যুক্তরাষ্ট্রের অ্যারিজোনায় তাইওয়ান সেমিকন্ডাক্টর ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানির (টিএসএমসি) সেমিকন্ডাক্টর কারখানাটি ২০২৫ সালের মধ্যে উৎপাদন শুরুর লক্ষ্যমাত্রা পূরণে একদম সঠিক পথেই রয়েছে। এ ঘোষণা অনেক পর্যবেক্ষকের সামনে নতুন চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করেছে যারা আশঙ্কা করছিলেন, যুক্তরাষ্ট্রে চিপ উৎপাদন ফিরিয়ে আনার প্রচেষ্টা ব্যর্থ হবে। এক্ষেত্রে প্রশ্ন জাগে, যুক্তরাষ্ট্র এক্ষেত্রে সফলতা অর্জন করল কীভাবে?
অ্যারিজোনার কারখানা ঘিরে সংশয় উৎপন্ন হয়েছিল এ বিশ্বাস থেকে যে হাতেকলমে শেখন পদ্ধতি ও গতিশীল অর্থনীতির দ্বারা চিপ উৎপাদনকে লাভজনক করা যায়। এতে উৎপাদকরা উল্লেখযোগ্য হারে ব্যয় কমানোর সুযোগ পায়। এভাবে টিএসএমসি অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ক্ষেত্রে তার আধিপত্য বজায় রাখতে পেরেছে। এছাড়া এ কোম্পানি তাইওয়ানের কারখানায় বিশ্বের সর্বাধুনিক লজিক চিপের প্রায় ৯২ শতাংশ উৎপাদন হয়।
কিন্তু বাস্তবে সরবরাহ শৃঙ্খলার স্থিতিশীলতা নিশ্চিতে উৎপাদন বৈচিত্র্যময় হওয়া জরুরি। আবার হাতেকলমে শিখতে গিয়ে নতুনদের কিছু সমস্যারও সম্মুখীন হতে হয়। যে কারণে অ্যারিজোনা প্রকল্পের ক্ষেত্রে সন্দেহ দেখা দিয়েছিল। উপরন্তু যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসনবিরোধী মনোভাব বাড়ার কারণে সেখানে দক্ষ শ্রমিক আকর্ষণ করার সক্ষমতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছিল, যা ওই সংশয়কে আরো তীব্র করে তুলে।
এ সত্ত্বেও অ্যারিজোনার কারখানা নিয়ে করা হতাশা উদ্রেককারী সেই ভবিষ্যদ্বাণী অতিরঞ্জিত বলে প্রমাণিত হয়েছে। চিপ উৎপাদনে কাজ করতে করতে শেখা গুরুত্বপূর্ণ হলেও পুরনো কর্মীদের সঙ্গে নতুনদের প্রতিযোগিতা করার সক্ষমতা অনেক বেশি নির্ভর করে শেখার পরিবেশ কেমন, সেটার ওপর। নতুন এক গবেষণায় আমি ও আমার সহকর্মীরা খুঁজে পেয়েছি যে সেমিকন্ডাক্টরের ক্ষেত্রে হাতেকলমে শেখার বিষয়টি যত না বেশি প্রযুক্তিকেন্দ্রিক, তার চেয়ে বেশি প্রতিষ্ঠানভিত্তিক। সুতরাং টিএসএমসির সুবিধাগুলো কেবল দক্ষভাবে উন্নত চিপ উৎপাদনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি বিভিন্ন প্রযুক্তির মধ্যে তার জ্ঞান ও দক্ষতা বিস্তার ঘটাতে সক্ষম। এর মানে হলো টিএসএমসির সাফল্য অন্যান্য স্থানেও পুনরাবৃত্তি করা যেতে পারে। তবে এর জন্য নতুন কারখানাগুলো একেবারে শুরু থেকে শুরু না করে তাইওয়ানিজ কোম্পানির অভিজ্ঞতার আলোকে গড়ে তুলতে হবে।
টিএসএমসির সফলতার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ এটির মাধ্যমে জ্ঞানের পরিসর কোনো নির্দিষ্ট দেশের সীমার মধ্যে আবদ্ধ না থেকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিস্তার লাভ করেছে। একই গবেষণায় দেখা গেছে, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে জ্ঞানের বিস্তার শেখার ক্ষেত্রে বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
