বিশ্ব বসতি দিবস

সবার জন্য আবাসন শ্রেয়তর নগর ভবিষ্যৎ

এ বছর বিশ্ব বসতি দিবসের প্রতিপাদ্য—‘সবার জন্য আবাসন: শ্রেয়তর নগর ভবিষ্যৎ’ (Housing For All: A Better Urban Future)—আমার কাছে বিশেষ তাত্পর্যপূর্ণ মনে হয়, কেননা বাংলাদেশে আমরা এ বছর ‘মুজিব জন্মশতবর্ষ’ উদযাপন করছি। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করি, তাঁর স্বপ্নের সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠায় যেন আমরা যে যার অবস্থান থেকে প্রচেষ্টা

বছর বিশ্ব বসতি দিবসের প্রতিপাদ্য—‘সবার জন্য আবাসন: শ্রেয়তর নগর ভবিষ্যৎ’ (Housing For All: A Better Urban Future)—আমার কাছে বিশেষ তাত্পর্যপূর্ণ মনে হয়, কেননা বাংলাদেশে আমরা বছরমুজিব জন্মশতবর্ষউদযাপন করছি। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করি, তাঁর স্বপ্নের সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠায় যেন আমরা যে যার অবস্থান থেকে প্রচেষ্টা চালাই। বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে। যেখানে শ্রেণীগত বৈষম্য থাকবে না, নগর গ্রামে বৈষম্য থাকবে না। সবার জন্য বাসযোগ্য আবাসন থাকবে, এমন স্বপ্নও নিশ্চয়ই তাঁর ছিল। আমাদের মনে আছে, ১৯৭৫ সালের জানুয়ারিতে তিনি রাজধানী ঢাকার অসহায় বাস্তুহারাদের জন্য পুনর্বাসন প্রকল্প গ্রহণ করেছিলেন। অন্তত ৭৫ হাজার মানুষকে ডেমরা, টঙ্গী মিরপুরে সরকারি জমিতে স্থানান্তর করেছিলেন। এত বড় বাস্তুহারা পুনর্বাসন কার্যক্রম পরবর্তীকালে আর গৃহীত হয়নি, তবে বিভিন্ন সময়ে বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কয়েকটি বস্তি পুনর্বাসন প্রকল্প অনুমোদন করেছিলেন, তার কিছু বাস্তবায়নে অগ্রগতি হয়েছে। সম্প্রতি তিনি একাধিকবার ঘোষণা দিয়েছেন, ‘দেশের একজন মানুষও গৃহহীন থাকবে না।এখন সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় অধিদপ্তরের দায়িত্ব থাকবে তার ঘোষণার যথাযথ বাস্তবায়নে উদ্যোগ গ্রহণেন। সরকার যে ইচ্ছা করলে ভাগ্য বিড়ম্বিতদের জন্য বড় রকমের আশ্রয় প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে পারে, তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ সম্প্রতি অতিদ্রুত সম্পন্ন করা ভাসানচরে এক লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীর জন্য উন্নত মানের আশ্রয়।

সারা দেশে গৃহহীন  মানুষের সংখ্যা মোটেও কম নয়। তার ওপর বছরই ঘূর্ণিঝড় আম্পান সাম্প্রতিক বন্যায় হাজার হাজার পরিবার সম্পূর্ণ আশ্রয়হীন হয়ে পড়েছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তার দলের সদস্যদের কাছে আহ্বান জানিয়েছেন তাদের নিজ নিজ এলাকার গৃহহীনদের তালিকা প্রস্তুত করতে। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় অধিদপ্তরও কাজে উদ্যোগী হতে পারে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোরও গৃহ তথ্য সংগ্রহের কার্যক্রম থাকতে পারে। অর্থাৎ সব মহলেরই ভূমিকা থাকা উচিত গৃহহীনদের সম্পর্কে যথাযথ তথ্য সংগ্রহের, যাতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছার বাস্তবায়নে পদক্ষেপ নেয়া সম্ভব হয়। আমাদের সংবিধানে অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, স্বাস্থ্যের পাশাপাশি আশ্রয় নিশ্চিত করার অঙ্গীকার করা হয়েছে।

