পদ্মা সেতু

দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের আবেগ ও যুগ যুগের ভোগান্তির গল্প

কয়েকদিন ধরে অনেকেই প্রশ্ন করছেন, পদ্মা সেতু নিয়ে দক্ষিণাঞ্চলের মানুষদের মধ্যে আবেগের মাত্রা এত অতিরিক্ত কেন? তাদের প্রশ্নের সরাসরি উত্তর না দিয়ে আমি কিছু গল্প বলছি, পাকিস্তান আমলের কথা, আমি তখন খুব ছোট তবুও কিছু স্মৃতি খুব ভালো মনে আছে। তেমনই একটা স্মৃতি হলো আমার দাদা অনেকদিন আমাদের ঢাকার বাসায় বেড়িয়ে দেশের বাড়ি পিরোজপুর ফিরছেন, আমার আব্বা দাদাকে

কয়েকদিন ধরে অনেকেই প্রশ্ন করছেন, পদ্মা সেতু নিয়ে দক্ষিণাঞ্চলের মানুষদের মধ্যে আবেগের মাত্রা এত অতিরিক্ত কেন? তাদের প্রশ্নের সরাসরি উত্তর না দিয়ে আমি কিছু গল্প বলছি, পাকিস্তান আমলের কথা, আমি তখন খুব ছোট তবুও কিছু স্মৃতি খুব ভালো মনে আছে। তেমনই একটা স্মৃতি হলো আমার দাদা অনেকদিন আমাদের ঢাকার বাসায় বেড়িয়ে দেশের বাড়ি পিরোজপুর ফিরছেন, আমার আব্বা দাদাকে সদরঘাটে লঞ্চে উঠিয়ে দিতে গেছেন, বড় ছেলে হিসেবে আমাকেও সঙ্গে নিয়ে গেছেন। লঞ্চের নাম বেলকুচি, নানা রকমের ক্যাটক্যাটে এনামেল পেইন্টের ডিজাইন আঁকা কাঠের বডির মাঝারি সাইজের দোতলা লঞ্চ। বেলকুচির চেয়েও বড় অপেক্ষাকৃত নিরাপদ লঞ্চ আছে তবে বেলকুচির স্পিড সবচেয়ে বেশি তাই ঢাকা থেকে সুদূর পিরোজপুর যেতে আমাদের এলাকার মানুষদের কাছে সবচেয়ে জনপ্রিয় তখন বেলকুচি লঞ্চ। তখনকার দিনে যারা ট্রেনে চড়ত তারা গ্রিনএরো নামের ট্রেনের স্পিড নিয়ে নানা রকম কাল্পনিক কিংবদন্তি তৈরি করে মজা পেত তেমনই দক্ষিণবঙ্গের মানুষ বেলকুচি লঞ্চের স্পিড নিয়ে অমন অবাস্তব সব কিংবদন্তি তৈরি করত। তেমনিই একটি আজগুবি গল্প চালু ছিল, ইংলিশ চ্যানেল পার হতে যে হাইস্পিড কাঠের লঞ্চ চলে বেলকুচি নাকি তাদেরও হারিয়ে দিতে পারবে (ব্রজেন দাসের সাঁতরিয়ে ইংলিশ চ্যানেল পার হওয়ার গল্প টেক্সটবুকে অন্তর্ভুক্ত থাকায় গ্রামগঞ্জের মানুষ ইংলিশ চ্যানেলের নাম জানত), তাদের কে বোঝাবে যে মেঘনা, কীর্তনখোলা আর কচার মতো ভয়াবহ নদীতে এমন কাঠের বডির ছোট্ট লঞ্চে চলাচল করার মতো বিপজ্জনক যান পূর্ববঙ্গ ছাড়া বোধহয় গ্রহে আর কোথাও নেই।

