সাতসতেরো

ভোগপ্রবণতা ও খাদ্যনিরাপত্তা ভাবনা

গ্রামের গৃহস্থ পরিবারের কোনো সদস্যের বিয়েশাদির সময় নিজেদের স্বাবলম্বী অবস্থা বোঝাতে আগের দিনে মুরব্বিরা বলতেন, আল্লাহর রহমতে লবণ ও কেরোসিন ছাড়া আর কিছু কিনতে হয় না! অর্থাৎ ওই পরিবারে দরকারি প্রায় সব জিনিস তারা নিজেরাই উৎপাদন করতে পারেন! অথচ মাত্র তিন-চার দশকের ব্যবধানে সেই পরিবারগুলো এখন পুরোপুরি ভোক্তায় পরিণত হয়েছে। বেড়েছে দরকারি জিনিসপত্রের

গ্রামের গৃহস্থ পরিবারের কোনো সদস্যের বিয়েশাদির সময় নিজেদের স্বাবলম্বী অবস্থা বোঝাতে আগের দিনে মুরব্বিরা বলতেন, আল্লাহর রহমতে লবণ ও কেরোসিন ছাড়া আর কিছু কিনতে হয় না! অর্থাৎ ওই পরিবারে দরকারি প্রায় সব জিনিস তারা নিজেরাই উৎপাদন করতে পারেন! অথচ মাত্র তিন-চার দশকের ব্যবধানে সেই পরিবারগুলো এখন পুরোপুরি ভোক্তায় পরিণত হয়েছে। বেড়েছে দরকারি জিনিসপত্রের ক্ষেত্রে পরমুখাপেক্ষী হওয়ার প্রবণতা। এতে শুধু সেই পরিবারগুলোরই নয়, বরং গোটা দেশের নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের চাহিদা ও জোগানে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। ফলে কতিপয় প্রভাবশালী ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর হাতে চলে গেছে একেকটা খাতের নিয়ন্ত্রণ। গোটা দেশের ক্রেতারা তাদের কাছে রীতিমতো জিম্মি হয়ে পড়েছে। বহু ক্ষেত্রে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোও তাদের কাছে অসহায়।  

বৈশিষ্ট্যগতভাবেই আমরা কোনো সংকটের গভীরে যেতে পছন্দ করি না। বড় সমস্যা সামনে এলে সবসময় সাময়িক সমাধান খুঁজি। সংকট কিছুটা লাঘব হলেই সেগুলোর ব্যাপারে পুরো মাত্রায় উদাসীন হয়ে পড়ি। ফলে সমস্যাগুলো সিস্টেমের মধ্যেই টিউমারের মতো ঘাপটি মেরে থাকে। সুযোগ বুঝে মাঝে মাঝে সেগুলো জাগান দেয়, কষ্ট বাড়ে। সাধারণ মানুষের হয় নাভিশ্বাস অবস্থা। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের ক্ষেত্রে কয়েকদিন পরপর অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি, অস্থিরতা সৃষ্টি ও সাধারণ মানুষের পকেট কাটা যেন রুটিনে পরিণত হয়েছে। আগে এমন পরিস্থিতি ব্যাপক বন্যা, তীব্র খরা বা যুদ্ধের মতো পরিস্থিতিতে হতো। স্বাভাবিক সময়ে এমন প্রবণতা ছিল না বললেই চলে। তাহলে এখন মাঝে-মধ্যেই সেটা হচ্ছে কেন? সে বিষয়ে আলোকপাত করাই এ নিবন্ধের লক্ষ্য।

এক্ষেত্রে প্রচলিত ধারণা হলো সংশ্লিষ্ট পণ্যের আমদানিকারক বা মজুদদারদের কারসাজিতে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। এ বিষয়ে গভীর অনুসন্ধান দরকার ছিল। বাস্তবে তা কখনই করা হয়নি। ফলে প্রকৃত কারণ আমাদের জানা নেই। তবে ভোক্তা হিসেবে আমাদের ভোগপ্রবণতার উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন তাদের এ কাজে কীভাবে সাহায্য করছে তা কয়েকটি খাতের উদাহরণের মাধ্যমে তুলে ধরতে চেষ্টা করছি:   

