প্রতিযোগিতা নয়, প্রয়োজন সহযোগিতা ও সহমর্মিতা

নতুন শতাব্দীর শুরু থেকে আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় মৌলিক পরিবর্তন এসেছে। পরীক্ষা ব্যবস্থায় এসেছে গ্রেডিং সিস্টেম। শুরু হলো এক নতুন দৌড়। জিপিএ ৫ পাওয়াই হয়ে উঠল জীবনের মূল লক্ষ্য। চাকরির বাজার হয়ে গেল বিসিএসমুখী। যেন বিসিএস ক্যাডার হতে না পারলে জীবনটা ষোলো আনাই বৃথা।

শিক্ষার্থীদের মাঝে একটি মজার কথা প্রচলিত আছে। যখন প্রাথমিক স্তরের পড়াশোনা চলে, তখন অভিভাবকরা বলেন, এখন ভালো করে পড়াশোনা করো, হাই স্কুলে গেলে আর এত চাপ থাকবে না। যখন হাই স্কুলে যায়, তখন বলা হয়, ভালোভাবে পড়ো, এসএসসিতে ভালো রেজাল্ট করতে হবে। তারপর কলেজে গেলে তো আর কোনো চিন্তা নেই। তখন তো কেবল আনন্দ। এর পর শুরু হয় কলেজজীবন। বলা হয়, বাবা, এবার এইচএসসি পরীক্ষায় ভালো করতে হবে। সুতরাং মনোযোগ দিয়ে পড়ো। এইচএসসি পরীক্ষার পর ভার্সিটির ভর্তি পরীক্ষা। তারপর বিভাগের পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করার চাপ। তার সঙ্গে যুক্ত হয় চাকরির প্রস্তুতি। বর্তমানের তীব্র প্রতিযোগিতাপূর্ণ চাকরির বাজারে নিজেকে তোলার জন্য একজন শিক্ষার্থীকে হাড়ভাঙা খাটুনি খাটতে হয়। তার পরও অধিকাংশ শিক্ষার্থী কাঙ্ক্ষিত চাকরি পায় না। আবার চাকরিতে ঢোকার পরও প্রতিযোগিতা। অর্থাৎ, প্রতিযোগিতার আর শেষ নেই। আর এ প্রতিযোগিতা কেবল শিক্ষার্থীদের মাঝেই সীমাবদ্ধ থাকে না। ছড়িয়ে পড়ে তাদের অভিভাবকদের মাঝেও। সন্তানের মধ্য দিয়ে নিজেদের যাবতীয় অপূর্ণ আকাঙ্ক্ষাকে বাস্তবায়ন করতে চাওয়া অভিভাবকরা নিরন্তর তাদের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে থাকেন। সন্তান ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার বা বিসিএস ক্যাডার হতে না পারলে অভিভাবকদের আর কোনো মান থাকে না। সব যেন ধুলায় মিশে যায়। তাই অভিভাবকদের মাঝে এখন আর সহজিয়া রূপটি নেই। সন্তানের সঙ্গে এখন তাদের সম্পর্কটি দেনা-পাওনায় গিয়ে ঠেকেছে। তোমাকে খাওয়াচ্ছি, পরাচ্ছি, বিনিময়ে তুমি ভালো পাস দিয়ে, ভালো চাকরি জোগাড় করে আমাদের মুখ উজ্জ্বল করবে। পরীক্ষায় খারাপ রেজাল্ট করলে, ভালো মানের একটি সরকারি চাকরি জোগাড় করতে না পারলে, একজন শিক্ষার্থী প্রথম তার অভিভাবকদের কাছ থেকেই চরম তিরস্কারের শিকার হচ্ছে। যে পরিবার তার পরম আশ্রয় ও নির্ভরতার জায়গা হওয়ার কথা, সেখানেই তাকে সবচেয়ে বেশি গঞ্জনা সইতে হচ্ছে। ফলে অভিভাবক তথা পরিবারের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের একটি দূরত্ব তৈরি হয়। কালের পরিক্রমায় সে দূরত্ব কেবল বাড়তেই থাকে, ঘুচে না। অবশ্য এজন্য অভিভাবকরাও দায়ী নন। এর জন্য দায়ী আমাদের সমাজ ব্যবস্থা। আর তার ন্যক্কারজনক শিকার শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকরা।

