অভিমত

কৃষিতে নারীর অংশগ্রহণ আছে, মূল্যায়ন নেই

কৃষিশুমারি ২০১৯ অনুযায়ী, এখনো বাংলাদেশে মোট ৯৮ দশমিক ৬৬ শতাংশ পরিবার গ্রামীণ এলাকায় বসবাস করে। যার মধ্যে ৫৩ দশমিক ৮২ শতাংশ কৃষি পরিবার। সরকারি পরিসংখ্যান বলছে, বৃহত্তর কৃষি অর্থনীতিতে নারীদের অংশগ্রহণ ক্রমে বাড়ছে। জাতীয় জনসংখ্যা এবং শ্রমশক্তি জরিপ অনুসারে, গত ৪৭ বছরে কৃষিতে নারীর সংখ্যা শতকের ঘর থেকে কোটিতে পৌঁছে গেছে। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের

(গতকালের পর)

কৃষিশুমারি ২০১৯ অনুযায়ী, এখনো বাংলাদেশে মোট ৯৮ দশমিক ৬৬ শতাংশ পরিবার গ্রামীণ এলাকায় বসবাস করে। যার মধ্যে ৫৩ দশমিক ৮২ শতাংশ কৃষি পরিবার। সরকারি পরিসংখ্যান বলছে, বৃহত্তর কৃষি অর্থনীতিতে নারীদের অংশগ্রহণ ক্রমে বাড়ছে। জাতীয় জনসংখ্যা এবং শ্রমশক্তি জরিপ অনুসারে, গত ৪৭ বছরে কৃষিতে নারীর সংখ্যা শতকের ঘর থেকে কোটিতে পৌঁছে গেছে। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সর্বশেষ ১৯৬১ সালের জরিপ অনুসারে, কৃষিতে নারীর সংখ্যা ছিল ২ হাজার ৪২৩। ২০১৮ সালে প্রকাশিত সর্বশেষ শ্রমশক্তি জরিপ ২০১৬-১৭ অনুসারে, কৃষিতে এখন নারীর সংখ্যা ১ কোটি ১১ লাখ। দেশের মোট শ্রমশক্তির ৪০ দশমিক ৬ শতাংশ কৃষিতে যুক্ত (১৫ ও তদূর্ধ্ব বয়সী)। এর মধ্যে ১৮ দশমিক ৩ শতাংশ নারী। মোট কর্মজীবী নারীদের মধ্যে ৫৯ দশমিক ৭ শতাংশ কৃষিতে যুক্ত, যেখানে মোট কর্মজীবী পুরুষদের ৩২ দশমিক ২ শতাংশ কৃষিজীবী। শ্রমশক্তি জরিপ ২০১৬-১৭ অনুযায়ী, দেশে মোট নারী শ্রমশক্তি আছে দুই কোটি। এর মধ্যে গ্রামে রয়েছে ৭৫ শতাংশ বা দেড় কোটি নারী। আর কৃষি, বনায়ন ও মৎস্য খাতে কাজ করে নারীদের ৭২ দশমিক ৬ শতাংশ। ৭২ দশমিক ৬ শতাংশ গ্রামীণ নারী কৃষিকাজে জড়িত। গত এক দশকে কৃষিতে নারী শ্রমিকের সংখ্যা বেড়েছে প্রায় ১১৬ শতাংশ এবং পুরুষ শ্রমিকের সংখ্যা কমেছে প্রায় ১০ শতাংশ। গত আট বছরে কৃষি খাতে নারীর অংশগ্রহণ ৮ শতাংশ বেড়েছে।