ভোজ্যতেল: আমরা শৈশবে ভোজ্যতেল বলতে বুঝতাম সরিষার তেল। পরিবারের গোটা বছরের তেলের চাহিদা মেটানোর জন্য সাধারণত প্রয়োজনীয় পরিমাণ জমিতে সরিষা চাষ করা হতো। তবে এটা ‘গরম তেল’ বলে ধারণা ছিল। তাই বিকল্প হিসেবে অল্প কিছু তিল চাষও করা হতো। সেগুলো নিকটস্থ ঘানিতে ভাঙিয়ে প্রয়োজনীয় তেল পাওয়া যেত। এমনকি বছরে দু-একবার নারকেলও ভাঙানো হতো। তাতে দরকারি নারকেল তেল পাওয়া যেত। যাদের এমনটা করার সামর্থ্য ছিল না, তারা স্থানীয় ‘সাজি’ বা ঘানির তেল বিক্রেতাদের কাছ থেকে তেল কিনত। তবে বড় গৃহস্থ পরিবারগুলো নিজেদের তেলের চাহিদা মেটানোর জন্য কারো ওপর নির্ভরশীল থাকার কথা কল্পনাও করত না।  

হঠাৎ করেই রেডিও-টেলিভিশনে সয়াবিন তেলের ব্যাপক প্রচার শুরু হয়। এটা খুব পাতলা এবং শরীরের জন্য উপকারী তেল বলে প্রচার শুরু হয়। মাঝে পাম অয়েল বাজারজাত করার চেষ্টা হয়েছিল। তবে সয়াবিন তেলের দাপটে তা খুব একটা সফলতা পায়নি। কারণ বিজ্ঞাপনে দাবি করা হয়, সয়াবিন তেলে উপকারী কোলেস্টেরল ও ফ্যাটি অ্যাসিড রয়েছে। তাই খুব স্বল্প সময়ের মধ্যেই সেটা পরিবারগুলোয় জনপ্রিয় হয়। শুরুতে দামও তুলনামূলক কম ছিল। ফলে আগে তেলের ব্যাপারে পুরোপুরি স্বাবলম্বী, দেশের বিপুল পরিমাণ ভোজ্যতেলের জোগানদাতারা আকস্মিক ‘পরনির্ভরশীল ক্রেতা’য় পরিণত হয়। দেশের বড় গৃহস্থ পরিবারগুলোও এখন ভোজ্যতেলের জন্য পুরোপুরি ব্যবসায়ীদের ওপর নির্ভরশীল। বর্তমানে ‘ঘানি’র স্থান হয়েছে জাদুঘরে। ভোজ্যতেলের প্রায় ৯০ শতাংশ আমদানিনির্ভর। সংগত কারণেই হাতে গোনা কয়েকজন বড় ব্যবসায়ী সেগুলো নিয়ন্ত্রণ করেন। তাদের মর্জিমাফিক ভোজ্যতেল আমদানি, সরবরাহ ও মূল্য নির্ধারিত হয়! সেজন্য মাঝে-মধ্যে অস্থিরতা সৃষ্টি হবে সেটা তো স্বাভাবিক, তাই না? 

চিনি: আমার জন্মস্থান ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় মোট চারটি (নাটোর, নর্থ বেঙ্গল, হরিয়ান, পাবনা) চিনিকল রয়েছে। এ থেকে সহজেই বোঝা যায়, একসময় আমাদের এলাকার প্রধান অর্থকরী ফসল ছিল আখ। প্রত্যেক কৃষক প্রতি বছর তার আবাদি জমির অর্ধেক বা তার বেশি অংশে আখ রোপণ করতেন। কারণ এর মাধ্যমে তাদের গোটা বছরের নগদ টাকার জোগাড় হতো। উৎপাদিত সব আখ যে চিনিকলে বিক্রি হতো তা নয়। প্রায় প্রতি গ্রামে এক বা একাধিক আখ মাড়াইকল ছিল। সেগুলোয় গুড় তৈরি হতো। নাটোর স্টেশন বাজার এলাকায় অনেকগুলো বড় গুড়ের আড়ত ছিল। সেখান থেকে সারা দেশে গুড় চালান হতো। তাছাড়া শীতকালে খেজুরের রস থেকে গুড় উৎপাদনের পরিমাণও কম ছিল না। বিশেষত প্রত্যেক পরিবার শীতের পিঠা-পায়েসের জন্য কয়েকটি করে খেজুর গাছ লাগাত। তখন গ্রামের মানুষ চিনি কেনার কথা কল্পনাও করত না। কারণ প্রত্যেক পরিবারে এমন গুড় মজুদ থাকত, যা দিয়ে গোটা বছরের মিষ্টির চাহিদা পূরণ হতো।

