সরাসরি বাণিজ্য বা অর্থনীতির শিক্ষার্থী না হলেও একজন সচেতন নাগরিক ও শিক্ষার্থী হিসেবে এবং খাদ্যের মূল্যবৃদ্ধির কারণ ও তার প্রভাব বিশ্লেষণের আগ্রহ থেকে এই কনক্লেভে আমার অংশগ্রহণ। পাঁচ-ছয় মাস ধরে আমরা যে খাদ্যের ব্যাপক মূল্যবৃদ্ধি প্রত্যক্ষ করেছি সেটির মূল কারণ অনুসন্ধান করা এবং বাজার ব্যবস্থাপনার বিভিন্ন স্তরের ব্যবসায়ীদের অভিজ্ঞতা শোনা এ আলোচনার অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য। বিশেষত আমাদের মধ্যম ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা কী ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছেন, তা বোঝা জরুরি। আমরা শিক্ষার্থী হিসেবে কেবল পর্যবেক্ষণ করতেই আসিনি; বরং ভবিষ্যতে কীভাবে এ সংকট নিরসনে ভূমিকা রাখতে পারি, সেটিও আমাদের ভাবনার বিষয়। কেননা আমরা বর্তমানে চিন্তা করছি যে ভবিষ্যতে কীভাবে রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে দেশের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের দিকে এগিয়ে যাওয়া যায়। সেই পরিপ্রেক্ষিতে বাজার ব্যবস্থাপনা ও মূল্য নিয়ন্ত্রণ কৌশল বোঝাও জরুরি এবং এজন্য ব্যবসায়ী সমাজের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
আমরা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে গত সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে বাজার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করেছিলাম। সে সময় আমরা লক্ষ করি যে সরকার বাজার তদারক কার্যক্রম পরিচালনা করলেও সেটি মূলত খুচরা বিক্রেতা পর্যন্ত সীমাবদ্ধ ছিল। যেহেতু ভোক্তারা খুচরা বিক্রেতা থেকে পণ্য কেনে, তাই আমরা মনে করি যে খুচরা বিক্রেতারাই বাড়তি দাম, খাদ্যে ভেজাল ইত্যাদির জন্য দায়ী। এটি মূলত একজনের দোষ আড়াল করে অন্যের ওপর দোষ চাপানোর প্রবণতা। এভাবে প্রকৃত দোষীকে দায়মুক্তি দেয়া হয়। বাস্তবে বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে হলে খুচরা পর্যায়ে নয়, বরং সামগ্রিক সরবরাহশৃঙ্খলের ওপর নজর দেয়া জরুরি। যদি আমরা শুধু খুচরা ব্যবসায়ীদের দোষারোপ করি, তাহলে মূল সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। তাছাড়া বিগত সরকারকেও বাজার নিয়ন্ত্রণে এ ধরনের বিভিন্ন উদ্যোগ নিতে দেখেছি আমরা যেগুলো কাঙ্ক্ষিত ফলাফল বয়ে আনেনি।
বাজারে খাদ্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে চাই জনগণের কাছে বাজারের প্রকৃত ও পর্যাপ্ত তথ্য সরবরাহ। দেশের বাজারে সঠিক তথ্যপ্রবাহের অভাব রয়েছে। এ বিষয়ে সরকারি পর্যায়ে গবেষণার দুর্বলতা এবং পরিকল্পনার অভাব রয়েছে। একটি অর্থবছরে কী পরিমাণ জোগান প্রয়োজন এবং সেজন্য কী ধরনের ব্যবস্থা নিতে হবে যাতে কৃষক, ব্যবসায়ীর লোকসান হবে না এবং ভোক্তাও যৌক্তিক মূল্যে পণ্য পাবেন—এগুলো নিয়ে সরকারের পরিকল্পনা থাকা প্রয়োজন। বাজারে দীর্ঘকাল ধরে যে বিশৃঙ্খলা বিরাজ করছে তা দূর করতে হলে সরকারের দিক থেকে সর্বপ্রথম যথাযথ পরিকল্পনা থাকতে হবে যা দীর্ঘমেয়াদে খাদ্যপণ্য সরবরাহ ও চাহিদার মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করবে।
