অভিজ্ঞতা বিনিময়

আমার নগরে আরবান প্লাজার ভাবনা ও চারমিনার অভিজ্ঞতা

আমাদের যখন সিগারেট খাওয়ার বয়স হয়নি তখন থেকেই আমরা অন্তত একটা সিগারেট ব্র্যান্ডের নাম পড়ে পড়ে বড় হয়েছি। সে সিগারেটের ব্র্যান্ডের নামটি হলো চারমিনার। সত্যজিৎ রায়ের বিখ্যাত গোয়েন্দা চরিত্র ফেলুদা চারমিনার ব্র্যান্ডের সিগারেট খেতেন আর ব্যবহার করতেন টেক্কা মার্কা দিয়াশলাই। ১৯৬৫ থেকে ১৯৯৭ পর্যন্ত সত্যজিৎ রায় ফেলুদা সিরিজের কয়েক ডজন ভীষণ সুন্দর আর জনপ্রিয় গল্প লেখেন।

আমাদের যখন সিগারেট খাওয়ার বয়স হয়নি তখন থেকেই আমরা অন্তত একটা সিগারেট ব্র্যান্ডের নাম পড়ে পড়ে বড় হয়েছি। সে সিগারেটের ব্র্যান্ডের নামটি হলো চারমিনার। সত্যজিৎ রায়ের বিখ্যাত গোয়েন্দা চরিত্র ফেলুদা চারমিনার ব্র্যান্ডের সিগারেট খেতেন আর ব্যবহার করতেন টেক্কা মার্কা দিয়াশলাই। ১৯৬৫ থেকে ১৯৯৭ পর্যন্ত সত্যজিৎ রায় ফেলুদা সিরিজের কয়েক ডজন ভীষণ সুন্দর আর জনপ্রিয় গল্প লেখেন। পরবর্তী সময়ে জয় বাবা ফেলুনাথ আর সোনার কেল্লা সিনেমাও বানান, যেখানে ফেলুদা চরিত্রে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের ঠোঁটে চারমিনার সিগারেটকে নায়কোচিত ভঙ্গিমায় ধূমায়িত হতে দেখা যায়। ফিল্টার সিগারেট সুলভ হওয়ার আগের যুগে কলকাতাকেন্দ্রিক শিল্পী-সাহিত্যিক বুদ্ধিজীবীরা চারমিনার সিগারেটের খুব ভক্ত ছিলেন। দেশে চারমিনারের সমকক্ষ ছিল স্টার সিগারেট। পরবর্তী জীবনে জানতে পারি চারমিনার আসলে ভারতের অন্ধ্র প্রদেশের হায়দরাবাদের চারটি বিশাল আইকনিক মিনারের একটি মনুমেন্টের নাম (বর্তমানে অন্ধ্র প্রদেশ ভাগ করে তেলেঙ্গানা আর অন্ধ্র দুটি প্রদেশ করা হয়েছে, হায়দরাবাদ এখন তেলেঙ্গানার রাজধানী) আজ থেকে প্রায় সোয়া ৪০০ বছর আগে সুলতান মোহাম্মদ কুলি কুতুব শাহ এটা নির্মাণ করেন। এর ওপর মসজিদ ছিল, মদ্রাসাও ছিল বলে শুনেছি। দুই সপ্তাহ আগে হায়দরাবাদ এসে চারমিনার চত্বরে গিয়ে বয়সে সেই কিশোর বয়সে মস্তিষ্কে গেঁথে যাওয়া চারমিনার চর্মচক্ষু দিয়ে দেখার সৌভাগ্য হয়েছে।

