেক মানুষের মাঝে প্রতিবাদের জন্ম দিয়েছে এবং এর প্রেক্ষাপটে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবও উঠেছে। কিন্তু কে শোনে কার কথা, বরং মানবিক যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়ে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের একটি প্রস্তাবে ভেটো দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এর এক সপ্তাহ পর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে সর্বসম্মতিক্রমে পাস হওয়া একটি প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে যুক্তরাষ্ট্র এবং আগ্রাসী ইসরায়েলের পাশে দাঁড়ায়। তাহলে এই যে এতসব মানবাধিকার, মানবতা এসব কেবলই কথার কথা? মানবতা, মানবাধিকার কেবল মানুষের কাছেই আশা করা যায়? কিন্তু সে মানুষ কোথায়? যদি মানুষ থাকত তাহলে কেন এত নিরপরাধ লোক হত্যা, হত্যায় মদদ দেয়া, খুনির হাতে অস্ত্র তুলে দেয়া? এসবের পেছনে কি দখলদারত্ব, রাজত্ব কায়েমই মুখ্য বিষয়? এত ক্ষমতাধর হয়ে, এত রাজ্য দখল করে, এত লোক খুন করে, এত ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে শেষ ফলাফল কী? এখানেও গ্রিক দার্শনিক ডায়োজেনিসের একটি কাহিনী চলে আসে। আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট একবার দার্শনিক ডায়োজেনিসের সঙ্গে দেখা করতে গেলে কথোপকথনের এক পর্যায়ে ডায়োজেনিস আলেকজান্ডারের কাছে তার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী জানতে চাইলেন। জবাবে আলেকজান্ডার বললেন, ‘পুরো গ্রিস নিজের আয়ত্তে আনা’। ডায়োজেনিস জানতে চাইলেন তারপর? আলেকজান্ডার একের পিঠে এক প্রশ্নের জবাবে জানালেন, পুরো এশিয়া মাইনর নিজের আয়ত্তে আনবেন, তারপর সমগ্র পৃথিবী নিজের আয়ত্তে আনবেন এবং তারপর আর কী! বাড়িতে বসে বসে বিশ্রাম নেবেন। দার্শনিক ডায়োজেনিস তখন মিটিমিটি হাসেন। বললেন, ‘সে কাজটি এখন করলেই তো পারো!’ দার্শনিক ডায়োজেনিস ও আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট পৃথিবী ত্যাগ করেছেন অনেক অনেক আগে, কিন্তু আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটকে দিয়ে যাওয়া পরামর্শটি শাশ্বত, সবসময়ের সব ক্ষমতার দাপটে অন্ধ আগ্রাসীর জন্য। যুদ্ধ, হত্যা, খুন যদি হয় সাম্রাজ্য বিস্তারের জন্য তবে সেটি যখন শেষ হবে তখন আপনাদের আর কী করার থাকবে? বিশাল সাম্রাজ্য লাভের আনন্দ নিয়ে বিশ্রাম নেবেন? বিশ্রামই যদি হয় শেষ আনন্দ তাহলে সেটা এখন থেকেই নিন। কী লাভ এত হত্যা আর ধ্বংস চালিয়ে?
এত মানবাধিকারের স্লোগান, মানুষের অধিকার রক্ষায় কিংবা আদায়ে বিশ্বব্যাপী এত সংস্থা, সংগঠন এসবের কাজ কী? যেখানে মানুষ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। মানুষ থাকলে কি এত যুদ্ধ, হত্যা, ধ্বংস থাকত পৃথিবীতে? মানুষগুলো কোথায় গেল?
ড. এএসএম সাইফুল্লাহ: অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান, এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স অ্যান্ড রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট বিভাগ, মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়