সময়ের ভাবনা

প্রযুক্তি খাতে বাংলাদেশের সমস্যা ও সম্ভাবনা

বর্তমান বিশ্ব নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে প্রযুক্তির মাধ্যমে। যে দেশ যত বেশি প্রযুক্তিতে উৎকর্ষ সাধন করেছে কিংবা করছে, বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় তারা তত বেশি এগিয়ে। প্রযুক্তিকে কেন্দ্র করে বদলাচ্ছে যুদ্ধের কৌশল। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র সে দেশে চীনের প্রযুক্তিপণ্য প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। ফলে যুক্তরাষ্ট্রকে টপকে শীর্ষ অর্থনীতি হওয়ার পথে বড় ধরনের ধাক্কা খেয়েছে চীন। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত আইসিটি

বর্তমান বিশ্ব নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে প্রযুক্তির মাধ্যমে। যে দেশ যত বেশি প্রযুক্তিতে উৎকর্ষ সাধন করেছে কিংবা করছে, বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় তারা তত বেশি এগিয়ে। প্রযুক্তিকে কেন্দ্র করে বদলাচ্ছে যুদ্ধের কৌশল। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র সে দেশে চীনের প্রযুক্তিপণ্য প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। ফলে যুক্তরাষ্ট্রকে টপকে শীর্ষ অর্থনীতি হওয়ার পথে বড় ধরনের ধাক্কা খেয়েছে চীন। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত আইসিটি সেক্টরে বেশ অগ্রগতি অর্জন করেছে। বর্তমানে বিশ্বের শীর্ষ অনেকগুলো প্রযুক্তিপ্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী এবং নীতিনির্ধারকরা ভারতের নাগরিক কিংবা ভারতীয় বংশোদ্ভূত। ইউনাইটেড নেশনস কনফারেন্স অন ট্রেড অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আঙ্কটাড) ২০২০ সালে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনের তথ্য অনুসারে, বর্তমানে মোট মূল্যের দিক থেকে আইসিটি সেবা রফতানির ক্ষেত্রে ভারত শীর্ষে। শীর্ষ দশের অন্য নয়টি দেশ যথাক্রমে চীন, জার্মানি, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, নেদারল্যান্ডস, সুইডেন, ইসরায়েল ও সিঙ্গাপুর। আর মাথাপিছু অবদানের হিসাবে শীর্ষ আইসিটি সেবা রফতানিকারী দেশ হলো আয়ারল্যান্ড। এরপর যথাক্রমে লুক্সেমবার্গ, সিঙ্গাপুর, সাইপ্রাস, ইসরায়েল, সুইডেন, ফিনল্যান্ড, বারমুডা, বেলজিয়াম ও নেদারল্যান্ডসের অবস্থান। এ তো গেল প্রযুক্তিপণ্য ও সেবা রফতানির আন্তর্জাতিক চিত্র। এবার একটু বাংলাদেশের সামগ্রিক বাস্তবতার ওপর চোখ বুলিয়ে আসা যাক।

