অভিমত

কার্যকর শিখন নিশ্চিতে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সম্পর্ক

শিষ্য ও গুরুর মাঝে সম্পর্ক, ভাবের আদান-প্রদান, জ্ঞানের বিনিময় এসব নিয়ে কথা বলতে গেলে প্লেটো, সক্রেটিস, অ্যারিস্টটল চলে আসেন। গ্রিক সভ্যতা জ্ঞান-বিজ্ঞানে বিকশিত হওয়ার পেছনে এ গুরু শিষ্যত্রয়ের দর্শনের বিশাল প্রভাব রয়েছে। প্রাচীন গ্রিক দর্শনের উদ্ভব ঘটে মূলত খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে এবং বলা চলে হেলেনিস্টিক যুগ অর্থাৎ খ্রিস্টপূর্ব ৩০ থেকে ৩২৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত স্থায়ী হয়েছিল। গ্রিক

শিষ্য ও গুরুর মাঝে সম্পর্ক, ভাবের আদান-প্রদান, জ্ঞানের বিনিময় এসব নিয়ে কথা বলতে গেলে প্লেটো, সক্রেটিস, অ্যারিস্টটল চলে আসেন। গ্রিক সভ্যতা জ্ঞান-বিজ্ঞানে বিকশিত হওয়ার পেছনে এ গুরু শিষ্যত্রয়ের দর্শনের বিশাল প্রভাব রয়েছে। প্রাচীন গ্রিক দর্শনের উদ্ভব ঘটে মূলত খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে এবং বলা চলে হেলেনিস্টিক যুগ অর্থাৎ খ্রিস্টপূর্ব ৩০ থেকে ৩২৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত স্থায়ী হয়েছিল। গ্রিক দর্শনে অনেক বিষয়ের সংমিশ্রণ ছিল। যার মধ্যে রাজনৈতিক দর্শন, নীতিশাস্ত্র, অধিবিদ্যা, অন্টোলজি (যা অস্তিত্বের প্রকৃতি, বিকাশ, অস্তিত্ব বা বাস্তবতার অধ্যয়ন নিয়ে আলোচনা করে), যুক্তিবিদ্যা, জীববিজ্ঞান, নন্দনতত্ত্ব এবং নান্দনিকতার দর্শন। গ্রিক দর্শনের ব্যাপ্তি এতটাই ছিল যে পাশ্চাত্যজুড়ে যে চিন্তাধারার প্রবাহ, সেখানে গ্রিক দর্শনের বিরাট প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। গ্রিক সভ্যতায় বিভিন্ন দার্শনিকের অস্তিত্ব দেখা গেলেও সক্রেটিস, প্লেটো ও অ্যারিস্টটল সমসাময়িক কালের সবচেয়ে বেশি উল্লেখযোগ্য দার্শনিক। 

এ মহান দার্শনিকদের মধ্যে সক্রেটিস ৪৭০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে এথেন্সে জন্মগ্রহণ করেন। তাকে পাশ্চাত্য দর্শনের স্থপতি হিসেবে মূল্যায়ন করা হয়ে থাকে। তার জীবন ও দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি ঘিরে যে রহস্যের মেঘ রয়েছে তা প্রকৃত প্রস্তাবে একটি গভীর সমস্যা উন্মোচন করে যেটি ‘সক্রেটিক সমস্যা’ নামেও পরিচিত। সক্রেটিস কোনো দর্শনশাস্ত্র রচনা কিংবা প্রকাশ করেছেন বলে তথ্য-উপাত্ত পাওয়া যায়নি। বরং তার দর্শন ছড়িয়ে পড়েছিল সমসাময়িক কালের লোকজনের লেখার মাধ্যমে। প্লেটো, জেনোফোন, অ্যারিস্টটল ও অ্যারিস্টোফেনসের মতো দার্শনিকরা তাদের রচনাগুলোয় সক্রেটিসের রহস্যময় ব্যক্তিত্ব এবং দর্শন সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। দর্শনশাস্ত্রে সক্রেটিসের একটি স্বতন্ত্র