এখনো দেশে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক মানুষ ন্যূনতম মানের আশ্রয় পাচ্ছে না, এটাই বাস্তবতা। সাম্প্রতিক সময়ে সার্বিকভাবে গৃহমান বাড়লেও দুর্বল কাঁচা ঘরের সংখ্যাও উদ্বেগজনক। তাছাড়া প্রতি বছর বিভিন্ন ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ অসংখ্য গৃহ ধ্বংস করে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণেও উপকূল এলাকায় আশ্রয় ধ্বংসের ঘটনা বৃদ্ধি পাচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে আবার উপদ্রুত এলাকার বিপুলসংখ্যক আশ্রয়হীন মানুষ রাজধানী ঢাকাসহ অন্যান্য বড় শহরে অভিবাসন করে সেসব শহরে বাস্তুহারার সংখ্যা বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখতে বাধ্য হয়।

গৃহায়ণ চিন্তায় আরেকটি বিষয় গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনার দাবি রাখে। তা হলো রাজধানী ঢাকায় আবাসন পরিস্থিতি। একথা বলাই যায় যে স্বাধীনতা-পরবর্তী পাঁচ দশকে একদিকে যেমন ঢাকার জনসংখ্যা বেড়েছে, পাশাপাশি শহরের আবাসন পরিস্থিতির সার্বিক মান বেড়েছে। এটি সম্ভব হয়েছে সামগ্রিকভাবে রাজধানী শহর তথা দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির কারণে। আবার একথা সত্য, সাম্প্রতিক সময়ে রাজধানীতে বিত্ত-বৈভবে ব্যাপক বৈষম্য সৃষ্টি হয়েছে। একটি অতি উচ্চবিত্ত শ্রেণী সৃষ্টি হয়েছে, মধ্যবিত্তের আকার বেড়েছে, পাশাপাশি নিম্নবিত্ত বিত্তহীন দরিদ্র শ্রেণীর সংখ্যাও কম নয়, বরং অনুপাতে কমলেও মোট সংখ্যায় আগের তুলনায় বিশাল। রাজধানী ঢাকার বিত্ত শ্রেণীর সঙ্গে আবাসন ধরনের এক প্রকার সম্পর্ক লক্ষ্য করা যায়। আমার বর্তমান নিবন্ধের পরবর্তী অংশে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করব।

গৃহ মানুষের মৌলিক প্রয়োজন, অধিকারও বটে। বাংলাদেশের সংবিধান এই অধিকার অর্জনের নিশ্চয়তা দেয়। জাতীয় গৃহায়ণ নীতিমালা ১৯৯৩, ২০০৮ পুনঃঅনুমোদিত নীতিমালা ২০১৬-তেও দেশের সব মানুষের জন্য মানসম্মত গৃহ বা আবাসন আয়োজনের সুপারিশ করেছে। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা ২০৩০সবার জন্য আশ্রয়কাউকে পিছনে ফেলে নয়’— ধরনের সংকল্পের কথা বলে। বাংলাদেশের প্রেক্ষিত পরিকল্পনা ২০২১-২০৪১ বা রূপকল্প ২০৪১- জাতীয় উন্নয়নের প্রায় সব দিক সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট সুপারিশ পরিকল্পনা থাকলেও দুঃখজনকভাবেগৃহায়ণখাত সম্পর্কে সুপারিশ নেই। শুধু এক জায়গায় বলা হয়েছে, ‘বস্তিতে বসবাসকারী খানার সংখ্যাবর্তমানের ৫৫ শতাংশ থেকে ২০৪১ সালে শূন্য শতাংশে নামিয়ে আনা হবে (রূপকল্প ২০৪১, পৃ. ১৭১) কিন্তু সার্বিকভাবে গৃহায়ণ সম্যস্যা কী তা কীভাবে সমাধান করা হবে, সে বিষয়ে সুপারিশ নেই।বাংলাদেশে গৃহায়ণ বাজারের দ্রুত সংস্কার আবশ্যক’—একথা বলা হয়েছে (রূপকল্প ২০৪১, পৃ. ১৭৫), কিন্তু কোনো বিস্তারিত পরামর্শ নেই। থাকাটা খুবই জরুরি বলে আমরা মনে করি।