তখনকার লঞ্চে অল্প সামান্য কয়েকটি কেবিন থাকত আর বাকি সবাই ছিল ডেকের যাত্রী। তখনকার দিনের খুব ধনী ছাড়া প্রায় সবাই ডেকে যাতায়াত করতেন। কবি জীবনানন্দ দাশের ডায়েরি পড়লে দেখা যায় তিনিও পথে নিয়মিত স্টিমারের তৃতীয় শ্রেণীর ডেকে যাতায়াত করতেন। সম্ভ্রান্ত নারীরা যখন যাতায়াত করতেন তখন তাদের পর্দার জন্য দড়ি টানিয়ে সেই দড়ির চারদিকে কয়েকটা বিছানার চাদর ঝুলিয়ে পর্দার ব্যবস্থা করা হতো। কেউ কেউ যারা আরো স্মার্ট তারা এসব ঝামেলার মধ্যে না গিয়ে লঞ্চে উঠেই বড় একটা মশারি টানিয়ে দিত, তখনকার দিনের মশারি ছিল সুতি কাপড়ের তৈরি তাই এখনকার মশারির মতো অত ট্রান্সপ্যারেন্ট ছিল না তাই তা দিয়ে মোটামুটি পর্দার কাজ চলে যেত। তখনকার দিনে হোল্ডল নামে আরেক বস্তু ছিল। একটা সিঙ্গেল সাইজ হোল্ডলের ভেতর একটা পাতলা তোশক, বিছানার চাদর, একটা বালিশ আর একটা সাদা মার্কিন কাপড়ের কাভার পরানো লাল লেপ সেট করা থাকত। হোল্ডলটা হতো গাঢ় ছাই রঙের মোটা ক্যানভাস কাপড়ে বানানো, উপরোল্লিখিত সবকিছু খুব সুন্দরভাবে রোল করে এই হোল্ডলের বেল্ট দিয়ে আটকে এটাকে একটা মোটা সিলিন্ডার টাইপ সুটকেসের মতো বানিয়ে ফেলা যেত। সুটকেসের হ্যান্ডেলের মতো হোল্ডলেও আবার কয়েকটা পকেটও থাকত যাতে অন্যান্য জিনিসপত্র এর সঙ্গে বহন করা যায় তাই এটাকে অনেকটা সুটকেসের মতো ব্যবহার করা যেত। আগে জায়গা পাওয়ার জন্য দুপুরের মধ্যেই একটা হোল্ডল, একটা বাঘা সাইজের চার বাটির টিফিন ক্যারিয়ার আর দাদার নিজস্ব প্রায় প্রাগৈতিহাসিক একটা চ্যাপ্টা সুটকেস নিয়ে আমরা সদরঘাট টার্মিনালে পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে হাফ হাতার টকটকে লাল জামা আর বাহুতে নাম্বারযুক্ত ডিম্বাকৃতির পিতলের ব্যাজ পরিহিত দৈত্যের মতো সাইজের লম্বা লম্বা তাগড়া রেজিস্টার্ড কুলিরা অনেকটা জোর করে সবকিছু আমাদের হাত থেকে কেড়ে নিত। ঘাটে নিয়ম ছিল রেজিস্টার্ড কুলি ছাড়া অন্য কেউ মালপত্র বইতে পারবে না। ঘাটে ভেড়ানো লঞ্চে এসে খালি জায়গা দেখে হোল্ডল খুলে বিছানা পাতা হতো। অনেকে আবার আগে এসে চাদর পেতে জায়গা দখল করে রাখত, পরে ভিড় বেড়ে গেলে সে জায়গা বিক্রি করে দিত, অনেকটা ব্ল্যাকে সিনেমার টিকিট বিক্রির মতো। তবে এদের ব্যবসা ছিল আরো সহজ কোনো টিকিট কিনতে হতো না, খালি একটা চাদর পেতে ডেকের জায়গা দখল করে রাখলেই চলত। দুপুরে পৌঁছালও লঞ্চ ছাড়ত বিকাল পাঁচটার দিকে, তাই দুপুরের খাবার লঞ্চ ছাড়ার আগেই টিফিন ক্যারিয়ার থেকে খেয়ে নিতে হতো। অল্প কিছু পয়সা দিলে লঞ্চের খাবার ঘরের লোকজন টিফিন ক্যারিয়ারের খাবার গরম করে দিত। টিফিন ক্যারিয়ারের অর্ধেক খাবার খেয়ে বাকি অর্ধেকটা রেখে দেয়া হতো রাতে খাওয়ার জন্য। একসময় লঞ্চ কানায় কানার ভরে যেত আর যারা বিছানার জায়গা পেত না তারা দাঁড়িয়ে বা কোনাকানায় কোনো রকমে বসে যাত্রা করত, কিন্তু লঞ্চ তখনো ছাড়ত না কেননা নানা রকমের বাণিজ্যিক মালামাল ওঠানো তখনো অনেক বাকি। নিচতলায় মানুষের সঙ্গে ছাগল বা ভেড়ার পালও মালামাল হিসেবে পরিবহন করা হতো, ছাগল আর ভেড়ার পাল কাঁঠাল পাতা খেতে খেতে আর মলমূত্র ত্যাগ করতে করতে মহা আনন্দে জলযাত্রা করত, তবে তাদের মলমূত্রের গন্ধে নিচতলার মানুষ একটা দুঃসহ অবস্থায় পড়ে যেত যা ভাষায় বর্ণনা করা কঠিন।

