অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরীর সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় আশির দশকের শেষের দিকে। যমুনা সেতু সম্পর্কে আলাপ-আলোচনা এবং প্রাথমিক কর্মকাণ্ড শুরু হয়েছে। বিশ্বব্যাংক দল ঢাকায় এসেছেন। বাংলাদেশের পক্ষে বিশেষজ্ঞ উপদেষ্টা দল গঠন করা হচ্ছে। সে দলে অধ্যাপক চৌধুরী ও আমি দু’জনেই ছিলাম। বয়োকনিষ্ঠতার কারণে সে উচ্চ-পর্যায়ের দলে আমার অন্তর্ভুক্তির ব্যাপারে অনেকেরই আপত্তি ছিল। কিন্তু তৎকালীন পরিকল্পনা কমিশন সদস্যদ্বয় - ড. শেখ মকসুদ আলী (সাধারণ অর্থনীতি বিভাগ) ও কাজী ফজলুর রহমানের (সামাজিক অবকাঠামো বিভাগ) জোরালো সমর্থনে সব বাধা ভেস্তে গেল।
কাজ করতে গিয়ে অধ্যাপক চৌধুরীর গুণাবলী আমাকে মুগ্ধ করল। তিনিও তখন অপেক্ষাকৃত তরুণ, কিন্তু আমাদের প্রকৌশল জগতে এক উজ্জ্বল তারকা - দেশে-বিদেশে সুপরিচিত। কিন্তু তিনি আমাকে গ্রহণ করলেন সমমর্যাদায়। বলেই দিলেন আমাকে, প্রকল্পটি প্রণয়নের প্রকৌশলী দিকটি তিনি দেখবেন এবং তার আর্থ-সামাজিক দিকটি দেখার দায়িত্ব আমার। বলাবাহুল্য, দাতা গোষ্ঠীর সঙ্গে আলোচনায়, বিদেশী বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে মতামত বিনিময়ের সময়ে এবং প্রকল্পের রূপরেখা প্রণয়নের সময়ে এ বিভাজিত দায়িত্ব আমরা পালন করেছি। যমুনা সেতুটিকে বহুমুখী হতে হবে, এ ব্যাপারে আমরা দু’জনাই অনড় ছিলাম।
পরবর্তী সময়ে ১৯৯০ সালের পরে প্রথম তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে অধ্যাপক রেহমান সোবহান যখন রাষ্ট্র, সমাজ ও অর্থনীতির ওপরে ১৭টি নিরীক্ষা দল গঠন করেছিলেন, তার একটিতে - যমুনা বহুমুখী সেতু - বিষয়ে অধ্যাপক চৌধুরী ও আমি আবার একত্রে কাজ করেছিলাম।
অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী শুধু তার বিষয়ে একজন অনন্যসাধারন বিশেষজ্ঞ ছিলেন না, মানুষ হিসেবে তার মতো মানুষ আমি কমই দেখেছি। একজন সৎ, আস্থাভাজন, নিষ্ঠাবান মানুষই আমি তার মাঝে দেখেছি। দেশের প্রতি তার ভালোবাসা ছিল প্রশ্নাতীত। মিষ্টভাষী, অমায়িক এই মানুষটি সবার বড় প্রিয় ছিলেন। আমার তার উদ্দেশে বলতে ইচ্ছে করে, ‘মানুষের ছাপে, আপনার মারে, আমরা সবাই খর্বকায়’।
তিনটে ঘটনার কথা খুব মনে পড়ে। একদিন তিনি উদয়ন বিদ্যালয়ের পাশ দিয়ে গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছিলেন। প্রচণ্ড রোদ আর গরম ছিল। আমাদের দু’কন্যা রিকশার জন্যে অপেক্ষা করছিল। তিনি মেয়ে দুটোকে গাড়িতে তুলে আমাদের এলিফ্যান্ট রেডের বাড়িতে পৌঁছে দিয়েছিলেন। আরেকদিন আমার টেবিলে পড়ে থাকা বিমল করের ‘অসময়’ উপন্যাসটি তুলে নিয়েছিলেন পড়বেন বলে। ক’দিন পরে আমাকে বলছিলেন, ‘মোহিনী’ চরিত্রটি তার ভালো লেগেছিল। অন্য আরেক দিন একঘর শ্যালকের সামনে আমার বাংলার তিনি এমন প্রশংসা করেছিলেন যে আমি লজ্জা পেয়েছিলাম। কিন্তু তিনটে ঘটনাতেই তার মানবিকতা, হৃদয়বৃত্তি এবং বিশুদ্ধতা বড় হয়ে পড়ে।
অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী বেশি পরিচিত ছিলেন জেআর চৌধুরী বলে। আমরা তাকে ‘জেআরসি’ বলেই সম্বোধন করতাম। আজ তিনি চলে গেলেন। কিন্তু বড় বলতে ইচ্ছে করছে, ‘জেআরসি, আপনি কখনো আমাদের ছেড়ে যাবেন না। কারন হৃদয়ে যাদের বাস, তারা কখনো আমাদের ছেড়ে যান না’।
সেলিম জাহান: ভূতপূর্ব পরিচালক, মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন দফতর এবং দারিদ্র্য দূরীকরণ বিভাগ, জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি, নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র