নতুন শতাব্দীর শুরু থেকে আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় মৌলিক পরিবর্তন এসেছে। পরীক্ষা ব্যবস্থায় এসেছে গ্রেডিং সিস্টেম। শুরু হলো এক নতুন দৌড়। জিপিএ ৫ পাওয়াই হয়ে উঠল জীবনের মূল লক্ষ্য। চাকরির বাজার হয়ে গেল বিসিএসমুখী। যেন বিসিএস ক্যাডার হতে না পারলে জীবনটা ষোলো আনাই বৃথা। একটা হাইপ চলছে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায়। প্রথমে জিপিএ ৫ নিয়েই সন্তুষ্ট ছিলেন অভিভাবকরা। তারপর এল গোল্ডেন জিপিএ ৫। অনেক বছর এই হাইপ নিয়েই কাটল। তারপর এতেও কুলোল না। তখন বলা হতে লাগল, গোল্ডেন জিপিএ ৫ তো এখন সাধারণ হয়ে গেছে, প্রতি বিষয়ে ৯০ শতাংশ বা ততোধিক নম্বর না পেলে তো আর সমাজে মুখ দেখানো গেল না। শেষ পর্যন্ত গত বছর এসএসসি পরীক্ষার রেজাল্ট দেয়ার পর আমরা দেখলাম, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ফলাও করে প্রচার করা হচ্ছে, কোন শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন বিষয়ে শতভাগ নম্বর পেয়েছে! অভিভাবকরাও বুক ফুলিয়ে একে অন্যকে বলতে লাগলেন, আমার সন্তান তো পরীক্ষায় শতভাগ নম্বর পেয়েছে, তোমারটার কী অবস্থা। যাকে বলা হচ্ছে, সেই অভিভাবকের সন্তান শতভাগ নম্বর পেলে তো রক্ষা। আর যদি না হয়, তাহলেএখন থাক, পরে কথা বলব’ বলে কলটা কেটে দিচ্ছে। অর্থাৎ, যিনি কলটা দিচ্ছেন আর যিনি রিসিভ করছেন, উভয়ই একটি অসুস্থ মানসিকতার জায়গা থেকে পরস্পরের সঙ্গে আচরণ করছেন। একজনের মানসিকতা দেখিয়ে দেয়ার, অন্যজনের অনুভূতি গ্লানিময়। আর এ মানসিক গ্লানিটা তিনি ঝাড়ছেন সন্তানের ওপর। অবাক হয়ে ভাবি, এরপর কী? তখন কী সে গল্পের মতো অবস্থা হবে, যেখানে একজন শিক্ষক শিক্ষার্থীর উত্তর পড়ে আবেগে আপ্লুত হয়ে ১০০-তে ১১০ নম্বর দিয়ে দেন। তখন কী সেটিই হয়ে ওঠবে ভালো রেজাল্টের মানদণ্ড?