পদ্ধতির সংযোগ হয় যেটি সক্রেটিক পদ্ধতি হিসেবে পরিচিত। সক্রেটিস কি আদতে আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো শিক্ষা দিতেন? তাহলে কী ছিল সে পদ্ধতি যা মানুষের মনোজগতে নাড়া দিত, তার অন্তর্নিহিত শক্তিকে প্রকাশ করত? সক্রেটিক পদ্ধতির অন্তর্নিহিত নীতিটি হলো, মানুষের যুক্তিকে সামনে নিয়ে আসা এবং যুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে শেখার বিভিন্ন পর্যায়ে ব্যক্তি তার নিজস্ব তত্ত্ব যেমন উন্মোচন করতে সমর্থ হন তেমনি এর অন্তর্নিহিত জটিল বিষয়গুলো অনুধাবন করতে শেখেন। সক্রেটিস প্রবর্তিত এ পন্থাকে হাজার বছর ধরে জ্ঞানচর্চার মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করে আসছেন শিক্ষক এবং ছাত্ররা। প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে নিজস্ব ভাবনার বিকাশের এমন পন্থা গুরু-শিষ্যের মাঝে ভাব-জ্ঞান, চিন্তাদর্শন বিনিময়ে মিথস্ক্রিয়ার সৃষ্টি করে। সক্রেটিসের ছাত্র ছিলেন প্লেটো যার মাঝে প্রবাহিত হয়েছিল গুরু সক্রেটিসের দর্শন। প্লেটোও তার গুরুকে নিয়ে এক রহস্যের বেড়াজালে আবদ্ধ ছিলেন। প্লেটোর জন্ম ৪২৮ থেকে ৪২৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যে হতে পারে বলে অনুমান করা হয়। পাশ্চাত্য শিক্ষা এবং দর্শনের পাদপীঠ এথেন্স একাডেমির প্রতিষ্ঠা পায় প্লেটোর হাতে এবং পশ্চিমা বিশ্বে উচ্চশিক্ষার প্রথম প্রতিষ্ঠান এই একাডেমি। প্লেটোর ছাত্র ছিলেন অ্যারিস্টটল। খ্রিস্টপূর্ব ৩৮৪ থেকে ৩২২ খ্রিস্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত বেঁচে ছিলেন তিনি। অ্যারিস্টটল তার নানা বিভাগে বিস্তৃত দর্শনের মাধ্যমে শিক্ষা ও জ্ঞানকে সমৃদ্ধ করেছেন। ১৮ বছর বয়সে অ্যারিস্টটল এথেন্সে প্লেটোর একাডেমিতে যোগ দেন এবং ৩৭ বছর বয়স পর্যন্ত সেখানেই ছিলেন। গুরু প্লেটোর সান্নিধ্যে থেকে জ্ঞানের যে নির্যাস আস্বাদন করেছেন তা তাকে সমৃদ্ধ করেছে এবং যোগ্য শিষ্য হিসেবে অ্যারিস্টটল তা পরবর্তী প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন এবং এখনো সে ধারা প্রবহমান। 

সক্রেটিস, প্লেটো ও অ্যারিস্টটল নিয়ে যে আলোচনা করা হলো সেটা মূলত গুরু ও শিষ্যের মাঝে ভাব, জ্ঞান আদান-প্রদানের প্রবাহ এবং এর প্রক্রিয়ার একটি প্রতিচ্ছবি। কালের চক্রে গুরু-শিষ্যের মধ্যে জ্ঞানের চর্চা এবং বিনিময়ে অনেক বৈচিত্র্য এসেছে, পেয়েছে বিভিন্ন মাত্রা। সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে শিখন, শিক্ষাদান এবং শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মাঝে সম্পর্কের ক্ষেত্রেও এসেছে নানা পরিবর্তন। বিশ্বের বিভিন্ন জাতি, বিভিন্ন সভ্যতার ফিরিস্তি বর্ণনা যেমন কষ্টকর তেমনি সময়সাপেক্ষও বটে। তবে