প্রযুক্তিপণ্য ও সেবা রফতানির দিক দিয়ে বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে। ২০২১ সালের অ্যাটলাস অব ইকোনমিক কমপ্লেক্সিটিতে অন্তর্ভুক্ত ‘‌বাংলাদেশ প্রডাক্ট স্পেস ম্যাপ, ২০১৮’ অনুসারে, বর্তমানে কোনো ধরনের প্রযুক্তিপণ্য (লাইট ব্লু ও ডার্ক ব্লু) উৎপাদনের যথার্থ সক্ষমতা বাংলাদেশের নেই। তার মানে প্রযুক্তি খাতে উল্লেখযোগ্য অবস্থানে যাওয়ার জন্য বাংলাদেশের একেবারে গোড়া থেকে শুরু করতে হবে। অ্যাটলাসের এ প্রতিবেদন অনুসারে, ২০১৮ সালের হিসাবে ইলেকট্রনিকস পণ্য রফতানিতে বাংলাদেশ একেবারেই পিছিয়ে। সে বছর বাংলাদেশ মাত্র ৭ কোটি ডলারের ইলেকট্রনিকস পণ্য রফতানি করে। অথচ একই সময়ে নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ভারত ও ভিয়েতনাম যথাক্রমে ১ হাজার ১৬৫ কোটি ও ১০ হাজার ২৩০ কোটি ডলারের ইলেকট্রনিকস পণ্য রফতানি করে। চীন ও দক্ষিণ কোরিয়া রফতানি করে যথাক্রমে ৬৮ হাজার ২০৫ কোটি ও ১৯ হাজার ১০৪ কোটি ডলারের পণ্য। সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে, সারা বিশ্ব তো দূর, এশিয়ার প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলো থেকেও বাংলাদেশ যোজন যোজন পিছিয়ে। তবে আশার কথা হলো, প্রযুক্তি খাতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধনের জন্য ব্যাপক পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। ডিজিটাল ও স্মার্ট বাংলাদেশ গঠনের লক্ষ্যে আইসিটি খাতকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। ‘বাংলাদেশ হাই-টেক পার্ক অথরিটি অ্যাক্ট ২০১০’-এর অধীনে সারা দেশে আইটি পার্ক এবং আইটি ভিলেজ স্থাপন করা হচ্ছে। আইসিটি ফার্ম প্রতিষ্ঠাকে সুবিধাজনক করার জন্য ওয়ান স্টপ সার্ভিস চালু করা হয়েছে। ২০১৮ সালে প্রবর্তিত হয়েছে ‘‌ন্যাশনাল ইনফরমেশন অ্যান্ড কমিউনিকেশন টেকনোলজি পলিসি’। এর অন্যতম লক্ষ্য হলো আইসিটি খাতে দক্ষ জনবল তৈরি করা, নতুন কর্মসংস্থান করা, স্থানীয় আইসিটি শিল্প-কারখানা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে এ খাতে সক্ষমতা বৃদ্ধি করা, শিক্ষা ক্ষেত্রে আইসিটি পাঠ বাধ্যতামূলক করার মাধ্যমে একটি জ্ঞানভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থা তৈরি করা এবং সর্বোপরি আইসিটি ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ তৈরির মাধ্যমে স্থানীয় আইসিটি শিল্পকে শক্তিশালী করা। অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায়ও আইসিটিকে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।

আইসিটি খাতে অগ্রগতির জন্য বাংলাদেশের সামগ্রিক পরিবেশ বেশ সুবিধাজনক অবস্থানে আছে। বেশকিছু সমস্যাও আছে। সেসব সমস্যা দূরীকরণে এখন প্রয়োজন সঠিক পদক্ষেপ ও পরিচালনা। প্রযুক্তি খাতে উল্লেখযোগ্য উন্নতির জন্য শিক্ষা, জনসংখ্যা, ইন্টারনেটের মূল্য, ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা, ইন্টারনেটের গতি, বিদেশী ভাষার দক্ষতা, আইসিটি দক্ষতা এবং ব্যবসা ক্ষেত্রে আইসিটির ব্যবহার ইত্যাদি বিষয় কোন পরিস্থিতিতে আছে তা যাচাই করে দেখা দরকার। এর মাধ্যমে প্রযুক্তি খাতে বাংলাদেশের সার্বিক শক্তি ও দুর্বলতার দিকগুলো স্পষ্ট হবে। চলুন একে একে প্রতিটি খাতে বাংলাদেশের কী অবস্থা তা জেনে আসা যাক।

২০২০ সালে বিশ্ব ব্যাংকের এক প্রতিবেদন অনুসারে, গত দশকে বাংলাদেশের শিক্ষার হার পর্যায়ক্রমে বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০১১ সালে অন্তত প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণকারীর সংখ্যা ছিল মাত্র ৪৮ দশমিক ৮ শতাংশ। ২০১৯ সালে এ হার বেড়ে ৬১ দশমিক ১ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। তাছাড়া মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে এ হার ২০১১ সালের ৪ শতাংশ থেকে ২০১৯ সালে ৫ দশমিক ৫ শতাংশে উন্নীত হয়েছে।