যেখানে বিদেশী প্রযুক্তি রফতানিসহ প্রত্যক্ষ বিদেশী বিনিয়োগ (এফডিআই), বিদেশ থেকে দক্ষ পেশাদার নিয়োজন এসব তেমন প্রভাব বিস্তার করতে পারে না। কিন্তু এগুলোরও সম্ভবত চিপ উৎপাদনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার কথা ছিল।
তাছাড়া যেহেতু সেমিকন্ডাক্টর সরবরাহ শৃঙ্খল ফ্যাবলেস-ফাউন্ডারি মডেলে গঠিত (যেখানে চিপ ডিজাইন কোম্পানিগুলো চিপ তৈরির কাজ আউটসোর্স করে), এটি দেশগুলোর মধ্যে জ্ঞানের প্রসার ঘটাতে সহায়তা করে। চিপ ডিজাইন ও উৎপাদনের ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাপী ক্রেতা ও নির্মাতাদের মধ্যে যৌথ সহযোগিতা প্রয়োজন হওয়ায় প্রায়ই ব্যবহারিক জ্ঞানের প্রসারে এটি তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
এ উপকারী ব্যবহারিক জ্ঞানের বিস্তার এটিই নির্দেশ করে যে কেবল সরকারি সহায়তাই কোনো শিল্পের সফলতা নিশ্চিত করতে পারে না। তাইওয়ান ও দক্ষিণ কোরিয়া তাদের চিপ উৎপাদনে আধিপত্য ধরে রেখেছে শুধু উল্লেখযোগ্য সরকারি ভর্তুকির কারণে নয়, বরং বিদেশী উন্নত প্রযুক্তিতে গমনযোগ্যতা রয়েছে তাদের। বিপরীতে চীন ব্যাপক মাত্রায় সরকারি সহায়তা সত্ত্বেও এখনো সেমিকন্ডাক্টর প্রযুক্তির শীর্ষে পৌঁছতে পারেনি। চীনের অভিজ্ঞতা দেখায় যে সরকারি প্রণোদনা উপকারে আসতে পারে, তবে বিদেশী প্রযুক্তিতে প্রবেশের সুযোগ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। চীনের সংগ্রামের বিপরীতে তাইওয়ানের সাফল্য প্রযুক্তিগতভাবে উদ্ভাবনী খাতগুলোর জন্য মূল্যবান পাঠ প্রদান করে।
মূলত চীনের অনেক বেশি সফল শিল্পনীতির মধ্যে একটি দেখা যায় এর অটোমোবাইল খাতে। দেশীয় কোম্পানি ও প্রযুক্তিগতভাবে অনেক উন্নত বিদেশী নির্মাতারা যৌথ উদ্যোগে এ খাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। সেমিকন্ডাক্টর খাতেও বিভিন্ন দেশের প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সহযোগিতা প্রযুক্তি ও পণ্যের গুণগতমান উন্নতির প্রধান চালিকাশক্তি হিসেবে দাঁড়িয়েছে।
আন্তর্জাতিক পর্যায়ে জ্ঞানের বিস্তারের তিনটি বড় প্রভাব বর্তমান নীতিতে রয়েছে। প্রথমত, যুক্তরাষ্ট্র বাস্তবিকই তাইওয়ানের সঙ্গে মিলে সেমিকন্ডাক্টর উৎপাদনে প্রতিযোগিতার ভালো সুযোগ পেয়েছে। এতে দুই দেশের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সহযোগিতার সম্পর্ক গড়ে উঠেছে এবং গবেষণা ও চিপ ডিজাইনে আমেরিকা শীর্ষস্থান দখল করতে পেরেছে। দ্বিতীয়ত, সেমিকন্ডাক্টরে চীনের অগ্রগতি ধীরগতিসম্পন্ন করার প্রচেষ্টা সম্ভবত সফল হবে, যেহেতু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে চীনে প্রযুক্তি রফতানির নিষেধাজ্ঞা কার্যত চীনকে বিদেশী উন্নত প্রযুক্তি থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে।