সময়ের প্রেক্ষাপটে অধুনা সভ্যতায় গুরু-শিষ্যের সম্পর্ক কেমন, জ্ঞান বিস্তরণ এবং এর গ্রহণ ও ধারণের বিষয়টি বিশদ পর্যলোচনার দাবি রাখে। উচ্চশিক্ষায় যিনি শিক্ষা দান করেন তাকে সিনিয়র স্কলার এবং যিনি শিক্ষার্থী হিসেবে থাকেন তাকে জুনিয়র স্কলার হিসেবে গণ্য করা হয়। একজন শিক্ষার্থী তার শিক্ষাজীবনের অধিকাংশ সময় তার শিক্ষকের সান্নিধ্যে কাটায়। একইভাবে একজন শিক্ষকও তার শিক্ষকতা জীবনের অধিকাংশ সময় কাটান তার শিক্ষার্থীদের সঙ্গে। ধারণা করা হয়, একজন শিক্ষার্থী একটি সাধারণ বিদ্যালয়ে বছরে তাদের শিক্ষকের সঙ্গে ১ হাজার ঘণ্টারও বেশি সময় ব্যয় করে। এ দীর্ঘ সময়ে গুরু-শিষ্যের মাঝে এমন একটি সম্পর্ক গড়ে তোলার জন্য যথেষ্ট সময় যা একজন শিক্ষার্থীর শেখার প্রতি আজীবন ভালোবাসাকে প্রজ্বলিত করতে পারে এবং পরিবর্তন আনতে পারে মন ও মানসে। 

শিক্ষা পর্যবেক্ষকরা দীর্ঘদিন ধরে তাদের পর্যবেক্ষণ থেকে দেখেছেন যে শিক্ষার্থীদের ভালো করার পেছনে একজন শিক্ষকের সঙ্গে শিক্ষার্থীর সম্পর্ক কতটা গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে। ইউনিভার্সিটি অব সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়ার কগনিটিভ নিউরোসায়েন্টিস্ট মেরি হেলেন ইমরডিনো-ইয়াংয়ের মতে, কিছু মানুষ কখনো কখনো একটি শিশুর সম্ভাবনা, তার আগ্রহ, তার শক্তি এবং দুর্বলতা সম্পর্কে ধারণা করা কিংবা জানার ক্ষেত্রের গভীর সম্পর্ক গড়ে তোলার জন্য এক ধরনের নৈমিত্তিক পরিচিতি এবং বন্ধুত্বের প্রয়োজন আছে কিনা সে সম্পর্কে ভুল ধারণা পোষণ করে। মূলত শিশু শিক্ষার্থীর সঙ্গে গভীর সম্পর্ক গড়ে না তুললে তার মনোজগৎ যেমন জানা সম্ভব হয় না তেমনি শিক্ষার্থীর মাঝে লুক্কায়িত সম্ভাবনা কিংবা সেই শক্তিকে কাজে লাগানোর পথে কী বাধা থাকতে পারে এবং সেগুলোকে উত্তরণের উপায় কী সে বিষয়ে গুরু শিষ্যকে পথ বাতলাতে সক্ষম হন না। একজন শিক্ষক যিনি গুরু তিনি যা করবেন বলে আশা করা হয় তার মধ্যে রয়েছে স্থান, শিক্ষার্থী, পরিবার এবং সহকর্মীদের সঙ্গে শক্তিশালী, সুরক্ষিত সম্পর্ক তৈরি করা। একজন গুরু কিংবা শিক্ষক প্রকৃতপক্ষে শিষ্যের জন্য সামাজিক এবং মানসিক সহায়তার স্তর হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আমরা আমাদের পূর্ববর্তী প্রজন্মের কাছ থেকেও গুরু-শিষ্যের সম্পর্ক নিয়ে অনেক কথা শুনেছি এবং এ নিয়ে লোকগাথারও অভাব নেই। এমন সময়ের কথাও জানি যখন শিক্ষার্থী শিক্ষকের বাড়িতে থেকে-খেয়ে বিদ্যার্জন করতেন এবং প্রথাগতভাবে একটা রীতি চলে আসছিল যেখানে ‘গুরু বাক্য শিরোধার্য’। আমাদের সমাজে ঐতিহ্যগতভাবে শিক্ষক-শিক্ষার্থী সম্পর্ক এ চিন্তার ওপর ভিত্তি করে ছিল যে শিক্ষকদের মৌলিক কর্তৃত্ব রয়েছে শিক্ষার্থীর ওপর এবং