আখ কেনার ক্ষেত্রে অপ্রয়োজনীয় (হয়তো ইচ্ছাকৃতভাবে সৃষ্ট) নানা জটিলতা, হয়রানি ও অসহযোগিতার কারণে কৃষক একপর্যায়ে আখ চাষে বিমুখ হতে থাকেন। এখন আখ উৎপাদন এতটাই কমেছে যে কাঁচামালের অভাবে নাটোর সুগার মিল এক-দেড় মাসের বেশি চালু থাকে না। অথচ আগে তা পাঁচ-ছয় মাস পর্যন্ত উৎপাদনে থাকত! তাছাড়া দেশে উৎপাদিত চিনির মান যথেষ্ট উন্নত হওয়ার পরও একটা গোষ্ঠী তা আমদানিতে ব্যাপকভাবে উৎসাহী ছিল। এখন দেশে উৎপাদন (মোট চাহিদার মাত্র দেড় শতাংশ) ব্যাপকভাবে কমে যাওয়ায় তাদের পোয়াবারো হয়েছে। ইচ্ছামতো কদিন পরপর চিনির বাজার অস্থির করে সুবিধা তুলে নেয়া যায়। তাছাড়া বিকল্প পণ্য হিসেবে গুড় উৎপাদন এতটাই কমেছে যে এখন গুড় উৎপাদনে চিনি ভেজাল দেয়া হয়!         

মুরগির মাংস ও ডিম: একসময় গ্রামের প্রত্যেক পরিবার ছিল হাঁস-মুরগি ও ডিমের উৎস। বিশেষত মায়েরা তাদের হাতখরচ ও অন্যদের সহযোগিতা করার জন্য এ উৎসের ওপর বিশেষভাবে নির্ভরশীল ছিলেন। বাড়ির সদস্যদের আমিষের চাহিদা পূরণ কিংবা মেহমান এলে পরিবারের পুরুষ সদস্যদের তা নিয়ে খুব একটা ভাবতে হতো না। বাড়ির মুরগি ও ডিম ছিল সুস্বাদু ও ভেজালমুক্ত। গ্রামের মানুষ কখনো সেগুলো কিনে খাওয়ার কথা চিন্তাই করত না। বরং হাটের দিন নগদ টাকার প্রয়োজনে কৃষক প্রয়োজনমতো উদ্বৃত্ত হাঁস-মুরগি-ডিম বিক্রি করতেন।   

স্বল্পদিনের ব্যবধানে সে জায়গা পুরোপুরি দখল করেছে ফার্মের মুরগি। আমরা সবাই জানি, সেগুলো স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। তার পরও সেগুলোর ওপর নির্ভরশীলতা ক্রমেই বাড়ছে। শহর তো বটেই, গ্রামের সাধারণ মানুষও এখন পুরোপুরি ফার্মের পণ্যের ওপর নির্ভরশীল। ডিমের ক্ষেত্রেও চিত্র অভিন্ন। বৈচিত্র্যময় উৎস থেকে পণ্যের সরবরাহ থাকলে তার মূল্য নিয়ে কারসাজি করার খুব একটা সুযোগ থাকে না। কিন্তু বর্তমানে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষও নিজেরা উৎপাদনকারীর জায়গা থেকে সরে পুরোপুরি ভোক্তায় পরিণত হচ্ছে। ফলে ওই সেক্টরের কিছু মানুষের মর্জিমাফিক সরবরাহ ও মূল্য নির্ধারিত হয়। মাঝে-মধ্যেই অস্থিরতা বাড়ে।     