কথিত আছে পারস্য থেকে স্থপতি এনে চারমিনার ডিজাইন করা হয়েছিল। এর আর্চের ডিজাইনে পারস্য স্টাইল সুস্পষ্ট, তবে সম্পূর্ণ ডিজাইন লক্ষ করলে বোঝা যায়, এতে স্থানীয় প্রাচীন ভারতীয় স্থাপত্যেরও সুন্দর পরিমিত মিশ্রণ হয়েছে। খুব সম্ভবত সে কারণেই ডিজাইনটি পণ্ডিত থেকে সাধারণ মানুষ সবার কাছে আকর্ষণীয় মনোমুগ্ধকর হয়েছে। ব্রিটিশরা আমাদের ইতিহাসকে যেমন সাম্প্রদায়িকরণ করে নাম দিয়েছে হিন্দু পিরিয়ড, মুসলিম পিরিয়ড আর ব্রিটিশ পিরিয়ড (নিজেদের পিরিয়ডকে কিন্তু তারা খ্রিস্টান পিরিয়ড বলেনি), তেমনি আমাদের স্থাপত্যের ইতিহাসকে হিন্দু আর্কিটেকচার, মুসলিম আর্কিটেকচার আর কলোনিয়াল বা ব্রিটিশ আর্কিটেকচার নাম দিয়েছে। সেই হিসাবে এটাকে বলা হয় Indo-Islamic architectural style আসলে এর নাম হওয়া উচিত Indo-Persian style-এর একটা ফিউশন।

গ্রানাইট, মার্বেল, লাইমস্টোন দিয়ে তৈরি প্রায় ১৬০ ফুট উঁচু চারটি মিনারের অপরূপ স্থাপত্য সত্যিই খুব সুন্দর। তবে আমার কাছে তার চেয়েও সুন্দর মনে হয়েছে চারমিনারকে ঘিরে মানুষের যে বিশাল আনাগোনা, বিশাল কর্মযজ্ঞ, বিপুল মিথস্ক্রিয়া তৈরি হয়েছে সেটা। চারমিনারের চারটি আর্চ থেকে সমকোণে বেরিয়ে গেছে চারটি রাস্তা; লাড বাজার এর মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত। সে হিসাবে চারমিনারকে আদি হায়দরাবাদের কেন্দ্র বলা যায়। চারমিনার চত্বর একটা অভাবনীয় সুন্দর আরবান পাবলিক স্পেস। আমাদের চকবাজারকে ৩০ দিয়ে গুণ করলে স্পেসটা ভাবা যাবে। কী নেই চত্বরেশাড়ি, চুড়ি, ওড়না, লেহেঙ্গা, শেরওয়ানি, মুজিব কোট (ওরা বলে সাদ্রি), আতরের দোকান, খেলনার দোকান, তাবিজ-মাদুলি, বেলুন, আখের রস, বেদানার রস, ফালুদা, লাচ্ছি, নানা রকমের ঝলসানো কাবার, বাহারি রুমালি রুটি, আলু-পরটা, গোবি পরটা, পাওভাজি আর হায়দরাবাদি বিরিয়ানি তো আছেই। শত শত বছর ধরে বংশপরম্পরায় এরা ব্যবসা বা পেশায় নিয়োজিত চারমিনাকে ঘিরে। এলাকাটা প্রধানত মুসলিম অধ্যুষিত।