বর্তমানে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা, জেএসসি পরীক্ষা থাকায় একেবারে শৈশব থেকেই শিক্ষার্থীরা এসব নোংরা প্রতিযোগিতার শিকার হচ্ছে। এটি তাদের মনোজগতে চিরস্থায়ী দাগ তৈরি করছে। আর এ পালে হাওয়া দিচ্ছে কোচিং সেন্টারগুলো। তারা নানা চটকদার বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে এ প্রতিযোগিতা তীব্রতর করছে। কোন কোচিং সেন্টারগুলো থেকে কত বেশি সংখ্যক শিক্ষার্থী শতভাগ নম্বর পাচ্ছে, তার ধুন্ধুমার প্রতিযোগিতা চলছে। চাকরির বাজারেও একই অবস্থা। বিসিএস ক্যাডার বা অন্য কোনো সরকারি ছাড়া অন্যান্য চাকরিকে বর্তমান প্রজন্ম চাকরিই মনে করছে না। এগুলো জোটাতে না পারলেই কেবল তারা বাধ্য হয়ে অন্য চাকরি করছে। আবার বিসিএস ক্যাডারের ক্ষেত্রেও হাতে গোনা কয়েকটি ক্যাডার, যেমন প্রশাসন, পুলিশ, কাস্টমস—এ ধরনের কয়েকটি ক্যাডার ছাড়া অন্য ক্যাডারগুলোও তারা তেমন একটা পছন্দ করে না। ফলে এগুলোয় কোয়ালিফাই করতে না পারলে তারা হতাশ হয়ে যাচ্ছে।

শুক্রবার (২৮ জুলাই) এসএসসি পরীক্ষার রেজাল্ট দেয়ার দিন ধার্য করা আছে। আর রেজাল্ট দেয়ার পরই আমরা গণমাধ্যমে আত্মহত্যার খবরের ছড়াছড়ি দেখব। কেউ ফেল করে আত্মহত্যা করেছে, কেউ জিপিএ ৫ না পেয়ে আত্মহত্যা করেছে, কেউবা আবার আত্মহত্যা করেছে প্রতিটি বিষয়ে শতভাগ নম্বর না পাওয়ার কারণে! এটি যেন এক নিরন্তর তামাশা হয়ে ওঠেছে। প্রতি বছর বিভিন্ন প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার রেজাল্ট দেয়, আর শুরু হয় আত্মহত্যার হিড়িক। গণমাধ্যমগুলো সেসব সংবাদ ফলাও করে প্রচার করে। আর আমরা সেগুলো ফেসবুকে শেয়ার দিয়ে একটু আহা-উহু করি। এটি যেন একটি গেম! এ খেলায় আমরা মজা পেয়ে গেছি। তাই এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক পর্যায়ে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেই। ফলে এ অসুস্থ প্রতিযোগিতার ভার বইতে না পেরে অকালে ঝরে যাচ্ছে অসংখ্য প্রাণ কিংবা কাঙ্ক্ষিত চাকরি জোগাড় করতে না পেরে ধুঁকে ধুঁকে মৃতবৎ জোম্বির মতো বেঁচে আছে অনেকেই।

এ সংকটময় পরিস্থিতি থেকে আমাদের কোমলমতি শিক্ষার্থী ও তরুণ প্রজন্মকে উদ্ধার করতে হলে মানসিকতার পরিবর্তন জরুরি। সেজন্য শিক্ষাসহ যাবতীয় সব ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতার মনোভাব দূর করতে হবে। তার পরিবর্তে সহযোগিতা ও সহমর্মিতার মানসিকতা তৈরি করতে হবে। কেউ সাফল্য পেলে যেমন উদযাপন করতে হবে, তেমনই যে ব্যর্থ হচ্ছে তাকে অধিকতর দরদ দিয়ে বুকে আশ্রয় দিতে হবে। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, প্রতিটি মানুষের সামাজিক মর্যাদা নিশ্চিত করতে হবে। কারো কাজই ছোট নয়। এ বোধ জাগাতে হবে। সমাজ কারো একক প্রচেষ্টায় এগিয়ে যায় না, বরং সমাজের প্রতিটি সদস্য তার নিজ নিজ জায়গায় কার্যকর ভূমিকা রেখে সমাজকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। তাই সবাই যেন ন্যূনতম মর্যাদাটুকু পায়, তা নিশ্চিত করতে হবে। এ মুহূর্ত থেকেই তা শুরু করতে হবে। নচেৎ এ অসুস্থ প্রতিযোগিতা জাতি হিসেবে আমাদের ধ্বংস ত্বরান্বিত করবে।

আরও