তবে স্নাতক পাস শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে একটি হতাশাজনক চিত্র উঠে এসেছে। বিশ্ব ব্যাংক কর্তৃক ২০১৯ সালে প্রকাশিত এক প্রতিবেদন অনুসারে, বাংলাদেশে স্নাতক পাস শিক্ষার্থীদের এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি গ্র্যাজুয়েশন করার পর এক বছর বা দুই বছর বেকার থাকতে বাধ্য হচ্ছে। এ থেকে বলা যায়, হয় উচ্চশিক্ষিত কর্মীদের ধারণ করার জন্য পর্যাপ্ত চাকরি আমাদের দেশে নেই, অথবা উচ্চশিক্ষা চাকরির বাজারের জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতা সরবরাহ করতে ব্যর্থ হচ্ছে। শিক্ষার হার বাড়লেও সে অনুযায়ী মান বৃদ্ধি না পাওয়া এবং পর্যাপ্ত কর্মসংস্থান না হওয়া বাংলাদেশের আইসিটি খাতের জন্য বড় একটি অন্তরায়। আইসিটি খাতে অগ্রগতির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের একটি শক্তির দিক হলো ইন্টারনেটের মূল্য। সেক্ষেত্রে আইসিটি ফার্ম এবং আইসিটি স্টার্টআপগুলো কম মূল্যে অধিক সেবা উৎপাদন করতে পারবে। বাংলাদেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যাও গত দুই দশকে পর্যায়ক্রমে বেড়েছে। ইন্টারন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন ইউনিয়ন (আইটিইউ) কর্তৃক ২০২০ সালে প্রকাশিত এক প্রতিবেদন অনুসারে, ২০০০ সালে বাংলাদেশে মোট ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ছিল দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ। ২০১৯ সালে তা বেড়ে হয় ১২ দশমিক ৯ শতাংশ। এ পরিসংখ্যান অনুসারে, ২০০০ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে প্রতি বছর গড়ে ৫১ শতাংশ হারে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা বেড়েছে। ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা বাড়লেও আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের তুলনায় বাংলাদেশ এখনো বেশ পিছিয়ে আছে। আইটিইউর প্রতিবেদন অনুসারে ২০১৬ সালে বাংলাদেশে মোট ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ছিল ১৮ দশমিক শূন্য ২ শতাংশ। অথচ পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে এ হার ২২ শতাংশ। ভিয়েতনাম ও চীনের ক্ষেত্রে তা যথাক্রমে ৫৩ ও ৫৩ দশমিক ২০ শতাংশ। দক্ষিণ কোরিয়ার ক্ষেত্রে এ হার সবচেয়ে বেশি, ৯২ দশমিক ৮৪ শতাংশ। ইউনাইটেড নেশনস ডিপার্টমেন্ট অব ইকোনমিক অ্যান্ড সোশ্যাল অ্যাফেয়ার্সের ২০২০ সালে প্রকাশিত এক প্রতিবেদন অনুসারে, সে বছরের টেলিকমিউনিকেশন ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনডেক্সে বাংলাদেশ ভারত থেকে কিছুটা এগিয়ে থাকলেও দক্ষিণ কোরিয়া, চীন ও ভিয়েতনাম থেকে অনেক পিছিয়ে আছে। ইন্টারনেটের গতির ক্ষেত্রেও বেশ পিছিয়ে আছে বাংলাদেশ। আইটিইউ (২০২০) সূত্রে জানা যায়, ইন্টারনেটের গতির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ১৮৪তম অবস্থানে।

তবে আইসিটি অগ্রগতির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা এ খাতে দক্ষ জনশক্তির অভাব। ২০১৬ সালে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ দেশের আইসিটি ফার্মগুলোর ওপর জরিপ চালায়। এ জরিপে আইসিটি-সংশ্লিষ্ট পেশাগুলোকে ১০ ভাগে বিভক্ত করা হয়। জরিপে প্রতিটি ভাগে দক্ষ কর্মীর অভাব সুস্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে। এ জরিপ অনুসারে প্রোগ্রামার, সিস্টেম অ্যানালিস্ট, কোয়ালিটি অ্যাসিউরেন্স এবং সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারের ক্ষেত্রে আনুমানিক ৬০ শতাংশ কর্মী ঘাটতি আছে। একইভাবে গ্রাফিক ডিজাইনার, প্রজেক্ট ম্যানেজার ও প্রডাক্ট ম্যানেজারের মতো পদগুলোয় চাহিদার তুলনায় মাত্র অর্ধেক জনবল আছে।

প্রযুক্তি খাতে এসব অভ্যন্তরীণ সুবিধা ও সমস্যা চিহ্নিত করার পাশাপাশি প্রযুক্তিপণ্য এবং সেবা রফতানি বৃদ্ধির জন্য জাতীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে বেশকিছু পদক্ষেপ ও কৌশল গ্রহণ করতে হবে। এক্ষেত্রে এখনো দ্বিপক্ষীয় কিংবা বহুপক্ষীয় কোনো ধরনের উল্লেখযোগ্য ব্যবসায়িক চুক্তি সম্পাদন করতে পারেনি বাংলাদেশ। সেদিকে গুরুত্ব দিতে হবে। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের প্রধান মনোযোগ হলো প্রযুক্তিসেবার দিকে। পাশাপাশি প্রযুক্তিপণ্য উৎপাদনের দিকে মনোযোগ বাড়াতে হবে। এ উদ্দেশ্যে প্রযুক্তিপণ্য উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় উপাদান আমদানিতে শুল্কহার কমানোর প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। সেই সঙ্গে প্রযুক্তি খাতের বিভিন্ন উদ্যোগে ভর্তুকি দেয়ার সুনির্দিষ্ট বন্দোবস্ত করা প্রয়োজন।

নিজাম আশ শামস: সাংবাদিক

আরও