শিক্ষার্থীদের জন্য কোনটি ভালো তা শিক্ষক জানেন এবং শিক্ষক যা বলছেন তা হ্যাঁ বলে গ্রহণ করে শিক্ষার্থী তার জ্ঞানের পাত্র পূর্ণ করবে। দীর্ঘ সময়ে আমাদের যেমন আর্থসামাজিক অবস্থার পরিবর্তন এসেছে তেমনি আমাদের চিন্তা-চেতনায়ও এসেছে বিশাল পরিবর্তন। সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে তথ্যপ্রযুক্তি শিক্ষার্থীদের মধ্যে ভিন্ন পরিবেশ নিয়ে আসে। সেক্ষেত্রে শিক্ষককে শিক্ষার্থীর সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে নিত্যনতুন প্রযুক্তির সঙ্গে পরিচিত হতে হয়। কিন্তু যে কথাটি সর্বত্র আলোচিত—‘বিজ্ঞান দিয়েছে গতি, কেড়ে নিয়েছে জ্যোতি; দিয়েছে বেগ কেড়ে নিয়েছে আবেগ’, সেখানে বিজ্ঞান আর পুঁজি একাকার হয়ে শিক্ষা দান এবং গ্রহণ এখন এক ব্যবসায়িক ভিত্তি পেয়েছে। শিক্ষার ভিত্তি প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক সর্বত্র এখন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাদানের পরিবর্তে অর্থের বিনিময়ে শ্রেণী কক্ষের বাইরে অন্য কোথাও জ্ঞান দানের দোকান খোলা হচ্ছে। রাস্তায় বের হলেই নানা বর্ণের পোস্টার, ফেস্টুন দেখা যায় যেখানে অমুক স্যারের ম্যাজিকাল শিক্ষাদান, তমুক স্যার কীভাবে স্বল্প পড়ে বেশি নম্বর পাওয়া যায় তার সবক ও তবক দেনসহ নানা চটকদার বিজ্ঞাপন। বিজ্ঞ অভিভাবক তার সন্তানের অতিসহজে ভালো ফলাফল লাভের উপায় হিসেবে বিদ্যালয় নয়, বরং শিক্ষার দোকানে পাঠান। এভাবে দোকান জমজমাট হয়ে ওঠে, অধিক পুঁজির লোভে শিক্ষকরাও দোকানে এসে ভিড় করে বাড়তি আয়ের জন্য। সম্পর্ক যখন অর্থের বিনিময় হয়ে দাঁড়ায় তখন সেকালের গুরু-শিষ্য এবং একালের বাজার অর্থনীতির যুগে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সংযোগ সূত্র ভিন্ন না হয়ে যাবে কোথায়? শিক্ষা যেদিন থেকে পণ্যের কাতারে স্থান নিয়েছে সেদিন থেকে এর ব্যবহার এবং বিনিময়ের ধারাও পরিবর্তন হয়ে গেছে। ব্যবসায়ী সাধারণত তার ব্যবসার খাতিরে যতটুকু দেয়া-নেয়া যায় ততটুকুই করে থাকেন, জনকল্যাণ কিংবা প্রতিশ্রুতি কতটুকু থাকে সেটি পর্যালোচনার দাবি রাখে। অন্যদিকে মনোবিজ্ঞানী মার্কাসের মতে, একজন যত্নশীল শিক্ষকের সঙ্গে সম্পর্ক একজন শিক্ষার্থীর মস্তিষ্কের বিকাশকে পরিবর্তন করতে পারে, ট্রমা নিরাময় করতে পারে এবং শিখনকে প্রসারিত করতে পারে। প্রকৃত শিক্ষকের এ ক্ষমতা ব্যবহার করার অপার সম্ভাবনাও রয়েছে। কিন্তু শিক্ষার যে বাণিজ্যিকীকরণ চলছে তাতে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের কাছে শিক্ষা কেবল পণ্য হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে এবং শিক্ষক এসব পণ্যের বিক্রেতা মাত্র। গুরু-শিষ্যের এমন সম্পর্ক নিয়ে শিক্ষার্থী যখন