অভিমত

বার্সেলোনার শহীদ মিনার, মধুর ক্যান্টিন ও বিশ্বব্যাপী লিটল বাংলাদেশ

ব্রিটেনে মোট বাংলাদেশীর সংখ্যা পাঁচ লাখের ওপরে। এর মধ্যে ইস্ট লন্ডনের টাওয়ার হ্যামলেটে সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশী থাকে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিতে কর্মরত অনেক বাঙালি নাবিক শতাধিক বছর আগে থেকেই টাওয়ার হ্যামলেটে বসবাস শুরু করে। সমগ্র যুক্তরাজ্যের প্রায় অর্ধেক বাংলাদেশীর বাস লন্ডনে। এর পরের স্থান ওয়েস্ট মিডল্যান্ড, বার্মিংহামের অন্তর্ভুক্ত। এ অঞ্চলে বাংলাদেশীদের

[গতকালের পর]

ব্রিটেনে মোট বাংলাদেশীর সংখ্যা পাঁচ লাখের ওপরে। এর মধ্যে ইস্ট লন্ডনের টাওয়ার হ্যামলেটে সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশী থাকে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিতে কর্মরত অনেক বাঙালি নাবিক শতাধিক বছর আগে থেকেই টাওয়ার হ্যামলেটে বসবাস শুরু করে। সমগ্র যুক্তরাজ্যের প্রায় অর্ধেক বাংলাদেশীর বাস লন্ডনে। এর পরের স্থান ওয়েস্ট মিডল্যান্ড, বার্মিংহামের অন্তর্ভুক্ত। অঞ্চলে বাংলাদেশীদের প্রায় ১২ শতাংশের বসবাস। নর্থ ওয়েস্টের ম্যানচেস্টার এবং ওল্ডহামে মোট বাংলাদেশের ১০ শতাংশের বসবাস, মিডলসবারাহের সাউথব্যাংক বাংলা টাউন নামে পরিচিত। ম্যানচেস্টারের লংসাইট নর্থইস্টের সাউথব্যাংককেও মিনি বাংলা টাউন বলা হয়। মোটকথা লন্ডনসহ ব্রিটেনের অনেক এলাকা আছে যেখানে গেলে মনে হয় যেন বাংলাদেশেই আছি, এমনকি হোয়াইট চ্যাপেল এর ব্রিকলেনসহ এসব অনেক এলাকার সরকারি রোড সাইন, হাসপাতাল অন্য সাইনবোর্ডগুলোতেও ইংরেজির নিচেই বাংলা লেখা দেখা যায়।

যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে নিউইয়র্কে হলো সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশীদের বাস, এখানকার জ্যাকসন হাইটস, জ্যামাইকা বা এস্টোরিয়ার কিছু এলাকা হয়ে গিয়েছেলিটল বাংলাদেশ।হিলসাইড এভিনিউ আর  Homelawn street-এর ইন্টারসেকশনকে নগর কর্তৃপক্ষ  “Little Bangladesh Avenue” ঘোষণা করেছে, সেখানে বাংলাদেশের হেন জিনিস নাই যা পাওয়া যায় না, কোনো কোনো দোকানে আমি পাট শাক, ঢেঁকি শাক, কচুর লতি এমনকি থানকুনি পাতা পর্যন্ত বেচতে দেখেছি। মোটামুটি সুপারশপ, সেলুন, ডাক্তারের চেম্বার, ডেন্টিস্ট, আইনজীবীর চেম্বার, ফার্মেসি, ট্রাভেল এজেন্ট, রেস্টুরেন্ট, বিভিন্ন পেশাজীবী অফিস, মনিহারি দোকান, কম্পিউটার, ইন্টারনেট সার্ভিস, পুরনো গাড়ি বিক্রি, সারাইয়ের গ্যারেজ, স্কুল ছাত্রছাত্রীদের কোচিং সেন্টার, নাচ-গান শেখার স্কুল, কমিউনিটি সেন্টার, মসজিদ, এমনকি ঘটকের অফিসসহ সবকিছুই আছে সেখানে। জ্যামাইকায় অন্তত দু-তিনটি রাস্তার পরপরই আমি একটা বাংলাদেশী মসজিদ দেখেছি। ব্রঙ্কসের স্টারলিং এভিনিউর  বাংলাটাউন সুপার মার্কেট এলাকা বা ব্রুকলিনের আবদুল্লাহ সুপার মার্কেট এলাকায়ও বাংলাদেশীদের বড় ধরনের সমাগম হয়, আস্তে আস্তে এসব স্থান বাংলাদেশী এলাকা হয়ে উঠছে। এছাড়া নিউইয়র্ক এবং কানাডা বর্ডারে বাফেলো সিটি এখন সর্বোচ্চ বাংলাদেশী অধ্যুষিত এলাকা হয়ে গিয়েছে। অন্যদিকে এঞ্জেলেস সিটি কর্তৃপক্ষ অফিশিয়ালি নিউ হ্যাম্পসায়ার থার্ড স্ট্রিটে এমন বাংলাদেশী অধ্যুষিত কর্মচঞ্চল এলাকায়LITTLE BANGLADESHনামে ফলক লাগিয়ে দিয়েছে আর ড্যালাসের সুগারল্যান্ডও ধীরে ধীরে বাংলাদেশীদের এলাকা হয়ে উঠছে।

