বঙ্গবন্ধুর শৈশব: দিগ্বিজয়ের প্রতিধ্বনি

শৈশবে গড়ে ওঠা জাগ্রত সময়ে কোমল মন তার পথনায়ক খুঁজে ফেরে, চারদিকে ভ্রান্তির ছল আর মুখোশের আড়ালে সুবিধাবাদী মানুষের ঢেউয়ে জীবন যখন প্রেরণার মূর্ত প্রতীক সন্ধানে রত, তখন দুর্মুখে চলে সত্যের অপলাপ কিংবা সত্য আড়াল করার ধুন্দুমার চেষ্টা। এদিকে সব প্রান্তে বাজে চেতনার জয়োল্লাস, কিন্তু থেকে থেকে যে বজ্রধ্বনি আকাশে-বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে তাকে কেই-বা ঢেকে রাখতে পারে?

শৈশবে গড়ে ওঠা জাগ্রত সময়ে কোমল মন তার পথনায়ক খুঁজে ফেরে, চারদিকে ভ্রান্তির ছল আর মুখোশের আড়ালে সুবিধাবাদী মানুষের ঢেউয়ে জীবন যখন প্রেরণার মূর্ত প্রতীক সন্ধানে রত, তখন দুর্মুখে চলে সত্যের অপলাপ কিংবা সত্য আড়াল করার ধুন্দুমার চেষ্টা। এদিকে সব প্রান্তে বাজে চেতনার জয়োল্লাস, কিন্তু থেকে থেকে যে বজ্রধ্বনি আকাশে-বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে তাকে কেই-বা ঢেকে রাখতে পারে?

প্রেরণার বাতিঘর থেকে যিনি আওয়াজ তুলেছিলেন স্বাধীনতার, যার গগনবিদারী আহ্বান ইথারে ছড়িয়ে জাগরণের মহাকাব্য রচিত হয়েছিল। সে মহাপুরুষের শৈশবও ছিল এক অনন্য সমুদ্রে গাথা, যেথায় সাম্পানের পাল তুলে ক্রমাগত জীবনকে নিয়ে গেছেন মহাজীবনের স্বর্ণদ্বারে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বগুণের বিষয়টি শৈশবেই পরিলক্ষিত হয়েছিল। অসমাপ্ত আত্মজীবনী থেকে জানা যায়, বঙ্গবন্ধু গরিব শিক্ষার্থীদের জন্য বাড়ি বাড়ি গিয়ে মুষ্টিচাল সংগ্রহ করে তাদের বইকেনা ও পড়াশোনার খরচ জোগানোর ব্যবস্থা করতেন। এমনকি তিনি তার মাস্টার মশাইয়ের সঙ্গে ঘুরে তাদের জন্য জায়গিরও ঠিক করে দিতেন। মাস্টার মশাইয়ের মৃত্যুর পর তিনি সেবা সমিতির দায়িত্ব গ্রহণ করে অসহায় শিক্ষার্থীদের সেবার কাজ চালিয়ে যান।

খুব ছোটবেলায়ই তার চোখে গ্লুকোমা ও হার্টের সমস্যা ধরা পড়ার পরও তিনি তার সেবামূলক কাজ চালিয়ে যান। তিনি গোপালগঞ্জ মিশন স্কুলে পড়ার সময় যারা মহকুমায় ভালো খেলত, তাদের তিনি তার স্কুলে এনে ভর্তি করে বেতন ফ্রি করে দিতেন। বঙ্গবন্ধু ছোটবেলা থেকেই অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বড় হন, তার কাছে হিন্দু-মুসলমান কোনো ভেদাভেদ ছিল না। হিন্দু ছেলেদের সঙ্গে তার বেজায় বন্ধুত্ব ছিল, তিনি হিন্দু বন্ধুদের নিয়ে একসঙ্গে গানবাজনা, খেলাধুলা, বেড়ানো সব কিছুই করতেন। তিনি খুব সাহসী ছিলেন, কোনো অন্যায় সহ্য করতে পারতেন না। তার কোনো বন্ধু বিপদে পড়লে ঝুঁকি নিয়ে উদ্ধার করে আনতেন।

একবার অবিভক্ত বাংলার মুখ্যমন্ত্রী শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক যখন গোপালগঞ্জ মাথুরানাথ মিশনারি স্কুল পরিদর্শনে আসেন তখন তার সঙ্গে ছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। এটা সেই ১৯৩৯ সালের কথা। স্কুলের ছাত্র-শিক্ষক, স্কুল পরিচালনা পর্ষদ সবাই ব্যস্ত। স্কুলের ক্লাসরুম, বারান্দা, পায়খানা-প্রস্রাবখানা সব ঝকঝকে পরিষ্কার। গাছ থেকে একটি ঝরাপাতা উড়ে এসে বারান্দায় পড়লে হেডমাস্টার সাহেব কাউকে কিছু না বলে নিজেই ঝট করে পাতাটা তুলে ফেলছেন। দু সপ্তাহ আগেই ছাত্রছাত্রীদের বলে দেয়া হয়েছে সেদিন যেন সবাই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও মার্জিত পোশাক পরে স্কুলে হাজির হয়। কারণ ওইদিন অবিভক্ত বাংলার মুখ্যমন্ত্রী স্কুল পরিদর্শনে আসবেন তার রাজনৈতিক সহচর হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে নিয়ে। ভালোয় ভালোয় স্কুল পরিদর্শন শেষে মন্ত্রী মহোদয় ডাকবাংলোর দিকে হেঁটে যাচ্ছিলেন। এমন সময় একদল ছাত্র এসে হঠাৎ তাদের পথ আগলে দাঁড়াল। ছাত্রদের এমন কাণ্ড দেখে হেডমাস্টার সাহেব রীতিমতো ভড়কে গেলেন। তিনি চিৎকার দিয়ে বললেন, ‘এই তোমরা কী করছ রাস্তা ছেড়ে দাও।’

