সময়ের ভাবনা

সাধারণের মানসিকতা ও উৎসব অর্থনীতির পোয়াবারো

বাংলাদেশ উৎসব-পার্বণের দেশ। বলা হয় বাঙালিদের বারো মাসে তেরো পার্বণ। কথাটি একেবারেই অতিশয়োক্তি নয়। প্রতিটি ধর্মের মানুষের রয়েছে স্বতন্ত্র উৎসব। মুসলমানদের ঈদুল ফিতর, ঈদুল আজহা, শবেবরাত, শবেকদর, শবেমেরাজ ইত্যাদি। আবার রোজার মাসেও তারা উৎসবমুখর থাকে। ঠিক তেমনি হিন্দুদের দুর্গা পূজা, দীপাবলি, পাঁঠাবলি ইত্যাদি ধর্মীয়

বাংলাদেশ উৎসব-পার্বণের দেশ। বলা হয় বাঙালিদের বারো মাসে তেরো পার্বণ। কথাটি একেবারেই অতিশয়োক্তি নয়। প্রতিটি ধর্মের মানুষের রয়েছে স্বতন্ত্র উৎসব। মুসলমানদের ঈদুল ফিতর, ঈদুল আজহা, শবেবরাত, শবেকদর, শবেমেরাজ ইত্যাদি। আবার রোজার মাসেও তারা উৎসবমুখর থাকে। ঠিক তেমনি হিন্দুদের দুর্গা পূজা, দীপাবলি, পাঁঠাবলি ইত্যাদি ধর্মীয় উৎসব। বৌদ্ধদের প্রবারণা পূর্ণিমাসহ বিভিন্ন পূর্ণিমায় উৎসব করে ধর্মীয় সম্প্রদায়টি। আমাদের দেশে খ্রিস্টানদের সংখ্যা তুলনামূলক কম। তথাপি, ক্রিসমাস ডে, ইস্টার সানডেসহ ধর্মীয়ভাবে গুরুত্বপূর্ণ দিনগুলোতে তারা উৎসবে মাতে। আবার জাতীয় উৎসবের মধ্যে আছে পহেলা বৈশাখ, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস ইত্যাদি।

উৎসবে অংশগ্রহণ করে না এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া ভার। ব্যতিক্রম থাকতেই পারে। তবে তা ধর্তব্য নয়। আর মানুষের এ উৎসবপ্রবণতাকে পুঁজি করেন ব্যবসায়ীরা। ফলে উৎসবকে ঘিরে গড়ে উঠেছে এক বৃহৎ অর্থনীতি। একে ‘উৎসব অর্থনীতি’ হিসেবে আখ্যা দেয়া যেতে পারে। ধর্মীয় ও জাতীয় মূল্যবোধের কারণে মানুষ উৎসব পালন করে। এটি হলো ‘ম্যানিফেস্টো’। কিন্তু তাদের উৎসব পালনের কারণে যে অর্থনীতি তৈরি হচ্ছে, সেটি হলো ‘ল্যাটেন্ট’। উৎসবপ্রীতির কারণে এই যে বৃহৎ একটি অর্থনীতি তৈরি হচ্ছে, সে বিষয়ে তারা হয়তো সচেতনই না। 

ধর্মীয় উৎসবের সঙ্গে মানুষের আবেগ জড়িত। জাতীয় উৎসবের ক্ষেত্রেও আবেগের কমতি নেই। রোজার মাসে সারা দিন উপোস থাকে মুসলমানরা। ইফতারিতে তাই সাধারণ সময়ের চেয়ে একটু বেশি ও ভালো খাবার খেতে চায় তারা। সাহরিতেও অন্য সময়ের তুলনায় খাবারের মান ভালো রাখতে চায় মুসলমানরা। উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্তরা তো বটেই, একেবারে যে নিম্নবিত্ত দিনমজুর, সেও ইফতারি ও সাহরিতে একটু অতিরিক্ত ব্যয় করতে দ্বিধা করে না। ফলে রমজান মাসে পণ্যবাজার অন্য সময়ের তুলনায় অনেক বেশি চাঙ্গা থাকে। অর্থনৈতিক প্রবাহ হয় অনেক বেশি। রোজাদারদের এ মানসিকতাকে কাজে লাগায় ব্যবসায়ী। তারা বুঝতে পারে, দাম বাড়লেও এ মাসে মানুষ ধার করে হলেও ঘি খেতে পিছপা হবে না। তাই তারা ইচ্ছামতো দাম বাড়াতে ন্যূনতম দ্বিধা করে না। বাংলাদেশে প্রতি রমজানে দ্রব্যমূল্য অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যাওয়ার পেছনে রোজাদারদের এমন মানসিকতা অন্যতম একটি কারণ। ব্যবসায়ীরা সফলভাবে এটিকে কাজে লাগায়।