উচ্চশিক্ষা গ্রহণের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা অন্যান্য উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠানে গমন করেন তখন সে প্রতিষ্ঠানগুলোও তার কাছে শ্রেফ সনদ বিক্রির দোকান মনে হয়। অথচ উচ্চশিক্ষার পাদপীঠগুলো হলো নতুন নতুন দর্শন সৃষ্টির কারখানা; কোনো দোকান নয় বরং অ্যারিস্টটলের লাইসিয়াম। কিন্তু কালের চক্রে শিক্ষার ব্যবসায়িক ধারা এখন উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। সেখানেও এখন নতুন জ্ঞান সৃষ্টি, উদ্ভাবন কিংবা নতুন দর্শনের বিকাশ বন্ধের পথে। গুরুর যেমন সময় কিংবা ইচ্ছা নেই জ্ঞান ও দর্শনের বিকাশে শিষ্যের চিন্তা-চেতনার অংশীদার হয়ে গুরু-শিষ্যে মিশে যেতে, তেমনি শিষ্য তো শিখে এসেছে শিক্ষার জায়গা হচ্ছে শিক্ষার দোকান এবং অর্থের বিনিময়। তাই শিক্ষার্থীকে দেখা যায় না নিখাদ জানার উদ্দেশ্যে শিক্ষকের সান্নিধ্য লাভ করতে। সম্প্রতি কেমন হতে পারে গাভীবৃত্তান্তর বর্তমান সংস্করণ শিরোনামে আমার লেখা নিবন্ধ দৈনিক বণিক বার্তায় প্রকাশ হওয়ার পর লেখাটি অনেক শিক্ষার্থীর মনোযোগ আকর্ষণ করে এবং তারা জানতে চায় আহমদ ছফার যদ্যপি আমার গুরুর আলোকে আমাদের শিক্ষকদের অবস্থান মূল্যায়ন কেমন হতে পারে। সেই আক্ষেপ থেকেই বলতে হয়, কোথা সে গুরু আর কোথা তার শিষ্য। প্রফেসর আব্দুর রাজ্জাক যেমন ছিলেন জ্ঞানের মহাসমুদ্র আর সমুদ্র সেঁচে অমৃত লাভে মরিয়া হতে দেখা গেছে আরেক জ্ঞানপিপাসু আহমদ ছফাকে। গুরু-শিষ্যের রসায়ন এমনটাই হওয়া উচিত। কিন্তু বর্তমান প্রেক্ষাপটে এমন দৃশ্য একেবারেই বিরল। সফলতার সংক্ষিপ্ত পথ খোঁজ করা এবং সে পথ দেখানোই যেখানে শিষ্য ও গুরুর মাঝে সম্পর্কের ভিত্তি সেখানে জ্ঞান, দর্শন নামক শব্দগুলো একেবারেই বেমানান এবং যেসব শিক্ষক শ্রেণী কক্ষে শিক্ষার্থীকে জ্ঞান, দর্শন, উদ্ভাবনের কথা বলেন আদতে তারা শিক্ষার্থীদের কাছেও অপাঙ্‌ক্তেয়। পারিবারিক, সামাজিক, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা যেখানে সফলতার নির্দিষ্ট নির্দেশক হিসেবে অর্থ উপার্জন, ক্ষমতা কিংবা পদ-পদবি ইত্যাদিকে ঠিক করে রেখেছে সেখানে শিক্ষার্থী এর বাইরে আর কিইবা চিন্তা করতে পারে। উচ্চশিক্ষা পাদপীঠের স্তম্ভ যখন মিথ্যা, দুর্নীতি আর দাসত্বের ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে সেখানে স্বাধীন চিন্তা, মুক্ত বুদ্ধিচর্চা, নতুন দর্শনের উদ্ভবের চিন্তা করা অবান্তর। যেখানে প্রতিষ্ঠানের প্রধান ব্যক্তিটি মিথ্যা আর সততার মুখোশের আড়ালে সব ধরনের দুর্নীতির চর্চা করেন, তার জন্য পুরস্কৃত হন এবং নিত্য পত্রপত্রিকায় এমন খবর প্রচারিত হয় সেখানে জ্ঞান–গবেষণার কথা কেবলই ‘বাত কি বাত’। সেখানে শিষ্য হারায় গুরুর ওপর বিশ্বাস ও