জাতীয় জীবনে নারীর যথাযথ মর্যাদা ও স্বীকৃতি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকার কতগুলো আন্তর্জাতিক নীতি ও সনদে স্বাক্ষর করেছে, যেগুলোয় মানুষ ও নাগরিক হিসেবে নারীর সমঅধিকারের স্বীকৃতি রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো ১৯৮১ সালে জাতিসংঘ ঘোষিত সিডও সনদ। ১৯৯৫ সালে জাতিসংঘের উদ্যোগে চীনের রাজধানী বেইজিংয়ে অনুষ্ঠিত চতুর্থ বিশ্ব নারী সম্মেলনে ১৮৯টি দেশের প্রায় ৩০ হাজার প্রতিনিধির উপস্থিতিতে সর্বসম্মতভাবে নারী উন্নয়নের সামগ্রিক রূপরেখা হিসেবে ‘বেইজিং ঘোষণা ও প্লাটফর্ম ফর অ্যাকশন’ গৃহীত হয়। ওই সম্মেলনে প্রতি বছর ১৫ অক্টোবর ‘আন্তর্জাতিক গ্রামীণ নারী দিবস’ উদযাপনের সিদ্ধান্ত হয়। আন্তর্জাতিক নারী দিবস থাকা সত্ত্বেও শুধু অবহেলিত গ্রামীণ নারীদের অবদান তুলে ধরা ও এর স্বীকৃতি প্রদানের জন্য এ দিবস ঘোষণা করা হয়। এ-সংক্রান্ত প্লাটফর্ম ফর অ্যাকশনের মূল লক্ষ্য হলো, রাষ্ট্রীয় ও ব্যক্তিগত জীবনের সব পরিমণ্ডলে নারীর সক্রিয় অংশগ্রহণের বাধা দূর করা। সেই সঙ্গে গৃহ, কর্মক্ষেত্র ও জাতীয়-আন্তর্জাতিক সব পরিসরে নারী-পুরুষের মধ্যে সমতা এবং দায়দায়িত্ব সমবণ্টনের নীতি প্রতিষ্ঠিত করা। এরই আলোকে বাংলাদেশে ২০১১ সালে নারী উন্নয়ন নীতি প্রণীত ও মন্ত্রিসভায় অনুমোদিত হয়েছে। জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতিতে তিনটি ভাগে ৪৯টি অধ্যায় রয়েছে। যার মধ্যে গ্রামীণ নারীর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট উল্লেখযোগ্য ধারাগুলো হলো: ১৬.১- সংবিধানের আলোকে রাষ্ট্রীয় ও জনজীবনের সব ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা, ১৬.৮- নারী-পুরুষের বিদ্যমান বৈষম্য নিরসন, ১৬.৯- সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিমণ্ডলে নারীর অবদানের যথাযথ স্বীকৃতি প্রদান, ২৩.৫- কর্মসংস্থান, বাজার ও ব্যবসায় নারীকে সমান সুযোগ ও অংশীদারত্ব দেয়া, ২৩.৭- নারী-পুরুষ শ্রমিকদের সমান মজুরি, শ্রমবাজারে নারীর বর্ধিত অংশগ্রহণ ও কর্মস্থলে সমসুযোগ ও নিরাপত্তা নিশ্চিত এবং চাকরি ক্ষেত্রে বৈষম্য দূর করা, ২৩.১০- সরকারের জাতীয় হিসাব, জাতীয় উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে কৃষি ও গার্হস্থ্য শ্রমসহ সব নারী শ্রমের সঠিক প্রতিফলন মূল্যায়ন নিশ্চিত করা, ২৬.১- নারী শ্রমশক্তির শিক্ষিত ও নিরক্ষর উভয় অংশের কর্মসংস্থানের জন্য সর্বাত্মক উদ্যোগ গ্রহণ, ২৬.৫- নারীর কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ, অবস্থান ও অগ্রসরমাণতা বজায় রাখার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় পরিবেশ গড়ে তোলা, ২৬.৬- নারীর ব্যাপক কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট সব আইন, বিধি ও নীতির প্রয়োজনীয় সংস্কার, ৩১.১- জাতীয় অর্থনীতিতে নারী কৃষি শ্রমিকের শ্রমের স্বীকৃতি প্রদান করা, ৩১.২- জলবায়ু পরিবর্তন ও দুর্যোগের কারণে সৃষ্ট প্রতিবন্ধকতা দূরীকরণে নারী কৃষি শ্রমিকদের সব রকম সহায়তা প্রদান করা, ৩১.৩- কৃষিতে নারী শ্রমিকের মজুরিবৈষম্য দূরীকরণ এবং সমকাজে সমমজুরি নিশ্চিতের উদ্যোগ গ্রহণ করা। উপরোক্ত ধারাগুলো বাস্তবায়ন হলে কৃষিতে নারী শ্রমিকদের অধিকার সুপ্রতিষ্ঠিত হবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।