শেষত, অন্যান্য দেশ যারা সেমিকন্ডাক্টর শিল্পে অগ্রগণ্য হওয়ার চেষ্টায় রত (যেমন ভারত), তারা মার্কিন প্রযুক্তিগত নেতৃত্বের ওপর নির্ভরশীল। এ দেশগুলো যতই আর্থিক সহায়তা দিক না কেন, তাদের আমেরিকার প্রযুক্তিগত সমর্থন ছাড়া সফল হওয়ার সম্ভাবনা কম। অর্থাৎ প্রযুক্তিগত নেতৃত্বে থাকায় যে শিল্পনীতি আমেরিকার জন্য কার্যকর হতে পারে তা অন্যদের জন্য কার্যকর নাও হতে পারে।
মোট কথা যুক্তরাষ্ট্র এখনো চালকের আসনে রয়েছে। এর প্রযুক্তিগত নেতৃত্ব এবং ব্যাপ্তির কারণে দেশটি সেমিকন্ডাক্টর নীতির লক্ষ্যমাত্রা পূরণের পথে রয়েছে—সরবরাহ শৃঙ্খলার স্থিতিশীলতা জোরদার করা এবং চীনের অবস্থান দুর্বল করা। যদিও প্রশ্ন থেকেই যায়, এ লক্ষ্যগুলো আদৌ কতটা যৌক্তিক।
একটি একক, ভূরাজনৈতিকভাবে সংবেদনশীল অবস্থান থেকে সরবরাহ শৃঙ্খলকে বৈচিত্র্যময় করা বুদ্ধিমানের কাজ হতে পারে। তবে চিপ উৎপাদন যুক্তরাষ্ট্রে ফিরিয়ে আনার প্রয়োজন কেন তা অস্পষ্ট। বিশেষত যখন অন্য মিত্র দেশগুলো কম খরচে চিপ উৎপাদন করতে সক্ষম। তাছাড়া চীনের চিপ তৈরির অগ্রগতিকে ধীর করার প্রয়োজনীয়তাও বিতর্কিত থেকে যায়, কেবল এমন কিছু ক্ষেত্র ছাড়া যেখানে বৈধ জাতীয় নিরাপত্তা উদ্বেগ রয়েছে।
ঐতিহাসিকভাবে যুক্তরাষ্ট্র প্রযুক্তিগত নেতৃত্ব অর্জন করেছে। একই সঙ্গে দেশটি অন্য অনেক দেশকে উন্নত করেছে। যুক্তরাষ্ট্র গবেষণা ও ডিজাইনের মতো উদ্ভাবনী কর্মকাণ্ডে শীর্ষে ছিল, যা তাদের ও বিশ্বের অন্যান্য দেশের মধ্যকার ব্যবধানকে সংকুচিত করেছে। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোয় যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলটি রূপান্তরিত হয়ে গেছে। পরিবর্তিত নীতি অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্র শীর্ষে থাকতে চায় অন্যদের অগ্রগতি নস্যাৎ করে। তবে ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস সাম্প্রতিক প্রেসিডেন্সিয়াল বিতর্কে একটি কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন, ‘প্রকৃত নেতা আসলে বুঝতে পারেন যে ক্ষমতা মানুষের ওপর চেপে বসায় নয়, বরং মানুষকে উঠিয়ে নেয়ায় রয়েছে।’ এ কথা শুধু মানুষের ক্ষেত্রেই নয়, দেশগুলোর জন্যও প্রযোজ্য হওয়া উচিত।
[স্বত্ব:প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, ২০২৪]
পিনেলোপি কুজিয়ানু গোল্ডবার্গ: বিশ্বব্যাংক গ্রুপের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ও আমেরিকান ইকোনমিক রিভিউর প্রধান সম্পাদক এবং ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক
ভাষান্তর: সাবরিনা স্বর্ণা