ভক্তি আর গুরু হারায় সত্য কথাটি বলার শক্তি। জ্ঞান আহরণের জন্য এখন গুরুভক্তি নেই, বরং দাসত্ব এবং অর্থ সে স্থান দখল করে নিয়েছে। ফলে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে যে মস্তিষ্কবিহীন গুরুর সৃষ্টি হচ্ছে এবং তাদের কাছ থেকে দাসত্বের জ্ঞান নিয়ে যে শিষ্য বেড়ে ওঠে তার মাঝে সোজা হয়ে দাঁড়ানোর শক্তি আসবে কোথা থেকে? সে কি কখনো তার সম্ভাবনা শক্তিকে আবিষ্কার করতে পারবে? কিংবা কোন গুরুইবা দেবে শিষ্যের অসীম শক্তির সন্ধান? প্রাথমিক শিক্ষা থেকে শিশু শিষ্যের মনোজগতে গুরুর প্রভাব থাকতে হবে, শিষ্যকে দেখাতে হবে আলোর পথ, জাগিয়ে তুলতে হবে শিষ্যের অমিত সম্ভাবনা শক্তিকে। এ ধারা প্রবাহিত হতে হবে মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিকে এবং উচ্চ শিক্ষালয়ে এসে শিষ্যের মাঝে সৃষ্টি করতে হবে দর্শনের, শিষ্যের অমিত সম্ভাবনা শক্তিকে ব্যবহার করতে হবে তাতে হবে নিত্য নতুন উদ্ভাবন। উন্নত বিশ্বের শিক্ষা ব্যবস্থায় এমনটা এখনো বিদ্যমান। আমাদের তাহলে কী হলো? শিক্ষকের অবক্ষয়, শিক্ষার অবক্ষয় থেকে শিক্ষার্থীর অবক্ষয় এখন সর্বত্র। এক সময়ে শিক্ষকের মর্যাদা ছিল সবার ওপরে যেটি আজ তলানিতে। এখানে নীতিনির্ধারকরাও দায় এড়াতে পারেন বলে মনে হয় না। শিক্ষক এখন অবহেলার আরেক নাম, আর অবহেলিতজন সময়ের পরিক্রমায় তার মর্যাদা হারায়, সত্য কথাটি শক্ত করে বলার সাহসও হারায়, ফলে সৃষ্টি হয় মেরুদণ্ডহীন প্রজন্ম। শিক্ষকদের অবস্থা অনেকটা সৈয়দ মুজতবা আলীর পণ্ডিত মশাই গল্পের পণ্ডিত মশাইর মতো। চাকচিক্যময় জগতের হাতছানিতে অনেক শিক্ষক যোগ দিচ্ছেন এখানে সেখানে গড়ে ওঠা শিক্ষা বিক্রির দোকানে। গুরুর একমাত্র সম্বল মর্যাদা, সেটাও যখন তিরোহিত, তখন গুরুর আসনে আর গুরু বসছেন না, জায়গাটি দখল করে নিয়েছে ব্যবসায়ী। ফলে যে শিষ্যের সৃষ্টি হচ্ছে তার কাছেও শিক্ষা একটি পণ্য হিসেবেই বিবেচিত হচ্ছে। তাই গুরু অর্থে যাকে ধারণা করা হয় তাকে যেমন পাওয়া অসম্ভব তেমনি জ্ঞানপিপাসু শিষ্য তাকেই বা কোথায় পাব? হরে-দরে সব গুরু কিংবা শিষ্যকে অবক্ষয়ের কাতারে ফেলা ঠিক হবে না, বরং জ্ঞানের আদান-প্রদান, প্রবাহ, সত্যটিকে গ্রহণ এবং জীবনাচরণে ব্যবহার করার মতো গুরু-শিষ্য এখনো সমাজে রয়েছে, কিন্তু দুষ্ট ক্ষমতাবানের কাছে তারা নির্বোধের তালিকায়। শিক্ষা-সংস্কৃতিতে নিখাদ গুরু-শিষ্যের মিথস্ক্রিয়ার অবস্থা ফিরে এলে হয়তো শিক্ষার লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব হবে, না হয় শিক্ষা কেবল পণ্য হিসেবেই থেকে যাবে। সেই পরিবেশের অপেক্ষায় থেকে খুঁজছি জ্ঞানতাপস গুরুর যোগ্য শিষ্যকে।

ড. এএসএম সাইফুল্লাহ: অধ্যাপক, মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

আরও