আপন গৃহ মানুষকে আশ্রয়, নিরাপত্তা, সামাজিক মর্যাদা, স্বাস্থ্য স্বাচ্ছন্দ্য প্রদান করা ছাড়াও উপার্জনের সুযোগ তৈরি করে দেয়। গ্রাম শহরের নিম্ন আয়ের পরিবারের জন্য একটি গৃহের মালিকানা বিশেষ গুরুত্ব বহন করে।

বাংলাদেশে গৃহায়ণ সমস্যা প্রকট। সংখ্যাগত দিক থেকে দেখা যায়, মানসম্মত গৃহের বিরাট ঘাটতি রয়ে গেছে। বর্তমানে দেশের জনসংখ্যা বিশাল, ১৭০ মিলিয়নের মতো এবং ক্রমবৃদ্ধিশীল। বছরে অন্তত মিলিয়ন বা ২০ লাখ নতুন মানুষ মোট জনসংখ্যায় যুক্ত হচ্ছে। মাথাপিছু জমির পরিমাণ হ্রাস পাচ্ছে, নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, ধ্বংসও হচ্ছে। ফলে গৃহ ঘাটতি মেটানো কঠিনতর হচ্ছে। গৃহায়ণ নীতিমালা ২০১৬-তে প্রদত্ত তথ্য অনুযায়ী, ২০১৫ পরবর্তী সময়ে দেশে প্রতি বছর অন্তত এক মিলিয়ন নতুন গৃহ নির্মাণ প্রয়োজন ছিল। সংখ্যাটি অবশ্যই বিশাল, সে তুলনায় বাস্তবে সরবরাহ হচ্ছে কম।

সামগ্রিকভাবে দেশের অর্থনীতির সাম্প্রতিক অগ্রগতি অত্যন্ত প্রশংসনীয় এবং উন্নয়নের ধারাটি (বর্তমানকরোনাপরিস্থিতি সত্ত্বেও) অব্যাহত রয়েছে, কিন্তু আবাসন উপযোগী জমি গৃহ নির্মাণসামগ্রীর মূল্য আগের তুলনায় অনেক বেশি হওয়ার কারণে গৃহ ঘাটতি বেড়েই চলেছে। প্রাতিষ্ঠানিক অর্থায়নের সমস্যা আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ। শহরাঞ্চলে ভবনাদি নির্মাণের অনুমোদনসংক্রান্ত প্রক্রিয়ায় লাল ফিতার দৌরাত্ম্য সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোয় দুর্নীতিও আবাসন খাতকে সমস্যা-ভারাক্রান্ত করেছে।

সংখ্যাগত ঘাটতির পাশাপাশি গৃহের গুণগত মানের কথায় দেখা যায় গ্রামাঞ্চলের ৮০ শতাংশ গৃহ কাঠামোগত দিক থেকে নিম্নমানের স্বল্প স্থায়িত্বের। এমনকি শহরাঞ্চলেও মাত্র ২২ শতাংশ বাড়ি পাকা ২৩ শতাংশ আধা পাকা, বাকি ৫৫ শতাংশ কাঁচা ঝুপড়ি, অর্থাৎ অত্যন্ত নিম্নমানের কাঠামো। পাকা আধা পাকা গৃহও সব মানসম্মত নয়। ঢাকা, চট্টগ্রাম অন্যান্য বড় মাঝারি শহরে সম্প্রতি বেশকিছু দৃষ্টিনন্দন আবাসিক ভবন নির্মাণ হচ্ছে, তবে সেসবের কত ভাগ জাতীয় নির্মাণ কোড বা বিএনবিসির মাপকাঠিতে মানসম্মত, বলা শক্ত। নির্মাণ কাঠামোর পাশাপাশি গৃহের প্রাসঙ্গিক পরিষেবাগুলো, যথা পানি, পয়োনিষ্কাশন, বিদ্যুৎ, জ্বালানি, বর্জ্য অপসারণ ইত্যাদির ব্যবস্থা থাকা আবশ্যক।