এমন জীবন্ত ইন্টারেক্টিভ প্রাণবন্ত আরবান স্পেস পৃথিবীর প্রায় সব বড় শহরেই আছে। লন্ডন শহরে যেমন আছে ট্রাফাগ্লার স্কয়ার, সারা লন্ডনের সর্বশ্রেণীর, সর্বপেশার মানুষ শতাব্দীর পর শতাব্দী সেখানে কারণে অকারণে, উৎসব-আনন্দে, বিক্ষোভ-বিদ্রোহে, বিজয় পরাজয়ে একত্র হয়ে তাদের নাগরিক জীবনের অস্তিত্বের একাত্মতা প্রকাশ করতে পারে, মনের মিল অমিল প্রকাশ করে সংযোগ স্থাপন করতে পারে প্রাণবন্ত সমাজ নগরের মূল স্নায়ু কেন্দ্রের সঙ্গে। একইভাবে রোম শহরে আছে এমন বহুসংখ্যক আরবান স্পেস বা প্লাজা। এর মধ্যে অন্যতম হলো Piazza Navona, Piazza Campo De’Fori, Piazza del Popolo প্যারিসে এমন প্লাজা আছে অনেক। এর মধ্যে বিখ্যাত হলো ফরাসি বিপ্লবের স্মৃতিবিজড়িত Place de la Concorde মাদ্রিদ শহরের এমন অনিন্দ্যসুন্দর বিখ্যাত প্লাজার নাম প্লাজা মেয়র নিউইয়র্কের আলোকজ্জ্বল প্রাণবন্ত টাইম স্কয়ারের কথা তো সবার জানা। কঠোর কমিউনিস্ট পার্টি শাসিত চীনেও প্রতিটি শহরেই এমন অনেক পাবলিক প্লাজা বা আরবান স্পেস আছে, এর মধ্যে বেইজিংয়ের নানজিং লু আর গুয়াঙ্গজুর বেইজিং লু পৃথিবী বিখ্যাত। কায়রোর তহরির স্কয়ার তো আরব বসন্তের জন্য এখন সারা বিশ্বের মানুষের কাছে অতিপরিচিত নাম; যেখানে প্রায় আড়াই লাখ মানুষ একত্রে সমবেত হতে পারে। আমাদের উপমহাদেশেরও পুরনো শহরগুলোয় এমন অনেক প্রাণবন্ত নাগরিক প্লাজা আছে, যা শত শত বছর ধরে সেই নগরের মানুষের প্রাণবন্ত কর্মযজ্ঞ আর উচ্ছ্বাস ধারণ করে সেই নগরের প্রাণকেন্দ্র হিসেবে নাগরিকদের সতত প্রাণশক্তির উৎস হয়ে টিকে আছে। এসব পাবলিক প্লাজার মধ্যে মোগল সম্রাট শাহজাহানের তৈরি দিল্লির চাঁদনি চক অন্যতম, যা ৪০০ বছর ধরে পুরনো দিল্লির মানুষের প্রাণচাঞ্চল্য, সীমাহীন কর্মযজ্ঞ জনমানুষের সাংস্কৃতিক আদান-প্রদানের প্রধান মিলন ক্ষেত্র। আরবান পাবলিক স্পেসের গুরুত্ব অনুধাবন করেই দিল্লির আম আদমি পার্টির বর্তমান সরকার নতুন করে পুরো চাঁদনি চক এলাকাটি গত বছর একটি বৃহৎ রেস্টোরেশন প্রকল্পের আওতায় নতুন করে সাজিয়েছে। চাঁদনি চকের মতোই আহমাদাবাদের মানেক চক, লাহোরের আনারকলি বাজার আজও একই রকম কর্মযজ্ঞে মত্ত একেকটি অতিপ্রাণবন্ত পাবলিক স্পেস; যা ওইসব নগরের মানুষের অস্তিত্বের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে অতীত অনাগত ভবিষ্যতের কোটি কোটি মানুষের আবেগ, উচ্ছ্বাস আর প্রাণে প্রাণ মেলানোর মিলনকেন্দ্র হিসেবে।