যেহেতু দক্ষিণবঙ্গের সঙ্গে ঢাকার কোনো সড়ক যোগাযোগ ছিল না, রেল যোগাযোগ ছিল না, কোনো বিমান যোগাযোগও ছিল না সে কারণে লঞ্চ বা স্টিমারই ছিল পণ্য পরিবহনের একমাত্র মাধ্যম। সড়কপথ তো দূরের কথা আমাদের পিরোজপুরের বা দক্ষিণাঞ্চলের এমন অনেক জায়গা ছিল যেখানে রিকশা ঢোকারই কোনো ব্যবস্থা ছিল না কোনো দিন, শুধু তাই না কোনো সঠিক সড়কই ছিল না আর বর্ষাকালে এসব মাটির রাস্তা দিয়ে হাঁটলে হাঁটু পর্যন্ত কাদায় ডুবে যেত। একরকম প্রায় যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন দক্ষিণাঞ্চলে তাই বলতে গেলে গড়ে উঠতে পারেনি তেমন কোনো শিল্প-কারখানা। বাংলাদেশের সব শহরের জনসংখ্যা যখন হুহু করে বাড়ছে তখন খুলনার জনসংখ্যা আশ্চর্যজনকভাবে আগের চেয়ে কমে গেছে। হলো দক্ষিণাঞ্চলের প্রধান শহরের অবস্থা।