মানসম্পন্ন গৃহ বা আবাসন অবশ্য শুধু একটি গৃহ এর সংশ্লিষ্ট সেবা-পরিষেবাকেই বোঝায় না, আবাসনের প্রতিবেশ বা পারিপার্শ্বিক পরিবেশকেও বোঝায়। যেখানে শিশু-কিশোরদের খেলাধুলা বিনোদনের ব্যবস্থা থাকবে, স্বাস্থ্যচর্চার সুযোগ থাকবে অন্য সবারও। এদিক থেকে বাংলাদেশে গ্রামীণ আবাসন তুলনামূলকভাবে অনেকটাই পরিবেশবান্ধব। ভৌত পরিবেশ সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিবেশ দুভাবেই। দীর্ঘকালের বিবর্তনে দেশের একেকটি গ্রাম গড়ে উঠেছে। বিভিন্ন বিত্ত বা অর্থনৈতিক অবস্থানের পরিবার একই গ্রাম জনপদে একসঙ্গে বসবাস করছে। সাম্প্রতিককালে অবশ্য গ্রামের ভৌত চেহারায় পরিবর্তন ঘটেছে, পরিবারের প্রবাসী সদস্যদের রেমিট্যান্সের প্রত্যক্ষ প্রভাব চোখে পড়ে গ্রামের গৃহ কাঠামোয়। অধুনা নির্মিত অনেক সেমি পাকা বা পাকা বাড়ির দেয়াল নানা উজ্জ্বল রঙে রাঙানো হয়েছে। পল্লী বিদ্যুৎ সৌরবিদ্যুৎ সেবা যুক্ত হয়েছে। টেলিভিশন দেখার সুযোগ হয়েছে। দেশের ভেতরে ঢাকা বা অন্যান্য বড় শহর থেকে পাঠানো অর্থেও গ্রামের ঘরবাড়ির চেহারা বদলে যাচ্ছে। পাশাপাশি বাড়ির আঙিনায় আশেপাশে নানা রকম ফলদ, বনজ ঔষধি গাছ লাগানের প্রবণতাও বেড়েছে। গ্রামের অতিদরিদ্ররা অবশ্য অনেকেই গ্রাম ত্যাগ করে শহরে অভিবাসন করেছে এবং শহরের বস্তিতে ঠিকানা বা আশ্রয় খুঁজে নিয়েছে। প্রক্রিয়ায় গ্রামীণ দারিদ্র্য মাত্রা কমে নগরীয় দারিদ্র্য মাত্রা কিছুটা বেড়েছে।

অন্যদিকে গ্রামের সমাজ কাঠামোয় পরিবর্তন হচ্ছে। যারা ওপরের দিকে অবস্থান করতেন, ভূস্বামী, শিক্ষিত বিত্তবান বা মধ্যবিত্ত, তারাও অনেকে গ্রাম ছেড়ে শহরে অভিবাসী অথবা আংশিকভাবে বিদেশমুখী, তাদের পৈতৃক বাড়িঘর প্রায় খালিই পড়ে থাকে। অনেকে বাড়ি সংস্কার করে আধুনিকায়ন করেন, হাই কমোডসহ টাইলসের বাথরুম বানান, মাঝেমধ্যে গ্রামে এসে বেড়িয়ে যান। জীবনাবসানে পারিবারিক কবরস্থানে পরম শান্তি লাভ করেন। অভিজাতদের কেউ কেউ বিদেশে মৃত্যুবরণ করলেও দেশের মাটিতে শেষ ঠিকানা নিশ্চিত করেন।

অতিসম্প্রতি আমাদের প্রধানমন্ত্রী একটি স্লোগান এগিয়ে নিচ্ছেন—‘আমার গ্রাম, আমার শহরবাগ্রাম হবে শহর অর্থাৎ নগরের সব সুগোগ-সুবিধা গ্রামেই পাওয়া যাবে। স্লোগানে অবশ্য গ্রামের ঘরবাড়ির চেহারা বা কাঠামো বদলের কথা বলা নেই, কিন্তু বাস্তবে তাও হয়তো ঘটবে। এক্ষেত্রে খুব ভেবেচিন্তে এগোতে হবে, যাতে গ্রামের নান্দনিক অবয়ব পরিবেশ-পরিস্থিতি নষ্ট না হয়। সংবিধানের ১৬ অনুচ্ছেদে বলা আছে, গ্রাম-নগর বৈষম্য কমাতে হবে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীরগ্রাম হবে শহরস্লোগানের লক্ষ্য অনেকটা রকমই। প্রধানমন্ত্রী সম্প্রতি একাধিকবার ঘোষণা দিয়েছেন যেদেশের একজন মানুষও গৃহহীন থাকবে না’—মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে আওয়ামী লীগের আলোচনা সভায় বলেছেন (ফেব্রুয়ারি, ২০২০)