কানাডায়ও প্রায় ১২-১৪ লাখ বাংলাদেশী বসবাস করে, বৃহত্তর টরন্টোর স্কারবরো শহরের ভিক্টোরিয়া পার্ক এভিনিউ এবং ড্যানফোর্থ এভেনিউর সংযোগস্থল এবং কাছের এলাকাটি কানাডায় বসবাসরত বাঙালিদের কাছে বাংলাটাউন বা বাংলাপাড়া নামে পরিচিত। এখানে সব ধরনের কেনাকাটাসহ বিভিন্ন ধরনের সামাজিক-সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, সাপ্তাহিক আড্ডা ইত্যাদিতে বৃহত্তর টরন্টো এলাকার বাংলাদেশীরা জমায়েত হন। একুশে ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে অঞ্চলের ঠিক লাগোয়া ডেন্টোনিয়া পার্কে সিটি স্থানীয় বাংলাদেশীদের উদ্যোগে ঢাকার মূল শহীদ মিনারের আদলে ছোট আকারের একখানি শহীদ মিনারও নির্মিত হয়েছে। প্রতি ফেব্রুয়ারিতে হিম ঠাণ্ডা উপেক্ষা করে বিপুলসংখ্যক বাংলাদেশী এই শহীদ মিনারে উপস্থিত হয়।

অন্যদিকে লিটল ইন্ডিয়ার কাছেই সিঙ্গাপুরের সেরাংগুন প্লাজায় অবস্থিত অত্যন্ত প্রাণবন্ত বাংলা টাউন বা লিটল বাংলাদেশ। বাংলাদেশের হেন জিনিস নাই যা এখানে বিক্রি হয় না, তেমনি ব্যাংককের পাওরাত, নানাসহ সুকুমভিত সয় ১১ এলাকাটায় আছে বাংলাদেশী অনেক রেস্টুরেন্ট, ট্রাভেল এজেন্সি, মানি এক্সচেঞ্জ, সেলফোনের দোকান বা ২৪ ঘণ্টার মধ্যে স্যুট বানিয়ে দেয়ার টেইলর শপ ইত্যাদি।