কাগজ: দীর্ঘদিন থেকে বিপুল পরিমাণ কাগজ দেশেই উৎপন্ন হয়। পাকশী পেপার মিল বা চন্দ্রঘোনার দেখানো পথে দেশে এ খাতে বর্তমানে ব্যাপক উন্নতি (১০৬টি পেপার মিল) হয়েছে। ক্রমেই এ খাতে চাহিদা (প্রায় ১০ লাখ টন) ও বিনিয়োগ উভয়ই বেড়েছে। ফলে কাগজ উৎপাদনের সামর্থ্য বেড়েছে উল্লেখযোগ্য মাত্রায়। অথচ একটা গোষ্ঠী দেশের কাগজ ব্যবহারের চেয়ে বিপুল পরিমাণে কাগজ আমদানিতে আগ্রহী! ফলে তাদের কেউ কেউ চাহিদা ও জোগানে ভারসাম্যহীন অবস্থার সৃষ্টি করে ফায়দা নিতে চায়। যথেষ্ট উৎপাদনের সামর্থ্য থাকার পরও কাগজের দাম বাড়ছে। অথচ তার সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনায় কার্যকর উদ্যোগ নেয়া যাচ্ছে না। ফলে শুধু উৎপাদনের মাত্রা নয়, তার দক্ষ ব্যবস্থাপনাও অপরিহার্য। 

এভাবে পেঁয়াজ, রসুন, আদা, মরিচ, আলু, টমেটো প্রভৃতি নিত্যব্যবহার্য উপাদান একসময় দেশের অধিকাংশ পরিবারে উৎপন্ন হতো। তারা নিজেদের চাহিদা মিটিয়ে অতিরিক্ত থাকলে সেগুলো বিক্রি করত। এমনকি মাছ, মাংস, ডিম, দুধের ক্ষেত্রেও স্থানীয়ভাবে চাহিদা ও জোগানের মোটামুটি ভারসাম্য বজায় থাকত। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের ক্ষেত্রে নিঃসন্দেহে এ মডেল কার্যকর ও টেকসই ছিল। কারণ তখন মাঝে-মধ্যেই এমন হাহাকার শোনা যেত না। তাছাড়া আমরা যে চেষ্টা করলে পারি তার বড় প্রমাণ হলো ফল চাষ ও ডেইরি ফার্মের প্রসার। দেশে বিপুল পরিমাণ ফলের চাষ পুরো ফল মার্কেটের বড় অংশ দখল করতে সক্ষম হয়েছে। তাছাড়া দেশীয় গরু উৎপাদন এমন মাত্রায় বেড়েছে যে কোরবানির সময় তেমন হাহাকার আর শোনা যায় না। ফলে আমাদের স্ট্রেন্থের জায়গা বুঝে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে।  

আমরা বুঝি বা না বুঝি এটা সত্য যে বিশ্বব্যাপী খাদ্যনিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা বাড়ছে। রাশিয়ার গম ও ভারতের চাল রফতানি বন্ধের ঘোষণা বিশ্বব্যাপী খাদ্য সংকটের ইঙ্গিত দিচ্ছে। তাছাড়া তীব্র প্রতিকূল আবহাওয়া, ঘন ঘন প্রাকৃতিক দুর্যোগ, অপ্রত্যাশিত ঘটনায় ফসলহানির প্রবণতা বাড়ছে। এমন পরিস্থিতিতে বিপুল জনগোষ্ঠীর এ দেশে খাদ্য ও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের ক্ষেত্রে স্বনির্ভরতা বাড়ানো অত্যন্ত জরুরি। সেক্ষেত্রে পরনির্ভরশীলতা কমাতে আমাদের পরীক্ষিত মডেল চর্চার বিকল্প নেই। 

বৈশ্বিক প্রতিকূলতা বাড়তে থাকলে সামনে এমন সময় আসতে পারে যে কেউ কারো দিকে তাকানোর সুযোগ পাবে না। ফলে নিজেদের খাদ্যের চাহিদা পূরণে নিজেদেরই উদ্যোগী হতে হবে। তাছাড়া এ খাতে রাতারাতি কোনো পরিবর্তন আনা সম্ভব নয়। তাই দীর্ঘমেয়াদে কল্যাণের কথা ভেবে সমগ্র দেশে পরিকল্পনামাফিক প্রয়োজনীয় দ্রব্যগুলো উৎপাদনে মনোযোগী হওয়া দরকার। পাশাপাশি ভোক্তাদের খাদ্যাভ্যাসেও পরিবর্তন আনতে হবে। নইলে বিদেশী পণ্যের আমদানিনির্ভরতা আমাদের বড় ক্ষতির কারণ হতে পারে।

ড. মো. আব্দুল হামিদ: শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগের শিক্ষক ও ‘পোস্ট ক্রাইসিস বিজনেস’ বইয়ের লেখক

আরও