শহরে, বিশেষ করে রাজধানী ঢাকা শহরে অবাধ বাজার অর্থনীতির সুবাদে স্বাধীনতা-উত্তর পাঁচ দশকে জনগণের আর্থসামাজিক অবস্থার বিশাল পরিবর্তন হয়েছে। প্রক্রিয়ায় ধনবৈষম্য সৃষ্টি হয়েছে বৈষম্যের চরম দৃশ্যমান প্রতিফলন ঘটেছে আবাসন খাতে।

দেশে একটি বিত্তবান শ্রেণী গড়ে উঠেছে। অনুপাতে তেমন বড় না হলেও তাদের মোট সংখ্যা নেহাত ছোট নয়, তাদের জন্য গড়ে উঠছে সুরক্ষিত, মনোরম আবাসিক এলাকা। ইদানীং কিছু আবারগেটেড কমিউনিটি আদলে। এগুলো অধিকাংশই অবশ্য মূলত অ্যাপার্টমেন্ট ব্লক। নামিদামি স্থপতিদের নকশায় গড়ে উঠেছে এখানকার ঘরবাড়ি। ধরনের বাড়িতে সাবেক রাষ্ট্রপতি, সাবেক প্রধান উপদেষ্টা, বিভিন্ন আমলের মন্ত্রী থেকে শুরু করে নানা পেশার কীর্তিমান মানুষ, সফল ব্যবসায়ী, অবৈধভাবে অর্জিত বিপুল সম্পদের মালিকরা বাসিন্দা। নগরে বিভিন্ন উচ্চবিত্ত আবাসিক এলাকায় অবিশ্বাস্য রকম সুপরিসর আবাসন বিক্রি হচ্ছে (৩০০০-৪৮৮৯-৬৬৯৬ বর্গফুট, মূল্য প্রতি বর্গফুট ১৫,০০০-২৬,০০০+ টাকা) রাষ্ট্রীয় তথা জনগণের অর্থে এসব বিত্তবানের অভিজাত আবাসিক এলাকায় নান্দনিক পার্ক, ওয়াকওয়ে, লেক ইত্যাদির সুব্যবস্থা করা হয়। অতিসম্প্রতি অবশ্য কিছুসুপার রিচপরিবার দুর্গপ্রতিম প্রাসাদ বাড়িও বানাচ্ছে। বিত্তবান অতিবিত্তবানদের বাড়ি অবশ্যই পুরোপুরি (কেন্দ্রীয়ভাবেও) এয়ারকন্ডিশন্ড। বর্তমান সরকারের বিদ্যুৎ উৎপাদন সাফল্য তাদের চাহিদামাফিক সেবা দিচ্ছে।

উচ্চমধ্যবিত্ত মধ্যবিত্তরাও মাঝারি উচ্চতার বা সুউচ্চ অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিংয়ে মাঝারি বা ছোট ফ্লোর স্পেসের অ্যাপার্টমেন্টে থাকছেন। মালিক বা ভাড়াটে হিসেবে। তারাও তাদের বাসার কিছু কামরায় এসি লাগাচ্ছেন। কেননা বিল্ডিং ঘনত্বের কারণে স্থপতিরা আর পরিবেশ বা আবহাওয়াবান্ধব বাড়ি বানাতে পারছেন না।

