বাংলার ইতিহাস যেমন সুদীর্ঘ, তেমনি বাঙালির আন্দোলন-সংগ্রামের ইতিহাসও অনেক লম্বা; যার কোথাও রক্তস্নাত স্মৃতি, আবার কোথাও বিজয়গাথা। ইতিহাস বলে, ৩২৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটের সেনাবাহিনী তৎকালীন মগধের নন্দ সাম্রাজ্যের সীমানার দিকে অগ্রসর হয় এবং ক্লান্ত সেনাবাহিনী তখন গঙ্গা নদীর কাছাকাছি বাংলার বিশাল বাহিনীর মুখোমুখি হওয়ার সাহস হারিয়ে ফেলে, বাহিনী বিদ্রোহ ঘোষণা করে এবং শেষ পর্যন্ত আজেকজান্ডার দ্য গ্রেট ফিরে চলে যেতে বাধ্য হন। এর দীর্ঘ সময় পরে ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে বাংলার স্বাধীনতা সূর্য অস্তমিত হয়। আমরা ব্রিটিশদের শোষণের কবলে পতিত হই। ব্রিটিশদের কাছ থেকে মুক্ত হতে হয়েছে অনেক আন্দোলন সংগ্রাম। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসনের অবসান হলো, ভারতবর্ষ ভেঙে দুই টুকরো হলো, যেখানে ভারত ও পাকিস্তানের উদ্ভব, পাকিস্তানের আবার দুটি অংশ পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তান। বাঙালি এবার পশ্চিম পাকিস্তানের শোষণের জাঁতাকলে পড়ে। বৈষম্য, শোষণ, নিপীড়ন, অত্যাচার, অবিচারে অতিষ্ঠ বাঙালি রক্ত দিয়ে প্রথম প্রতিরোধ গড়ে তোলে ১৯৫২ সালে মাতৃভাষা রক্ষায়। সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার প্রমুখের রক্তে রঞ্জিত হয় ঢাকার রাজপথ। সেই থেকে পশ্চিম পাকিস্তানের শোষণ, নির্যাতন আর অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ সংগ্রাম চলতেই থাকে। ১৯৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান, ১৪৪ ধারা ভেঙে মিছিল নিয়ে যাচ্ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি আমানুল্লাহ মুহাম্মদ আসাদুজ্জামান (আসাদ), পুলিশের গুলিতে শহীদ হলেন। আবার রক্তাক্ত হলো রাজপথ, শহীদ আসাদ এখনো বাঙালির মনে গেঁথে আছেন, উন্নত শিরে দাঁড়িয়ে আছে তার স্মৃতি স্মারক আসাদ গেট।
১৯৭০-এর নির্বাচনে বাঙালির বিজয়ের পরও ক্ষমতা হস্তান্তরে গড়িমসি পশ্চিমাদের। শেষ পর্যন্ত ১৯৭১-এ এক দফা স্বাধীনতার ডাক। ৩০ লাখ শহীদের রক্তগঙ্গা বইয়ে যে স্বাধীনতা এল তা তো তারুণ্যের অর্জন, বাঙালির হাজার বছরের প্রতীক্ষার পরিসমাপ্তি।
হাজার বছর শোষিত বাঙালি নিজের মানচিত্র পেয়েছে, এবার বুক ফুলিয়ে বিশ্বসভায় যাবে, পৃথিবীজুড়ে ছড়িয়ে পড়বে এই তো স্বপ্ন, আশা।
শত সহস্র বাধা পেরিয়ে যে বাঙালি দেশ পেয়েছে, নিজের পরিচয় পেয়েছে তার মননে মগজে মাথা উঁচু করে কথা বলার প্রত্যয় থেকেই যায়। তাই প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক পেরিয়ে শিক্ষার্থী যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্পণ করে তখন সে আর ছোট্টটি থাকে না। যে কিনা স্কুল-কলেজে শিক্ষকের মুখের দিকে তাকিয়ে কথা বলতে সাহস করে না সে-ই বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে সমাজনীতি, অর্থনীতি, রাজনীতি কিংবা শ্রেণীকক্ষের বিষয়ভিত্তিক পাঠ নিয়ে শিক্ষকের সঙ্গে বাহাসে যোগ দেয়, নিজের ধারণা-মতামত তুলে ধরে এবং সৃষ্টিশীল শিক্ষক এটিকে উপভোগ করেন, মনে মনে আনন্দ অনুভব করেন। আমার নিজের ছাত্রজীবন থেকে শুরু করে শিক্ষকতা জীবনে এমন অভিজ্ঞতা অনেক। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীটি আর কিশোর নয়, পুরোদস্তুর তরুণ। সেটি সমাজ বা রাষ্ট্র বুঝুক আর না বুঝুক। এ তরুণ স্বপ্ন দেখে, ভবিষ্যতের জাল বোনে, তার ভবিষ্যতে কী থাকবে তা নির্ভর করে তার বর্তমান অবস্থার ওপর।