বাংলাদেশের কৃষিতে নারী-পুরুষের অধীন। সিদ্ধান্ত গ্রহণে পুরুষের আধিপত্য বিদ্যমান। কারণ কৃষিজমির মালিকানাও পুরুষের হাতে। ১৯৯৩ সালে ৯৮ শতাংশ পুরুষ ও ২ শতাংশ নারীর ভূমির ওপর মালিকানা ছিল। আর ২০১৩ সালে ভূমির ওপর পুরুষের মালিকানা ৯৬ দশমিক ৫২ এবং নারীদের ৩ দশমিক ৪৮ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। দেশের কৃষকদের সুনির্দিষ্ট সংখ্যার তথ্য থাকলেও কিষাণীদের কোনো সুনির্দিষ্ট সংখ্যার তথ্য নেই। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে বাজেটের মাধ্যমে কৃষক কার্ডের ব্যবস্থা করা হলেও দেশের নারীরা তা থেকে বঞ্চিত। কারণ নারীদের বেশির ভাগের জমির মালিকানা নেই। বিশেষজ্ঞদের মতে, কৃষক হিসেবে নারীদের স্বীকৃতি না থাকায় চারটি ক্ষেত্রে তারা প্রাপ্য সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। প্রথমত আর্থিক ও প্রযুক্তি, দ্বিতীয়ত খাসজমি লিজ না পাওয়া, তৃতীয়ত সরকারি প্রণোদনা এবং চতুর্থত যথাযথ মজুরি না পাওয়া। দেশের জিডিপিতে বর্তমানে নারীর অবদান ২০ ভাগ। বিশেষজ্ঞদের মতে, নারীর গৃহস্থালি ও অবৈতনিক কৃষিকাজের আনুমানিক মূল্য আড়াই লাখ কোটি টাকা। এ হিসাবে জিডিপিতে নারীর অবদান হওয়ার কথা ৪৮ ভাগ। বাংলাদেশের কৃষি অর্থনীতির সঙ্গে নারীর শ্রমকে দৃশ্যমান করা হয়নি। নারীর কাজের স্বীকৃতি দিতে হলে নারীর অবমূল্যায়িত কাজ জাতীয় অর্থনীতিতে গণনা করতে হবে। ইউএন উইমেনের তথ্য বলছে, পর্যাপ্ত সুযোগ ও প্রযুক্তিগত বাধা দূর করতে পারলে নারীর মাধ্যমে কৃষিতে উৎপাদনশীলতা ২ দশমিক ৫ থেকে ৪ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো যায়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০১৮ সালের তথ্যমতে, নারীপ্রধান পরিবারে তুলনামূলকভাবে দারিদ্র্যের হার কম। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার মতে, দেশে আড়াই কোটির বেশি মানুষ অপুষ্টিতে ভুগছে, যার ৬০ শতাংশই নারী। তবে নারীদের সক্রিয়ভাবে কৃষিতে অন্তর্ভুক্ত করলে অপুষ্টি কমবে ১২-১৭ শতাংশ।

বেইজিং প্লাটফর্ম ফর অ্যাকশন সম্মেলনের ২৫ বছর পূর্তি হলো ২০২০ সালে। বাংলাদেশ সরকার ২০২০ সালে সর্বশেষ প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। যেখানে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘আমার বাড়ি আমার খামার’ প্রকল্পের অধীনে ১ দশমিক ৫৭ মিলিয়ন নারীকে সহায়তা দেয়া হয়েছে। প্রায় ২ লাখ ৬৫ হাজার নারীকে সহায়তা দেয়া হয়েছে কম্প্রিহেনসিভ ভিলেজ ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম (ফেজ-২) প্রকল্পের আওতায়। নারীদের জন্য সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি, যেমন বয়স্ক ভাতা বিতরণ, বিধবা ভাতা বিতরণ, মাতৃত্বকালীন ভাতা ইত্যাদি বাস্তবায়ন করা হয়েছে। ভিজিডি প্রোগ্রামের আওতায় প্রতি বছর এক মিলিয়ন সুবিধাবঞ্চিত নারীকে সহায়তা দেয়া হয়েছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ৬ লাখ ২১ হাজার ২০ নারীকে উচ্চফলনশীল কৃষিপ্রযুক্তি, খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ, সংরক্ষণ, প্যাকেজিং ও আইসিটি বিষয়ে প্রশিক্ষণ প্রদান করেছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মতে, সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপে কৃষিতে নারীর সংখ্যা বাড়ছে। সরকারের বাণিজ্যিক কৃষি কর্মসূচি ও প্রকল্পগুলোয় প্রশিক্ষণের জন্য ৩০ শতাংশ নারী থাকা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। 

জাতীয় পর্যায়ে কৃষিতে অবদান রাখা নারীদের স্বীকৃতির জন্য বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পুরস্কারের ১০টি ক্ষেত্রের মধ্যে ‘কৃষিতে মহিলাদের অবদান’ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। কেআইবি কৃষি পদক নীতিমালায় ছয়টি ক্ষেত্রের মধ্যে একটি হলো ‘কৃষি উন্নয়নে নারী’। এছাড়া ২০১৭ সালের ‘কৃষি ফার্ম শ্রমিক নিয়োগ ও নিয়ন্ত্রণ নীতিমালা ২০১৭’-তে নারী কৃষি শ্রমিকের জন্য চার মাসের মাতৃত্বকালীন ছুটি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

গ্রামীণ সমাজে প্রচলিত খনার বচন এ দেশের অতীত কৃষি ব্যবস্থার সঙ্গে নারী যে ওতপ্রোতভাবে জড়িত, তা প্রমাণ করে। দেশের মোট জনগোষ্ঠীর অর্ধেক যেখানে নারী, সেখানে নারীর উন্নয়ন ব্যতীত দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন অসম্ভব। (শেষ)

আবু নোমান ফারুক আহম্মেদ: অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান, উদ্ভিদ রোগতত্ত্ব বিভাগ, 

শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়

আরও