উচ্চবিত্ত মধ্যবিত্তদের জন্য আজকাল প্রাইভেট হাউজিং কোম্পানি বা রিয়েল এস্টেট কোম্পানিগুলো আবাসিক অ্যাপার্টমেন্ট ভবন বা গৃহ নির্মাণ করছে। রিহাবের তালিকাভুক্ত প্রায় হাজার ২০০ কোম্পানির মধ্যে হাতেগোনা বেশকিছু কোম্পানি আছে, যারা রাজধানীর আবাসন ব্যবস্থায় প্রশংসনীয় অবদান রাখছে। চট্টগ্রাম অন্যান্য বড় শহরেও রিয়েল এস্টেট কোম্পানিগুলোর কার্যক্রম দৃশ্যমান হচ্ছে। অধিকাংশ কোম্পানির সুনাম নেই, বরং দুর্নামই বেশি। অনেক কোম্পানি শুধু প্লট বাণিজ্য করছে। এসব কোম্পানি বিশাল হাউজিং প্রকল্প করছে, রীতিমতোনিউ টাউনবা নতুন শহর গড়ে তুলছে। কাজটি করতে গিয়ে এদের অনেকে নানা অবৈধ পদ্ধতি অবলম্বন করে, পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি করে। নিচু জমি জলাভূমি ভরাট করে, খাসজমি নিজেদের দখলে নিয়ে নেয়। বড় বড় ল্যান্ড ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি নগরাঞ্চলের ভূমি ব্যবস্থাপনায় বড় রকমের নেতিবাচক প্রভাব রাখছে। নিয়ন্ত্রণকারী সরকারি সংস্থাগুলো কিছুতেই এদের সঙ্গে পেরে ওঠে না অথবা পারতে চায় না। এসব কোম্পানির কর্তাব্যক্তিরা সরকার বা রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে প্রচণ্ড প্রভাব রাখেন।

প্রতিরক্ষা বাহিনীর কর্মকর্তাদের উদ্যোগে গড়ে তোলাডিফেন্স অফিসার্স হাউজিং সোসাইটি’ (ডিওএইচএস) বেশ কয়েক দশক ধরে উচ্চবিত্ত উচ্চমধ্যবিত্তদের জন্য নগরে মানসম্পন্ন অ্যাপার্টমেন্ট হাউজিং করছে। সেখানে ভৌত পরিবেশের মানের দিকেও নজর দেয়া হয়। এগুলোও এক ধরনেরগেটেড কমিউনিটি,’ এলাকাবাসী ছাড়া অন্যদের প্রবেশাধিকার কিছুটা সীমিত, তবে প্রতিরক্ষা বাহিনীর কর্মকর্তাদের সঙ্গে সিভিলিয়ানদের ফ্ল্যাটের মালিক বা ভাড়াটে হওয়ার সুযোগ থাকায় এক ধরনের মিশ্র সমাজ গড়ে উঠছে।

হাউজিং কোম্পানি, সরকারি সংস্থা এসবের পাশাপাশি নগরাঞ্চলে মধ্যবিত্তদের সমবায় সংগঠনের মাধ্যমে গৃহায়ণের উদ্যোগ রয়েছে। পেশাজীবীদের সমবায়গুলো এক্ষেত্রে দৃশ্যমান ভূমিকা রাখছে।

শহরে মধ্যবিত্ত নিম্নমধ্যবিত্তরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী। নিম্নমধ্যবিত্তরা এখনো শহরগুলোয়  অনেকটা নিজেরাই নিজেদের বাড়ি বানাচ্ছে অথবা অন্যদের বানানো বাড়িতে ভাড়া থাকছে। এদের মধ্যে যারা নিজেদের বাড়ি নিজেরা বানাচ্ছে বা বানানোর ব্যবস্থা করছে, তারা নিজস্ব পারিবারিক সঞ্চয়, আত্মীয়স্বজন কর্মস্থল থেকে নেয়া ঋণ অথবা ব্যাংকঋণে অর্থায়নের ব্যবস্থা করে।

ঢাকা বা চট্টগ্রামের মতো মহানগরে একেবারে নিম্নবিত্ত বা দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বিশাল। মোট জনসংখ্যার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ বা তারও বেশি। এদের সঠিক সংখ্যা জানাটাও কঠিন কাজ। এই নগর-দরিদ্ররা মূলত নগরের অসংখ্য বস্তি এলাকায় আশ্রয় খুঁজে নেয়। ঝুপড়ি, কাঁচাঘর, টিনশেড, আধা পাকা, এমনকি পাকা ঘর। প্রতি বর্গফুটের হিসাবে অতি উচ্চ ভাড়ায় ঘর নিতে বাধ্য হয় তারা। মধ্যস্বত্বভোগী গোষ্ঠী সাধারণ দরিদ্র বস্তিবাসীকে নানাভাবে প্রবঞ্চনা করে। উল্লেখ্য, বস্তির একটি কাঁচা ঘর বা টিন শেড কামরা একটি নগর পরিবারের আশ্রয়। এই পরিবারের এক বা একাধিক সদস্য হয়তো নগর শ্রমবাহিনীর সদস্য, তারা এককভাবে এবং সম্মিলিতভাবে জাতীয় অর্থনীতিতে ভূমিকা রক্ষাকারী।