বাঙালির মাঝে মানুষ বাস করলে হয়তো বাস্তবতা বুঝে ঘটনার শুরুতে এর সমাধান খুঁজত। পানি ঘোলা করে সমাধান খোঁজা যেমন বোকামি, তেমনি রক্তের বন্যার মাঝে, লাশের স্তূপে বসে কি সন্ধি হয়? এর মাঝে বাঙালির স্বভাব ‘ঘর পোড়ার মাঝে আলু পোড়া’ তো হয়েই গেল। আহা বাঙালি! এত যে প্রাণ গেল ছোট্ট শিশু, টগবগে তরুণ যার মাঝে ছিল ছাত্র, খেটে খাওয়া মানুষ তাদের কি আর ফিরে পাওয়া যাবে? ‘পানি লাগবে পানি’ বলে হাস্যময় মুগ্ধর কণ্ঠ কিংবা ‘ঘরে আমার বোন আছে’ বলে মিনতি করা কিশোরের আর্তি, বারান্দায় খেলতে যাওয়া ছোট্ট মেয়েটির চোখ এফোঁড়-ওফোঁড় করে যাওয়া রক্ত মাখা বুলেট কি তোমাকে ব্যথিত করে না? সুশীল সমাজ, বুদ্ধিজীবী তাদের কি মনে কোনো প্রশ্ন আসে না? কেন এমন হয়? কেন এমন হলো? এমন প্রশ্ন করার অনুভূতি, সাহস, বিবেক থাকলে নীতিনির্ধারকদের সামনে সঠিক কথাটি বলে পরামর্শ দিলে হয়তো আমাদের সন্তান, ভাই-বোনদের রক্তে রঞ্জিত হতো না রক্তাক্ত জুলাই। এত লাশ বাঙালি কীভাবে বইবে!
১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর রাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে আমাদের শ্রেষ্ঠ সন্তানরা সাদাকে সাদা এবং কালোকে কালো বলার ক্ষমতা রাখার কারণে খুন হন। সেই সূর্যসন্তানদের অভাব জাতি কাটিয়ে উঠতে পারেনি, বরং দিন দিন তাদের সংখ্যা কমতে কমতে বিরল হয়ে পড়েছে। তাদের উত্তরাধিকার যেমন খুব কম সৃষ্টি হয়েছে, তেমনি সময়ে সময়ে অনেকের মুখে কুলুপ এঁটে দেয়া হয়েছে। ফলে শ্রেণীকক্ষে নির্ভীক চিত্তে মতামত প্রকাশ যেমন কমে গেছে, তেমনি সঠিক শিক্ষা প্রদানও ব্যাহত হয়েছে। শিক্ষক যখন সঠিক কথাটি বলতে সংকুচিত হন, বাধাপ্রাপ্ত হন, প্রতিষ্ঠানের প্রধান হিসেবে নিখাদ মিথ্যুক আর ভণ্ড চেয়ারটা দখল করে রাখেন সেখানে কি মোটিভেশন পাবে শিক্ষার্থী? কে সঠিক পথ দেখাবে দ্রোহে উত্তপ্ত তরুণ পথিককে?
দ্রোহে উত্তপ্ত তরুণ তো বরং প্রতিনিয়ত পত্রপত্রিকায় খবরে দেখছে কেবল লুটপাট দুর্নীতির খবর, লুটতরাজ, দুর্নীতিতে ছেয়ে গেছে দেশ। যেখানে নেই আশার কোনো বাণী। হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাট করে লুটেরারা বিদেশে পাচার করছে। পিকে হালদার, মতিউর, বেনজীর, আবেদ আলীসহ অগণিত লুটেরা কিংবা কানাডার বেগমপাড়ায় কোটি কোটি টাকা পাচার করে সুরম্য আবাস যারা গড়ে তুলছে তাদের কিছুই হচ্ছে না। আরেকদিকে দরিদ্র, নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্তের সন্তান বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোয় ন্যূনতম সুযোগ-সুবিধা ছাড়া অখাদ্য খেয়ে, অপুষ্টিতে ভুগে জীবনের সামান্য স্বপ্ন দেখছেন। তাদের সে স্বপ্ন পূরণের পথে বৈষম্য, বাধা। দিনে দিনে তাই বিদ্রোহ জ্বলে ওঠে, সেখানে পক্ষ-বিপক্ষ সব এক হয়ে ন্যূনতম ন্যায্য দাবিতে জোটবদ্ধ হয়। কোন শিক্ষকের মোটিভেশন এদের থামাবে? শিক্ষার্থীদের দাবির মর্ম বুঝে যেখানে সমাধান করা যায় সেখানে উল্টো তাদের ওপর নেমে আসে নির্যাতন। এতে দ্রোহ বাড়ে, আগুনের ফুলকি ছড়ায়। সে আগুনের উত্তাপকে কেন্দ্রে পৌঁছতে দেয়া হয় না হয়তো, সেখানে জানানো হয় সব ঠিকঠাক চলছে।