অন্যদিকে আমরা কী করছি? আমরা নিজেদের আধুনিক স্থপতি বলি, নানা রকম বাস্তব-অবাস্তব উন্নয়ন গল্পের আমরা কারিগর কিন্তু আমরা কি নগরের ধনী-গরিব সব শ্রেণীর জন্য সমানভাবে উন্মুক্ত সুগম্য এমন ইন্টারেক্টিভ বড় মাপের কোনো আরবান পাবলিক স্পেস তৈরি করেছি? যাও তৈরি করা হয়েছিল তাও আমরা দেয়াল বা লোহার বেড়া দিয়ে আটকে দিয়েছি। ছাত্রজীবনে আমরা বিকালে নিয়মিত সংসদ ভবন চত্বর বা সিঁড়িতে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আড্ডা দিতাম। তখন আমাদের জাতীয় মনস্তত্ত্বে নিরাপত্তা নিয়ে এত বিচিলিত ভাব ছিল না। আজ আমরা নিরাপত্তা নিয়ে বড় বেশি বিচলিত, তাই সংসদ ভবনের বিশাল চত্বর, যা ঢাকার সব শ্রেণীর জনসাধারণের জন্য একটা প্রাণবন্ত নাগরিক মিলনকেন্দ্র ছিল, তা আজ নাগরিকদের জন্য কঠিনভাবে আউট অব বাউন্ড মানিক মিয়া এভিনিউ আমরা বিশাল মিডিয়ান দিয়ে ছোট করে ফেলেছি। এককালে বাইতুল মোকাররম চত্বরে মানুষ এমনিই জমায়েত হতো, রাজনৈতিকভাবেও জমায়েত হতো, সেটাও আমরা কৌশলে ইসলামিক জাফরি ডিজাইনের বিশাল দেয়াল দিয়ে ঘিরে এর সুগম্যতা নষ্ট করে ফেলেছি। চারদিকে অসংখ্য নির্মাণের ধাক্কায় এককালের পল্টন ময়দান এখন তো এক ফালি জমিন মাত্র, তার সেই প্রাণচাঞ্চল্য অনেক আগেই ছিনতাই হয়ে গেছে।

আসলে ধরনের ইন্টারেক্টিভ স্পেস হচ্ছে একেকটি জীবন্ত নগরের প্রাণ। আরবান স্পেসগুলোকেই কেন্দ্র করে নগরের মানুষ প্রকৃত প্রাণবন্ত নাগরিক হয়ে ওঠে। এগুলোর অবর্তমানে নগরগুলো হয়ে ওঠে কংক্রিটের পরিকল্পিত পরিপাটি মর্গ, যেখানে নাগরিকরা অনেকটা মৃত মানুষের মতো। ঢাকা শহরে যদিও বেশকিছু পার্ক আছে, তবে একটা জিনিস মনে রাখতে হবে পার্ক বা জলাধারকে ঘিরে গড়ে তোলা নিসর্গ স্থাপত্য আর কর্মযজ্ঞে ভরপুর, প্রাণচাঞ্চল্যে জীবন্ত আরবান পাবলিক স্পেস এক বিষয় নয়। আমার মতে, সেই অর্থে ঢাকা শহরের একটি মাত্র ছোট আংশিক প্রাণবন্ত স্পেস আছে, যেটা শুধু এক মাসের জন্য কার্যকর থাকে। আর সেটি হচ্ছে বাংলা একাডেমির একুশে বইমেলা; যেখানে অর্ধেকের বেশি মানুষ বই কিনতে নয়, বরং সেখানে যায় মানুষের সঙ্গে মানুষের মিলনের আকাঙ্ক্ষায়। সে জানে সময় পেলেই একাধিকবার সেখানে যাওয়া যাবে, কারো না কারো সঙ্গে তার দেখা হয়েই যাবে। দেখা যদি নাও হয়, তবুও সেখানে আছে নানা রকম খাবারের আয়োজন আর নানা রকম কর্মকান্ড, তাই সেখানে গিয়ে আবার নতুন করে নিজেকে একাত্ম করা যায় নগরের আত্মার সঙ্গে। আরবান স্পেসের সে একই নাগরিক তৃষ্ণা মেটাতে নিম্নবিত্ত থেকে উচ্চবিত্তের মানুষ দলে দলে ভিড় জমায় বাণিজ্যমেলায়, যেখানে তারা দ্বিগুণ দাম দিয়ে অপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনেও মহা আনন্দে উপভোগ করে। কেননা সেখানে গিয়ে তারা তাদের নিজেদের আত্মার সঙ্গে নগরের আত্মার সংযোগ ঘটাতে পারে।