মালয়েশিয়ার সঙ্গে সমুদ্রপথে আমাদের বাণিজ্যের ঐতিহাসিক প্রমাণ মেলে সেই পঞ্চদশ শতক থেকেই, তবে অনুমান করা যায় তার আগেও বাংলার সঙ্গে মালয়দের বাণিজ্যিক যোগাযোগ ছিল, পেনাং শহরেরবাঙালি মসজিদপ্রতিষ্ঠা করা হয় আজ থেকে প্রায় ২২০ বছর আগে। প্রায় পাঁচ শতক ধরেই কিছু কিছু বাঙালি নাবিক বণিকরা স্থায়ীভাবে মালয়েশিয়ায় বসবাস শুরু করে। তবে ১৯৮৬ সাল থেকে শ্রমিক হিসেবে বাংলাদেশীরা সে দেশে যাওয়া শুরু করে। এখন বৈধ অবৈধ মিলিয়ে মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশী শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় ১০ থেকে ১২ লাখ। কুয়ালালামপুরের বুকিত বিনতাং, বারজায়া টাইম স্কয়ার জালান আলোর এলাকার বেশকিছু অংশ  বাংলা টাউনে রূপান্তরিত হয়েছে। বিশেষ করে বুকিত বিনতাংয়ের বিশাল রসনা বিলাস রেস্তোরাঁ প্রবাসী বাঙালিদের প্রধান মিলন কেন্দ্র। এছাড়া শিল্প শহর শাহ আলমের সিতিয়া শপিং মল এলাকা সীমান্ত শহর জোহর বারুর মসজিদ আল আটটাসের বেশকিছু এলাকা বাংলা টাউনে পরিণত হয়েছে। জোহর বারুর আম্মা রেস্টুরেন্ট প্রবাসীদের প্রধান মিলন কেন্দ্র। এছাড়া অস্ট্রেলিয়ার সিডনি শহরের লাকেম্বা এলাকা এরই মধ্যে বাংলা টাউনে পরিণত হয়েছে। অন্যদিকে দক্ষিণ আফ্রিকায় প্রায় তিন থেকে চার লাখ বাংলাদেশী বসবাস করে। জোহানেসবার্গের খণ্ড খণ্ড অনেক এলাকা এরই মধ্যে বাংলা এলাকা হিসেবে পরিচিত হয়েছে। দক্ষিণ আফ্রিকার বাঙালিদের একটা বিশেষত্ব  হলো দেশের প্রায় অধিকাংশ প্রবাসীই নিজেরা ব্যবসা করে অনেক দক্ষিণ আফ্রিকান তাদের প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে।

মধ্যপ্রাচ্যের বিভন্ন দেশেও এমন অনেক বড় বড় বাংলা টাউন গড়ে উঠেছে। শুধু সৌদি আরবেই ২০-২৫ লাখ বাংলাদেশী কর্মরত আছে, সেদেশে মক্কার নাক্কাস আর মিসফালা এলাকা, জেদ্দার বালাদ এলাকা, রিয়াদের বাথা আর হাই উল উজারাত এলাকা এবং দাম্মামের সিকো এলাকা বা মদিনার বলদিয়া এলাকাগুলো খুব প্রাণবন্ত বাংলা টাউন হিসেবে গড়ে উঠেছে। অন্যদিকে ইউনাইটেড আরব আমিরাতে প্রায় ১০ লাখের বেশি বাংলাদেশী বসবাস করে, কারণেই স্বাভাবিকভাবে দুবাইয়ের দেইরা দুবাই এলাকা শারজাহর রোল্লাহ এলাকার দ্বাওয়ার মুল্লা সড়ক ঘিরে গড়ে উঠেছে অত্যন্ত জনসমাগমপূর্ণ বাংলা বাজার বা বাংলা টাউন।

সত্যি করে বলতে গেলে বালাদেশীদের আর আটকে রাখা যাবে না। ১৯৪৭ সালে তিনদিকে আটকানো পদ্মা, মেঘনা আর যমুনাবিধৌত একটা অতিক্ষুদ্র জলকাদায় অর্ধনিমজ্জিত বদ্বীপের মধ্যে বিপুলসংখ্যক মানুষকে ঠেলেঠুলে জোর করে ভরে দেয়া হয়েছিল। তখনকার পূর্ব পাকিস্তান পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ সে কারণেই হয়েছে গ্রহের সবচেয়ে ঘন বসতিপূর্ণ জনপদ। পূর্ব বাংলার কৃষকের শ্রম নিষিক্ত সম্পদ পুঞ্জীভূত হয়ে গড়ে উঠেছিল কলকাতা শহর যা আমরা হারিয়েছি সে সময়। হোসেন সোহরাওয়ার্দীসহ বঙ্গবন্ধুর মতো নেতারাও কেউই বিশ্বাস করতে পারেননি যে কলকাতা আমাদের হারাতে হবে। বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে সে কথা আক্ষেপ করেই তিনি লিখেছেন, ‘শহীদ সাহেবের (সোহরাওয়ার্দী) পক্ষ থেকে বাংলা সরকারের অর্থমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী ঘোষণা করেছিলেন, কলকাতা আমাদের রাজধানী থাকবে। দিল্লি বসে অনেক পূর্বেই যে কলকাতাকে ছেড়ে দেয়া হয়েছে কথা আমরা জানতামও না, আর বুঝতামও না।