এদিকে আগামী মাসে রমজান শুরু হতে যাচ্ছে। কিন্তু তখন বাজার পরিস্থিতি কেমন হবে তা নিয়ে আমরা এখনো নিশ্চিতভাবে কিছু জানি না। এরই মধ্যে খেজুরসহ বেশকিছু নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি পরিলক্ষিত হচ্ছে। সয়াবিন তেলের সংকট ও দাম বাড়তেও দেখেছি আমরা। এমন পরিস্থিতিতে আমরা আশা করি, রমজানে বাজারে শৃঙ্খলা বজায় রাখতে ও দাম নিয়ন্ত্রণে সরকারের পক্ষ থেকে সুস্পষ্ট পরিকল্পনা নেয়া হবে।
রমজান প্রসঙ্গে আরেকটি বিষয় বলা জরুরি। সাধারণত রমজানে ফলের চাহিদা বেড়ে যায়। অথচ বর্তমান সরকার নতুন করে ফল আমদানির ওপর শুল্ক আরোপ করেছে। এতে সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোর জন্য মৌসুমি ফল কেনা দুঃসাধ্য হয়ে পড়েছে। তাছাড়া কেবল রমজান নয়, সবসময়ই মানুষের পুষ্টি নিশ্চিত করতে ফল একটি অপরিহার্য উপাদান। ফলের উচ্চমূল্য শিশুদের স্বাস্থ্যেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। এর পরও দেখা যায়, সরকার প্রতি বছর ফলের দাম বাড়িয়ে দেয়। সামনে রমজানে ফলের দাম কোন পর্যায়ে থাকবে সে বিষয়ে ভোক্তা হিসেবে আমরা বর্তমানে সন্দিহান। গত বছরও দেখা গেছে তরমুজের দাম অনেক বেড়েছিল। শিক্ষার্থী হিসেবে দাম নিয়ন্ত্রণের কৌশল সেভাবে জানা নেই, তবে চাই সরকার এ বিষয়ে উদ্যোগ নেবে।
এছাড়া আমরা দেখতে পাই, সরকার কৃষি খাতে ভর্তুকির কথা বলে। কিন্তু বাস্তবে কৃষকের হাতে সেই সহায়তা পৌঁছায় না। কৃষি যন্ত্রপাতি আমদানিতে কিছু ভর্তুকি দেয়া হলেও কৃষকদের সার্বিক সহায়তা নিশ্চিত করা হয় না। ফলে কৃষক পর্যায়ে উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যায়, যার প্রভাব বাজারের ওপর পড়ে। এ অবস্থার পরিবর্তনে কৃষি খাতে টেকসই ও কার্যকর ভর্তুকি প্রদান অত্যন্ত জরুরি।
আশা করি, অন্তর্বর্তী সরকার বাজার ব্যবস্থাপনা ও খাদ্যদ্রব্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণে যথাযথ পরিকল্পনা গ্রহণ করবে। বিশেষ করে রমজান মাস সামনে রেখে যেন পণ্যের দাম অযৌক্তিকভাবে বৃদ্ধি না পায়, সে বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়া হবে। একজন রিকশাচালক থেকে শুরু করে কোটিপতি পর্যন্ত যেন ন্যায্যমূল্যে খাদ্য ও মৌলিক পণ্য কিনতে পারেন, সেটি অন্তর্বর্তী সরকারের নিশ্চিত করা উচিত। প্রত্যাশা রয়েছে, সরকার দ্রুততম সময়ে একটি সুস্পষ্ট ও কার্যকর বাজার নিয়ন্ত্রণ পরিকল্পনা নেবে, যাতে অন্তত বাংলাদেশের মানুষ দেখতে পায় যে বাংলাদেশে ন্যায্যমূল্যে পণ্য বিক্রি হয় এবং রমজানে লাফিয়ে লাফিয়ে পণ্যের দাম বাড়ছে না।
উমামা ফাতেমা: মুখপাত্র, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন
[বণিক বার্তা আয়োজিত ‘খাদ্যপণ্যের যৌক্তিক দাম: বাজার তত্ত্বাবধানের কৌশল অনুসন্ধান’ শীর্ষক পলিসি কনক্লেভে প্যানেল আলোচকের বক্তব্যে]