এমন দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষার পর একসময় ৪টা-৫টার দিকে লঞ্চ ছাড়ত। লঞ্চ ছাড়ার পরও লঞ্চভর্তি নানা ধরনের হকারের মধ্যে কিছু সম্ভ্রান্ত হকার নামত না, তারা নামত লঞ্চ ফুল স্পিড দেয়ার আগে আগে। তাদের জন্য লঞ্চের সঙ্গে দড়িবাঁধা নৌকা থাকত সে নৌকায় করে তারা একপর্যায়ে বিপজ্জনকভাবে লাফিয়ে লাফিয়ে নেমে যেত কিন্তু কিছু হকার তারপরও লঞ্চেই অবস্থান করত। লঞ্চের মধ্যে বেশির ভাগ হকারই নানা রকমের খাবার বিক্রি করত তবে আমার বাবা আমাদের কোনো রকম খোলা খাবার খেতে দিতেন না। কচি শসা, পাকা পেঁপে, কলা, ডাবের পানি, সিদ্ধ ডিম বা নাবিস্কো গ্লুকোজ বিস্কুট শুধু জাতীয় খাবারই আমাদের জন্য অনুমোদিত ছিল। তবে চাঁদপুর অথবা বরিশাল থেকে ওঠা কিছু হকার ফ্রেশ কোরানো নারকেলের সঙ্গে চিড়াভাজা মিশিয়ে একটা খাবার বিক্রি করত শুধু সেই খোলা খাবারের ক্ষেত্রে বাবাকে তার নিয়ম ভাঙতে দেখেছি প্রতিবার। এখনকার দিনে খুব অবাক শুনতে মনে হলেও তখন অনেক গল্পের বইয়ের হকার উঠত লঞ্চে। প্রায় শখানেক বই অদ্ভুত কৌশলে কাঁধের ওপর রেখে তারা উঁচু স্বরে বই আর লেখকদের নাম বলে বলে বিক্রি করত। বেশির ভাগ বই- ছিল আশুতোষ মুখোপাধ্যায়, বিমল মিত্র বা নিহাররঞ্জন গুপ্তের লেখা কিরিটি রায়ের গল্পের বই, এছাড়া মোকসেদুল মোমিন, বেহেশতি জেওর, কিছাছুল আম্বিয়া, তাসকিরাতুল আউলিয়া, সহজ নামাজ শিক্ষা ইত্যাদি নানা ধরনের ইসলামী বই আর থাকত গোপাল ভাঁড়ের বই। ডেল কার্নেগি নামের এক ভদ্রলোকের বইও পাওয়া যেত যা পড়লে নাকি জীবনে ভীষণ উন্নতি করা যায়, যেমন নিমিষে কৃষক থেকে কোটিপতি হওয়া বা শ্রমিক থেকে শিল্পপতি হওয়ার সব কলাকৌশল নাকি তার বইয়ের মধ্যে বাতলে দেওয়া থাকত। আমার যতদূর মনে পড়ে ওই কার্নেগি সাহেবের বই- সবচেয়ে বেশি বিক্রি হতো। আর একধরনের ডেঞ্জারাস হকারের কথা আমার মনে আছে। সে চিত্কার করে নানা রকমের ক্যানভাস করার পর বিরাট একটা ধারালো চাকু দিয়ে কনুই থেকে কব্জি মাঝামাঝি তার নিজের হাত লম্বালম্বি করে প্রায় চার-পাঁচ ইঞ্চি কেটে ফেলত এবং কেটে সবার সামনে গিয়ে সেটা দেখাত আর তারপর তার স্বপ্নে পাওয়া কালো মবিলের মতো দেখতে এমন মলম লাগিয়ে তার হাত ব্যান্ডেজ করে দিত এবং কয়েক মিনিট পর ব্যান্ডেজ খুলে তার হাত সবাইকে দেখাত, ভিড় জমে যাওয়া যাত্রীরা সবাই অবাক বিস্ময়ে দেখত যে সেখানে ক্ষতের কোনো চিহ্নই নেই। এরপর শুরু হতো তার স্বপ্নে পাওয়া বিস্ময়কর মলম বিক্রির পালা। তবে মানুষ তার অবাক করা ভয়ংকর হাতকাটা দৃশ্য যতটা বিস্ময়ের সঙ্গে উপভোগ করত, মলম কেনার বেলায় তারা ততটা তত্পর হতো না।

ব্যস্ত বুড়িগঙ্গা পার হয়ে একসময় ধলেশ্বরী হয়ে লঞ্চ প্রথমে থামত মুন্সীগঞ্জের মীরকাদিম, তারপর শীতলক্ষ্যা হয়ে একটু পরই বিশাল মেঘনায় এসে পড়ত, তারপর মেঘনা প্রশস্ত হতে হতে ঘণ্টা দেড়েক পর ডানদিকে প্রমত্তা পদ্মার সঙ্গে মিলিত হয়ে মেঘনা নামেই এগিয়ে যায়, এভাবে ঘণ্টা - চলার পর এসে পৌঁছাত চাঁদপুর, তবে মেঘনার তীব্র স্রোতের কারণে চাঁদপুরে নামার জন্য মেঘনার পাড়ে লঞ্চ ভিড়তে পারে না, লঞ্চ বাঁ দিকে বাঁক নিয়ে ছোট ডাকাতিয়া নদীতে ভেড়ে। লঞ্চ মেঘনা থেকে ডাকাতিয়া নদীতে ঢোকার জন্য বাঁয়ে বাঁক নেয়ার সময়টা তীব্র স্রোতের কারণে খুব বিপজ্জনক, আমি জায়গায় নিজের চোখে যাত্রীসহ লঞ্চ ডুবে যেতে দেখেছি।

