বাংলাদেশে যাবতীয় সমস্যা-সংকটের প্রভাব ব্যাংকের ওপর গিয়ে পড়ে। মুদ্রানীতির বাস্তবায়ন থেকে শুরু করে সব দায়দায়িত্বই এখানে ব্যাংকের। কভিডের ক্ষতি থেকে রক্ষা, খেলাপি গ্রাহকের ঋণ অবলোপন কিংবা মওকুফ সবকিছুই ব্যাংকের দায়িত্ব হয়ে গেছে। কোনো গ্রাহক যদি ব্যবসায় লোকসান করে, তাহলে ব্যাংকের কাছে এসে বলে আমাকে কিন্তু এবার সুদ মওকুফ সুবিধা দিতে হবে। কিন্তু ব্যাংক কোথায় যাবে। ব্যাংক টাকাটা কোথায় পায়। আপনাদের মতো গ্রাহকদের কাছ থেকেই ব্যাংক আমানত সংগ্রহ করে। এক্ষেত্রে ব্যাংক হলো মধ্যস্থতাকারী। এক হাতে টাকা নিচ্ছে, আর অন্য হাতে টাকা দিচ্ছে। প্রক্রিয়া হিসেবে ব্যাংক কিছু ফি কিংবা কমিশন উপার্জন করে। যে সময় ও শর্তে আমানতকারীদের কাছ থেকে ব্যাংক অর্থ নেয়, সে সময় ও শর্ত মেনে ব্যাংক সে অর্থ ফেরত দেয়। ঋণগ্রহীতাদের কাছ থেকে টাকা ফেরত পাক বা না-ই পাক।
স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের পরিচিতি ছিল তলাবিহীন ঝুড়ি। সেখান থেকে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের ৩৫তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ হয়েছে। অর্থনীতি আজকের অবস্থায় এসেছে কীভাবে? আমাদের দেশের পুঁজিবাজার এমন করুণ অবস্থায় আছে, যেটি নিয়ে কথা না বলাই ভালো। এটি নিয়ে কথা বলতে গেলে লজ্জাই পাব। এনবিএফআইয়ের (নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান) দায়িত্ব ছিল দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়ন করা। কিন্তু বিভিন্ন কারণে এ খাতও এখন মৃত। তাহলে বিকল্প আছে কেবল বাণিজ্যিক ব্যাংক। আমরা ব্যাংক থেকে অতীতে মেয়াদি ঋণও দিয়েছি। ব্যাংকের তহবিলের উৎস তথা আমানতের মেয়াদ হলো তিন-ছয় মাস। আমানতের এ অর্থ থেকেই আমরা সাত-আট বছর মেয়াদি ঋণ বিতরণ করেছি। এরপর সে ঋণের মেয়াদ আরো সাত-আট বছর বাড়ানোর প্রস্তাব এসেছে। তাহলে দেখা যাচ্ছে, একটি ঋণ দেয়ার পর সেটি ১৫ বছরেও ফেরত আসছে না। কিন্তু আমানতকারীদের অর্থ তিন কিংবা ছয় মাসের মধ্যেই ফেরত দিতে হচ্ছে। অসম এ পদ্ধতির কারণেই ব্যাংকে তারল্যের সংকট তৈরি হয়েছে।
গত ৫ আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানের পর দেশের অনেক ব্যাংক বিপদে পড়েছে। এ ব্যাংকগুলোর সংকট আগেও ছিল। কিন্তু এখন সেটি প্রকাশ পেয়েছে। ২০০৯ সালে দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ২২-২৩ হাজার কোটি টাকা। এখন সেটি ২ লাখ ৮৫ হাজার কোটি টাকায় গিয়ে ঠেকেছে। খেলাপি ঋণের হার দাঁড়িয়েছে ১৭ শতাংশে। খেলাপির এ হার ৩০-৩৫ শতাংশ পর্যন্তও হয়ে যেতে পারে। সংকটে পড়া ১১টি ব্যাংকের পাশাপাশি আরো অনেক ব্যাংকই সমস্যাগ্রস্ত। অন্যদিকে আমাদের দেশের ব্যাংকগুলোর মূলধন রেশিও খুবই কম। এ কারণে কিছু ব্যাংক ঋণ দেয়ার সক্ষমতাই হারিয়ে ফেলেছে। আবার টাকার অবমূল্যায়নের কারণে গ্রাহকদের ঋণের চাহিদা বেড়ে গেছে। আগে যে পণ্য ১০০ টাকায় আমদানি করা যেত, এখন সেটি আনতে আরো বেশি অর্থের প্রয়োজন হচ্ছে। ঋণ দেয়ার সক্ষমতা হারিয়ে ফেলা ১১টি ব্যাংকের গ্রাহক যখন আমার কাছে আসছে, তখন আমিও ঋণ দিতে পারছি না।
খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ার কারণে ব্যাংকে নগদ প্রবাহ কমে গেছে। এ কারণে আমাদের বেশি রেটে আমানত সংগ্রহ করতে হচ্ছে। যেখানে সরকার এখন সাড়ে ১১-১২ শতাংশ সুদে ঋণ নিচ্ছে, তখন আমাকেও আমানতের বিপরীতে সমপরিমাণ সুদ দিতে হচ্ছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, সুদের হার বেড়ে যাওয়ায় তাদের পরিচালন ও উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। এজন্য তারা গভর্নরের সঙ্গে দেখা করে সুদহার সিঙ্গেল ডিজিটে (এক অংক) নামিয়ে আনার দাবি জানিয়েছেন। কিন্তু আমার কথা হলো আমাদের কি সে সামর্থ্য আছে। আমরা কি সিঙ্গেল ডিজিট সুদে আমানত সংগ্রহ করতে পারছি। বিদেশী ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে আমরা ঋণ নিতাম। তারা আমাদের এলসির বিপরীতে নিশ্চয়তা দিত। কিন্তু বিদেশীরা এখন আর আমাদের ঋণ দিচ্ছে না। কেউ কেউ তাদের ঋণসীমা কমিয়ে দিয়েছে। যারা ঋণসীমা কমায়নি, তারাও সুদ ও ফি বাড়িয়ে দিচ্ছে। তার মানে ব্যাংক হিসাবে আমার ব্যয় বাড়ছে।
দিন শেষে আমার ব্যাংক তো একটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান। এটি পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত একটি কোম্পানি। শেয়ারহোল্ডারসহ অন্যদের কাছে আমার দায়বদ্ধতা রয়েছে। আমি তো লোকসান দিয়ে ব্যবসা করতে পারব না। ব্যাংক তো দাতব্য সংস্থা নয়। এ অবস্থায় ইচ্ছা থাকলেও আমরা কিছু করতে পারছি না। কারণ আমাদের অনেক কিছুর ওপর নির্ভর করতে হয়। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির এখনো দৃশ্যমান উন্নতি হয়নি। ব্যবসায়ীরা নিশ্চিত করে বলতে পারছেন না, আগামীতে কী হবে। এ অবস্থার মধ্যেও গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়ছে।
ব্যাংকার হিসেবে আমরা গ্রাহকদের পাশে থাকতে চাই। এসএমই, কৃষির মতো খাতগুলোয় বিনিয়োগ বাড়াতে চাই। তবে শঙ্কার কথা হচ্ছে আগামীতে সরকার ব্যাংক খাত থেকে আরো বেশি পরিমাণ ঋণ নেবে। এমনকি সরকারি কর্মচারীদের বেতন-ভাতা পরিশোধের জন্যও। এ অবস্থায় ব্যাংকের পক্ষে ব্যবসায়ীদের ঋণ দেয়া আরো বেশি কঠিন হয়ে যেতে পারে। বাংলাদেশের অর্থনীতি বর্তমানে বেশ কঠিন অবস্থায় রয়েছে, যার প্রভাব ব্যাংক খাতেও পড়ছে। তবে ব্যাংক খাতের চ্যালেঞ্জের মধ্যেও সবসময়ই ব্যবসায়ীদের পাশে থাকবে।
সৈয়দ মাহবুবুর রহমান: ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক পিএলসি
[বণিক বার্তা আয়োজিত ‘খাদ্যপণ্যের যৌক্তিক দাম: বাজার তত্ত্বাবধানের কৌশল অনুসন্ধান’ শীর্ষক পলিসি কনক্লেভে প্যানেল আলোচকের বক্তব্যে]