ছোটবেলায় একটি গল্প শুনেছিলাম স্কুলের স্যারের কাছে। মস্ত রাজার রাজদরবার বসেছে। সুনসান নীরবতা। রাজার কাছে কী এক খবর এসেছে, রাজার মুখ গম্ভীর। মোসাহেবরা রাজার এমন রূপ এর আগে কখনো দেখেনি। সভার পিনপতন নীরবতা ভেঙে রাজা গম্ভীর কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন, শুনলাম আমার সীমান্ত রাজ্যে কয়েকদিন ধরে ধোঁয়া দেখা যাচ্ছে, এ বিষয়ে কারো কিছু জানা আছে। প্রতিযোগিতায় উত্তীর্ণ হয়ে কাছের মোসাহেব বললেন, জি রাজাধিরাজ আমাদের সীমান্ত রাজ্যে এবার বেশ ফলন হয়েছে, প্রজারা খুব সুখে-শান্তিতে আছে, সারা দিন তারা রান্নাবান্না করছে, খাচ্ছে, ফুর্তি করছে আর সারা দিনের রান্নার কারণে ধোঁয়া উড়ছে। এর মাঝে একজন নতশিরে দাঁড়িয়ে বললেন, রাজা মহাশয় আমাদের সীমান্ত রাজ্যটি অমুক রাজা দখল করে নিয়েছেন এবং আগুন দিয়ে প্রজাদের ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছেন, লুটতরাজ করেছেন কয়েকদিন ধরে, সেই আগুনের ধোঁয়া উড়ছে। এ খবরটা আপনার কাছে পৌঁছাতে আমি দুদিন ধরে ঘুরে বেড়াচ্ছি কিন্তু আমাকে আপনার কাছে পৌঁছতে দেয়া হয়নি। এমন রাজা, মোসাহেব, আমাত্যবর্গের কারণে রাজ্য হারানোর কাহিনী ইতিহাসের অংশ হয়ে আছে কিন্তু তাতেও রাজার কাছে মোসাহেব অতি প্রিয়পাত্র হয়ে থাকে, অন্ধ হয়ে যায় তারপর যা হয় তা তো রাজ্য বে-দখল হওয়া।
রাজার কাছে সমাজের বাস্তব অবস্থা তুলে ধরার লোক হারিয়ে গেলে বিপর্যয় নেমে আসে। সবাই তো আখের গোছানোয় ব্যস্ত কে দেখাবে পথ, কে দেবে দিশা? বিপর্যস্ত এ কাঠামোতে কে থামাবে তরুণদের? কে শোনাবে আশার বাণী? কে বলবে বাবা ঘরে ফিরে এসো তোমাদের সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়ে দেব বিশ্বাস রেখো। সেটি পারেন শিক্ষক, কিন্তু কোথায় সে শিক্ষক? যে শিক্ষকের গুরুত্ব তথাকথিত একজন ছাত্রনেতার থেকেও তলানিতে, রাষ্ট্র যাকে গুরুত্বহীন মনে করে, শিক্ষার্থী সেই গুরুত্বহীনের কথা কোন ভরসায় শুনবে। ক’জন শিক্ষকইবা ছাত্রকে বুক ফুলিয়ে বলতে পারেন সাদাকে সাদা আর কালোকে কালো বলতে শেখো। শিক্ষকের নিজেরই তো সেটি বলার সাহস নেই, অনেকের মুখ বন্ধ হয়ে গেছে, কেউ কেউ তো মাথাটাই হারিয়ে ফেলেছেন। আসাদের আত্মাহুতি, নূর হোসেনের গণতন্ত্রের জন্য গুলির সামনে বুক পেতে দেয়া থেকে রক্তাক্ত জুলাইয়ে আবু সাঈদ সিনা টান টান করে যেভাবে পুলিশের গুলি বুকে নিয়ে নিল তার মর্মার্থ কি বাঙালি বুঝতে পেরেছে? মানুষ হলে বুঝতে পারত কেন কখন টগবগে তরুণ সবকিছু ভুলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের শোষণমুক্ত, বৈষম্যহীন সুন্দর দিনের জন্য বন্দুকের সামনে বুক পেতে দেয়, আর যে বন্দুকের ট্রিগার টিপে ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের বুক ঝাঁঝরা করে পুরো মানচিত্র রক্তে ভাসিয়ে দিল সে কবিগুরুর ভাষায় স্রেফ বাঙালি হয়ে থাকল, মানুষ হতে পারেনি। সব হতাশা থেকে মুক্তি চেয়ে মানুষ বাঙালি সহস্র বাধার মাঝেও স্বপ্ন দেখে, আসাদ, নূর হোসেন, আবু সাঈদের ডাকে আবার সামনে চলে এক বুক অতি সাধারণ আশা নিয়ে, প্রার্থনা করে ‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে’।
এএসএম সাইফুল্লাহ: অধ্যাপক, মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়