তখনকার প্রিন্সলি স্টেট ত্রিপুরার রাজপরিবার চেয়েছিল তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে যোগ দিতে কিন্তু তখনকার মুসলিম লীগ নেতাদের অবহেলা অদূরদর্শিতার কারণে সেটা বাস্তব রূপ পায়নি। ১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীন হলেও দুই বছরেরও বেশি সময় পর ১৯৪৯ সালের সেপ্টেম্বরে ত্রিপুরা ভারতীয় ইউনিয়নে যোগ দেয়। একইভাবে ত্রিপুরা, আসাম আর আরাকানও আমরা হারিয়েছি। বর্তমানে আবার উল্টো আরাকান থেকে লাখ লাখ রোহিঙ্গাকে জোর করে ধরে আমাদের ছোট্ট ভূখণ্ডের মধ্যে ঠেলে দেয়া হয়েছে, আবার অন্যদিকে আসাম পশ্চিমবঙ্গ থেকেও নতুনভাবে অনেককে ঠেলে দেয়ার পাঁয়তারা চলছে।

তবে এত অন্যায়-অবিচারের পরও পূর্ববঙ্গের কৃষকের সন্তান সেই বাঙালিদেরকেউ দাবায়ে রাখতে পারেনি’, আজ তারা ছড়িয়ে পড়েছে পৃথিবীর প্রতিটি প্রান্তে। মানুষকে জোর করে চেপে ভরে দিলেই হবে না, প্রকৃতি তার আপন নিয়মেই অগ্রসর হবে আর মনে রাখতে হবে মানব জাতির ইতিহাস প্রধানত মাইগ্রেশনেরই ইতিহাস। ইতিহাস তার অমোঘ আপন গতিতেই চলবে আর সে কারণেই প্রায় এক কোটি বাংলাদেশী আজ প্রবাসী হয়েছে, ইউরোপসহ পৃথিবীর বহু গুরুত্বপূর্ণ শক্তিশালী দেশের জনসংখ্যাও এর চেয়ে অনেক কম। বিপুল প্রবাসী বাংলাদেশীরা এর পরবর্তী প্রজন্ম শিক্ষায়, প্রযুক্তিজ্ঞানে অর্থবিত্তে দিনে দিনে আরো সমৃদ্ধ হবে এবং আমার দৃঢ় বিশ্বাস, আমাদের জন্য এক বিশাল বহুমুখী অপার সম্ভাবনা অপেক্ষা করছে এদের মধ্যে। গুরুত্বপূর্ণ বাস্তবতাকে জাতীয় নীতিনির্ধারক মহলে জাতীয় রাজনৈতিক মনস্তত্ত্বে গভীরভাবে আমলে নিতে হবে। ১৯৭৮-এর পরবর্তী সময়ে দেং জিয়াও পিংয়ের খোলা নীতির পর চীন যখন বিপুল গতিতে গ্লোবাল অর্থনীতির সঙ্গে যুক্ত হলো তখন সে অর্থনৈতিক উল্লম্ফনে একটা প্রধান ভূমিকা রেখেছিল ইউরোপ আমেরিকাপ্রবাসী চীনারা এবং আজও তারা চীনের অর্থনীতির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের যে এক কোটি প্রবাসী নাগরিক আছে তারা তাদের পরবর্তী প্রজন্ম একদিন ওদের মতো আমাদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে নিশ্চয়ই বিশাল ভূমিকা রাখবে, আমাদের শুধু দরকার সঠিক পরিকল্পনা এবং বাণিজ্য বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ। আমরা নিশ্চিত, ঐতিহাসিক নৃতাত্ত্বিক অবিচারের সব বাধা অতিক্রম করে বাঙালি এভাবে এগিয়ে যাবেই। [শেষ]

 

মাহফুজুল হক জগলুল: স্থপতি; ফেলো, আইএবি

আরও