আসলে আমাদের দেশের অধিপতি শ্রেণী সাধারণ মানুষকে ভয় পায়। সাধারণ মানুষের কোথাও একত্রে মিলিত হওয়ার সম্ভাবনাকে তারা তাদের জন্য ত্রাসের চোখে দেখে। মধ্যযুগের অনির্বাচিত নৃপতিরা যে জনসম্পৃক্ত স্থাপত্য গড়তে পেরেছেন, তথাকথিত গণতান্ত্রিক আর আধুনিক অধিপতিরা তা করতে ভয় পান, তাই দেশে গত ৭৫ বছরেও তেমন কোনো বড় মাপের ইন্টারেক্টিভ আরবান স্পেস গড়ে ওঠেনি বা উঠতে দেয়া হয়নি। আর আমরা স্থপতিরাও বুঝে বা না বুঝে বা বাধ্য হয়ে এই জনবিমুখ প্রক্রিয়ায় সংযুক্ত হয়ে আছি যুগের পর যুগ। এটা একটা বড় মাপের প্যারাডক্স। তবে যদি আমাদের ঢাকাসহ অনান্য শহরে এখন বড় মাপের আরবান প্লাজা বা স্পেস তৈরি করা না- যায়, তবুও সরকার, প্রশাসন সংশ্লিষ্ট পেশাজীবীদের মিলিত সদিচ্ছা থাকলে আমাদের নগরগুলোর বিভিন্ন পয়েন্টে জমি অধিগ্রহণ করে ছোট ছোট আরবান স্পেস গড়ে তোলা সম্ভব। ধরনের ছোট ছোট এলাকাভিত্তিক অনেক সুন্দর সুন্দর আরবান স্পেস আছে রোম, ফ্লরেন্স, মিলান, লিসবন, ব্রাসেলসসহ ইউরোপের প্রায় সব পুরনো শহরেই। এশিয়ার সিউল, ওসাকা, গুয়াংজু, বেইজিং, অন্যদিকে কায়রো, বৈরুত, দামেস্কসহ, পুরনো সব আরব শহরেও এমন এলাকাভিত্তিক ছোট ছোট আরবান স্পেস শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে শহরগুলোর নাগরিকদের আত্মার মিলনকেন্দ্র হিসেবে প্রাণবন্তভাবে টিকে আছে।

যা দিয়ে শুরু করেছিলাম, আবার চারমিনারেই ফিরে আসি। চারমিনারের পাশেই বিশাল উন্মুক্ত চত্বর সামনে রেখে প্রায় সোয়া ৩০০ বছর আগে তৈরি করা হয়েছে মক্কা মসজিদ। এটাও চারমিনারের পুরো মাস্টারপ্ল্যানে অন্তর্ভুক্ত। মোহাম্মদ কুলি কুতুব শাহ মসজিদের কাজ শুরু করলেও তিনি তা শেষ করে যেতে পারেননি। পরবর্তী সময়ে মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেব হায়দরাবাদ বিজয়ের পর মসজিদের কাজ শেষ করেন, ততদিনে প্রায় ৮০ বছর পার হয়ে গিয়েছে। বলা হয়, মসজিদের বেসিক স্ট্রাকচারের জন্য যেসব ইট ব্যবহার করা হয়েছে, তার সব মাটি আনা হয়েছে মক্কা থেকে।

মসজিদের একপাশে হায়দরাবাদের বিখ্যাত নিজামদের কিছু কবর আছে। মসজিদের সামনে উঁচু দুর্গের ফটকের মতো বিশাল পুরু কাঠের গেট। গেটে বসে আছে অস্ত্রধারী অনেক পুলিশ, কেননা ২০০৭ সালে মসজিদে সন্ত্রাসী বোমা হামলায় ১৩ জন মানুষ নিহত হয়েছিল। গেট পেরুলেই বিরাট চৌকোনা জলাধার আর মাঝে ফোয়ারা। হাজার হাজার কবুতর জলাধার থেকে পানি খাচ্ছে। জলাধারকে ঘিরে খুব সুন্দর একটা পাবলিক স্পেস। পাবলিক স্পেসে যে শুধু মুসল্লিরা জমায়েত হচ্ছে তা নয়, বরং এটাকে একটা সেক্যুলার আরবান স্পেস বলা যায়। নানা বয়সের নারী-পুরুষ আর শিশুরা এখানে ঘোরাঘুরি করছে। মসজিদের উত্তর-পূর্ব দিকে চারমিনার, সেখানের বিশাল চত্বর থেকে ঠাণ্ডা বাতাস বয়ে চলেছে আর মসজিদ প্রাঙ্গণে জমায়েত হওয়া শত শত নারী-পুরুষ গ্রানাইটের বেঞ্চের মতো স্থাপনায় বসে বসে সন্ধ্যাটা উপভোগ করছে।