এমন সময় হ্যাংলা পাতলা লম্বা ছিপছিপে মাথায় ঘন কালো চুলের ব্যাক ব্রাশ করা খোকা (বঙ্গবন্ধু) গিয়ে দাঁড়ালেন একেবারে মুখ্যমন্ত্রীর সম্মুখে। মন্ত্রী মহোদয় জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কী চাও?’ বুকে সাহস নিয়ে নির্ভয়ে খোকা উত্তর দিলেন, ‘আমরা এই স্কুলেরই ছাত্র। স্কুলের ছাদে ফাটল ধরেছে। সামান্য বৃষ্টি হলেই সেখান থেকে বৃষ্টির পানি চুইয়ে পড়ে আমাদের বই-খাতা ভিজে যায়। ক্লাস করতে অসুবিধা হয়। স্কুল কর্তৃপক্ষের কাছে বারবার এ ব্যাপারে বলা হলেও কোনো ফল হয়নি। ছাদ সংস্কারের আর্থিক সাহায্য না দিলে রাস্তা মুক্ত করা হবে না।’ কিশোর ছাত্রের বলিষ্ঠ নেতৃত্ব, সৎ সাহস আর স্পষ্টবাদিতায় মুগ্ধ হয়ে মুখ্যমন্ত্রী জানতে চাইলেন, ‘ছাদ সংস্কার করতে তোমাদের কত টাকা প্রয়োজন?’ সাহসী কণ্ঠে খোকা জানালেন, ‘বারোশ টাকা।’ মুখ্যমন্ত্রী প্রত্যুত্তরে বললেন, ‘ঠিক আছে, তোমরা যাও। আমি তোমাদের ছাদ সংস্কারের ব্যবস্থা করছি।’ তিনি তার তহবিল থেকে ওই টাকা মঞ্জুর করে অবিলম্বে ছাদ সংস্কারের জন্য জেলা প্রশাসককে নির্দেশ দিলেন। এ ঘটনার সময় বঙ্গবন্ধু মাত্র অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র ছিলেন।

স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনটি এখন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার ঘোষিত ‘জাতীয় শিশু দিবস’। কারণ বঙ্গবন্ধু শিশুদের খুব ভালোবাসতেন, তাই শৈশব থেকেই শিশুদের কাছে তাকে পরিচিত করা খুব বেশি জরুরি। তাহলে শিশুরা ছোটবেলা থেকেই স্বপ্নালু চোখে বঙ্গবন্ধুর মতো দিগ্বিজয়ী আদর্শের আলোকে বেড়ে উঠে আগামী দিনের কাঙ্ক্ষিত বাংলাদেশ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে। বিশেষ করে ডিজিটাল বাংলাদেশের পথ ধরে আগামীর স্মার্ট বাংলাদেশে রূপান্তরের ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুর মতো সাহসী নেতা আজ বড় প্রয়োজন।

বর্তমানে ডিভাইসকেন্দ্রিক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের গড্ডলিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে না দিয়ে যেসব শিশু জীবনে বড় হওয়ার স্বপ্ন দেখে, তাদের সামনে বঙ্গবন্ধুকে পরিচিত করে তুলতে হবে। বর্তমানে বঙ্গবন্ধুকে চেনার জন্য অনেকগুলো মাধ্যম রয়েছে। বইয়ের পাশাপাশি বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে গ্রাফিক নভেল সিরিজ ‘মুজিব’ প্রকাশ হয়েছে। ‘মুজিব: একটি জাতির রূপকার’ নামে চলচ্চিত্র যেমন রয়েছে, তেমনি ‘মুজিব ভাই’ নামে অ্যানিমেটেড ফিল্মও রয়েছে। এর মাধ্যমে আগামী প্রজন্মের কাছে বঙ্গবন্ধুকে খুব সহজেই উপস্থাপন করা যাবে।

আমরা প্রত্যাশা করি, নতুন প্রজন্ম বেড়ে উঠুক বঙ্গবন্ধুর রেখে যাওয়া দৃপ্ত আদর্শে। এজন্য যারা বঙ্গবন্ধুর আদর্শের রাজনীতি করছেন, তাদেরই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে।

তৌফিকুল ইসলাম: সহসম্পাদক, বণিক বার্তা

আরও