চাঁদপুর থেকে সবচেয়ে বেশি যাত্রী উঠত তবে এরা প্রায় কেউই চাঁদপুরের মানুষ না, দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ যারা চট্টগ্রাম, নোয়াখালী বা কুমিল্লায় থাকতেন তারা ট্রেনে চাঁদপুর এসে দক্ষিণাঞ্চলগামী লঞ্চে উঠত। বিশেষ করে চট্টগ্রাম থেকে আগত মেঘনা এক্সপ্রেসের যাত্রীরা এসে লঞ্চে বা স্টিমারে উঠত ঘাট থেকে। ঘাটে থাকা অবস্থায়ই সাধারণত লঞ্চের ছাদে এশার নামাজের জামাত হতো আর তারপর টিফিন ক্যারিয়ারের খাবার গরম করে রাতের খাবারের আয়োজন চলত। আসলে লঞ্চ যাত্রা এমনই দীর্ঘ সময়ক্ষেপণকারী ঢিলেঢালা গতির ছিল যে মনে হতো লঞ্চ বা স্টিমারটা এক একটা ছোটখাটো শহর পানির ওপর ভেসে বেড়াচ্ছে। এটা যে স্বল্প সময়ের যাত্রা তা মনে হতো না মোটেই। কেননা মানুষের বিছানা দিয়ে দখল করা জায়গা যখন চাঁদপুরের যাত্রীরা আস্তে আস্তে মিষ্টি কথা বলে দখল করতে শুরু করত তখন বিশাল ঝগড়াঝাঁটি বা কোনো কোনো ক্ষেত্রে মারামারি লেগে যেত, মনে হতো যেন তার বাপ-দাদার পাঁচ বিঘার উর্বর ধানক্ষেত কেউ দখল করতে এসেছে।

যারা খাবার নিয়ে আসতেন না তারা লঞ্চের খাবার ঘরে ভাত খেতেন, এখানে অনেকদিন পর্যন্ত মাছ বা মাংস আর ভাত-ডালসহ খাবারের ফিক্সড রেট ছিল, মাছ বা মাংস একবারই দেয়া হতো তবে ভাত-ডাল যে যত খেতে পারে। তবে ফ্রি পেয়ে কেউ কেউ এত বিপুল পরিমাণ ভাত আর ডাল খেতে শুরু করে যে পরবর্তী সময়ে সে সিস্টেম উঠিয়ে দেয়া হয়।

চাঁদপুর ঘাটে ঘণ্টা-দুঘণ্টা থেকে রাতের অন্ধকারে শুরু হতো বিশাল ভয়ংকর মেঘনা নদী পাড়ি দেয়া। মেঘনা নদী পাড়ি দিতে দেড় থেকে ঘণ্টা লেগে যেত। রকম ছোট কাঠের লঞ্চে যারা এই ভয়াবহ নদী পার হয়নি তাদের ভয়াবহ অনিশ্চিত অভিজ্ঞতার কথা বোঝানো যাবে না। বিশেষ করে গ্রীষ্ম আর বর্ষাকালে যাত্রা ছিল আরো বেশি ভয়াবহ। বিশাল ঢেউয়ে দুলে উঠত লঞ্চ। কখনো কখনো সে দুলুনি এমন ভয়াবহ হতো যে লঞ্চের মধ্যে চিত্কার আর কান্নাকাটি শুরু হয়ে যেত। সবাই দোয়াদরুদ পড়তে শুরু করত, অনেকে বিপদ মুক্তির জন্য জোরে জোরে আজান দিত। এগুলো আমি কারো কাছ থেকে শুনে লিখছি না, এগুলো আমার নিজের জীবনের সরাসরি অভিজ্ঞতা। একবার গাবখান নদীতে গভীর রাতে আমাদের পুরো পরিবার বহনকারীটার্ননামের স্টিমার ঝড়ে কাত হয়ে অর্ধেক ডুবে গিয়েছিল, আমার মনে আছে সেই গভীর রাতে গ্রামের জনগণ আমাদের মাঝ নদী থেকে উদ্ধার করে। আমরা সেই পরিত্যক্ত স্টিমার ছেড়ে সে রাতে শেখেরহাট গ্রামের হাই স্কুলে আশ্রয় নিয়েছিলাম। সে রাতে প্রচণ্ড ঝড়ে স্টিমার যখন কাত হয়ে ডুবে যাচ্ছিল তখন আমার আব্বাকেও আমি খুব উচ্চকণ্ঠে অমন আজান দিতে দেখেছি। সে আজানের শব্দ এখনো আমার স্পষ্ট মনে আছে। পরের দিন সকালে বরিশাল থেকে আসা উদ্ধারকারী জাহাজে করে আমরা পিরোজপুরে পৌঁছাই। সে ভয়াবহ স্মৃতি আমি কোনোদিনও ভুলতে পারব না। [চলবে]

 

মাহফুজুল হক জগলুল: স্থপতি, ফেলো আইএবি

আরও