জাতীয় গৃহায়ণ নীতিমালায় স্পষ্টভাবে লেখা আছে, নিম্নমধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত, বিত্তহীন দরিদ্র নগরবাসীর জন্য গৃহায়ণে একটি বড় ভূমিকা পালন করবে সরকার, সরকারের জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ বা অন্যান্য সংস্থা। কাজটি তারা যে করে না তা নয়, তবে যা করে তা প্রয়োজনের তুলনায় অতিনগণ্য। বর্তমান সরকার বহুতল ভবনে ছোট মাপের ফ্ল্যাট বানিয়ে কয়েক হাজার বস্তিবাসীকে পুনর্বাসন করার প্রকল্প নিয়েছে। চাহিদা তো অবশ্য এমন লাখ লাখ পরিবারের। ইদানীং সরকারি অধিদপ্তর অবশ্য বেশ উদ্যমের সঙ্গে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য মানসম্পন্ন বহুতল ফ্ল্যাট ভবনাদি বানাচ্ছে। এমনকি লাক্সারি ফ্ল্যাটও বানাচ্ছে। তাছাড়া উন্নতসাইট অ্যান্ড সার্ভিসমডেলের আবাসিক এলাকা, স্যাটেলাইট টাউন বা নিউ টাউনে পাকিস্তান আমলের ধারায় প্লট বরাদ্দ দিয়ে যাচ্ছে। বারবার বলা হচ্ছে, সরকারের পক্ষ থেকে আর প্লট বরাদ্দ নয়, শুধু ফ্ল্যাট দেয়া হবে। কিন্তু এমন ঘোষণার বাস্তব প্রতিফলন এখনো খুব সীমিত রয়ে গেছে।

বাংলাদেশের সংবিধানে সবার জন্য বাসযোগ্য আশ্রয় দর্শন সুস্পষ্টভাবে ব্যক্ত হয়েছে। গ্রাম শহরের মধ্যে বৈষম্য মানুষে মানুষে বৈষম্য থাকবে নাএমন চিন্তাও তাতে স্থান পেয়েছে। জাতীয় গৃহায়ণ নীতিমালা ২০১৬-তেও দেশের সব শ্রেণী, গোত্র, গোষ্ঠীর জন্য প্রয়োজনীয় আবাসনের দিকনির্দেশনা রয়েছে। সুবিধাবঞ্চিত মানুষের প্রতি বিশেষ দৃষ্টি রাখার কথাও বলা হয়েছে। গৃহায়ণ সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন অংশী কর্তৃপক্ষ, সংস্থা গোষ্ঠী, যথা সরকার, প্রাইভেট সেক্টর, সমাজ, পরিবার ব্যক্তির ভূমিকা নিয়ে দিকনির্দেশনা দেয়া আছে। প্রয়োজনীয় জমি, অর্থ, নির্মাণসামগ্রী, নির্মাণ কৌশল, নির্মাণ কুশলী শ্রমিক সার্বিকভাবে গৃহায়ণ ব্যবস্থাপনা বিষয়ে সুপারিশ করা হয়েছে। চূড়ান্ত বিবেচনায় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো দর্শন, লক্ষ্য কৌশল বাস্তবায়নে সরকারসহ সব স্টেকহোল্ডারের আন্তরিকতা, দক্ষতা নিষ্ঠা। আমরা বাংলাদেশের রূপকল্প ২০৪১-এর সফল বাস্তবায়ন কামনা করি।সবার জন্য আশ্রয়’— স্লোগানের যথার্থতা প্রতিষ্ঠিত হোক, এমনটাই আশা করি। বর্তমানকরোনাকালেও সরকার দরিদ্রদের জন্য গৃহায়ণ কর্মসূচি অব্যাহত রাখবেএমন প্রত্যাশা আমাদের।

 

নজরুল ইসলাম: নগরবিদ; সাম্মানিক চেয়ারম্যান, নগর গবেষণা কেন্দ্র (সিইউএস), ঢাকা

আরও