কভিডকালে আমি জামাতে নামাজ পড়া এড়িয়ে চলেছি, এখন ভিনদেশে এসে মসজিদ চত্বরের ভেতর বসে কী করে নামাজ না পড়ে বের হই। সেই কবে সোয়া ৩০০ বছর আগে কুলি কুতুব শাহ নামের এক সুলতান, যার নামই আমি ঠিকমতো শুনিনি কোনো দিন, যিনি খুব যত্ন করে মসজিদটি বানিয়েছিলেন, আমি কী করে তার মসজিদে নামাজ না পড়ে যাই। আমার মনে হচ্ছিল তার এত যত্নে গড়া মসজিদে এক ওয়াক্ত নামাজ না পড়ে চলে গেলে ওনার অসম্মান হবে। ভেবে দেখলাম, যা হয় হবে, আমি নামাজের জন্য মূল মসজিদ ভবনের দিকে আস্তে আস্তে অগ্রসর হলাম। মসজিদটি যদিও দশ হাজার নামাজি ধারণক্ষম, তবে নামাজ পড়তে গিয়ে দেখলাম নামাজির সংখ্যা খুবই কম। বড়জোর তিন কাতার। তার মানে মসজিদ চত্বরে জমায়েত হওয়া নারী-পুরুষের অধিকাংশই এটাকে আরবান স্পেস হিসেবে ব্যবহার করছেন।

এক নামাজি খুব চোস্ত হায়দরাবাদি আদাবের সঙ্গে আমাকে সামনের কাতারে ঠেলে দিলেন। নামাজ পড়ার পর বসে বসে আমি ভাবছিলাম সেই কত শত বছর আগে এক সুলতান আর নাম না জানা এক স্থপতি মসজিদটি বানিয়েছিলেন, হাজার হাজার মিস্ত্রি আর শ্রমিক এর নির্মাণকাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন, আর আজ বাংলাদেশ থেকে আসা আমার মতো একজন অচেনা অখ্যাত মানুষ মসজিদের মেঝেতে কপাল ঠেকিয়ে সেই সোয়া ৩০০ বছর আগের সবার সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করলাম। এভাবেই মানুষ মরে গেলেও সে সম্পূর্ণ নিঃশেষ হয়ে যায় না। মানুষ তার কর্ম আর কীর্তির মাধ্যমে শত শত বছর পরের প্রজন্মের সঙ্গেও সম্পর্ক স্থাপন করতে পারে। সম্পর্কের কী নাম দেব আমি জানি না। শুধু এতটুকু বুঝতে পারি ভালো স্থাপত্য বা ভালো শিল্প শত শত বছর পরেও অজস  মানুষের সঙ্গে অজস  মানুষের সম্পর্ক স্থাপন করিয়ে দিয়ে নতুন করে করে প্রাণবন্ত করে রাখতে পারে আমাদের জীবন এবং চিন্তা স্বপ্নের জগৎ। কবে আমার নগরে এমন একটি আরবান স্পেস আমি পাব, যেখানে বসে বসে এমনভাবেই আমি আমাকে প্রতিনিয়ত আবার নতুন করে আবিষ্কার করতে পারব আর সংযুক্ত থাকতে পারব আমার নগরের আত্মার সঙ্গে।

 

মাহফুজুল হক জগলুল: স্থপতি, ফেলো আইএবি

আরও