এক মাস সিয়াম সাধনার পর আসে ঈদুল ফিতর। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে এটি গুরুত্বপূর্ণ একটি উৎসব। তবে অধিকাংশ মানুষের কাছে যেন ঈদ মানেই নতুন পোশাক, ভালো খাবার আর বন্ধুদের নিয়ে ঘোরাঘুরি। ফলে রোজা শুরু হওয়ার পর থেকে চাঁদরাত পর্যন্ত শপিং মলগুলোতে থাকে উপচে পড়া ভিড়। ব্যবসায়ীরাও সারা বছর এ মাসটির জন্য অপেক্ষা করে থাকেন। একটি কথা প্রচলিত আছে, কাপড় ব্যবসায়ীরা ঈদের মৌসুমেই সারা বছরের মুনাফা তুলে নেন। বাকি এগারো মাস টুকটাক বিক্রি করে কোনো রকমে দোকান ভাড়া ও আনুষঙ্গিক খরচটা তুলে আনতেই পারলেই হলো। ঈদের মৌসুমে অন্যান্য সময়ের তুলনায় পোশাকের দাম অনেক বেশি থাকে। কিন্তু তাতে খুব একটা পরোয়া করে না খদ্দেররা। কারণ এ সময়েই নতুন নতুন মডেলের পোশাক বাজারে নিয়ে আসেন ব্যবসায়ীরা। স্বতন্ত্র হওয়ার একটি বাসনা সবার মধ্যে কাজ করে। তাই তারা চায় বেশি দাম দিয়ে হলেও ভিন্ন কিছু কেনার। একই ডিজাইনের পাঞ্জাবি বা শাড়ি একই এলাকার অন্য কারো শরীরে দেখলে অনেকেরই মন খারাপ হয়ে যায়। তাই ঈদের মৌসুমে ফ্যাশন হাউজ ও ব্র্যান্ডগুলোর তৎপরতা অনেক বেড়ে যায়। আকর্ষণীয় বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে ক্রেতাদের নজর কাড়তে রীতিমতো প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয় তারা। তাছাড়া বিভিন্ন অঙ্গনের সেলিব্রিটিদের নামেও পোশাক আসে ঈদের বাজারে। উদ্দেশ্য একটাই। খদ্দের ধরা। এ তো গেল পোশাকের কথা। এবার আসা যাক সাজসজ্জার ব্যাপারে। এক্ষেত্রে আগে থেকেই নারীদের আধিপত্য বিরাজমান। বিউটি পার্লারগুলোতে জমজমাট ভিড় লেগে যায় ঈদের কয়েকদিন আগে থেকেই। মাথার চুল থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত সবেতেই যেন নতুনত্বের ছোঁয়া দিতে হবে। সাজসজ্জার দিক থেকে পুরুষরাও এখন আর কোনো অংশে পিছিয়ে নেই। ফলে মোড়ে মোড়ে গড়ে উঠেছে জেন্টস পার্লার। ফ্যাশন ডিজাইনাররা ছেলেদের চুলের ছাঁট, দাড়ির স্টাইল ইত্যাদি নিয়ে প্রতিনিয়ত গবেষণা করছেন। সবকিছুর পেছনে একটাই লক্ষ্য মুনাফা বাড়ানো। তারপরে আসে খাওয়াদাওয়া। ঈদে প্রতি ঘরে বিশেষ খাবারের আয়োজন করাটা দীর্ঘদিনের প্রথা। তবে কিছুদিন আগেও ঈদের বিশেষ আয়োজন বলতে ছিল কেবল সেমাই। কিন্তু বর্তমানে সেখানে এসেছে ব্যাপক বৈচিত্র্য। এখানেও সেই একই মানসিকতা। অন্যের চেয়ে আমার বানানো খাবারটা যেন স্বতন্ত্র হয়। বিষয়টি বর্তমানে এতদূর গড়িয়েছে যে এক খাবার এক ঘরে খেলে অন্য ঘরে গিয়ে সেই একই খাবার খেতে চায় না অতিথিরা। ফলে ঈদে খাবারের আয়োজনকে বাহারি ও বৈচিত্র্যময় করতে বিপুল অর্থ ব্যয় করে বাঙালি মুসলমানরা। এতে পকেট ভারী হয় ব্যবসায়ীদের। এখানে অন্যতম উদাহরণ হিসেবে ঈদুল ফিতরকে নেয়া হলো। এছাড়া শবেমেরাজ, শবেবরাত, শবেকদর, ঈদুল আজহায়ও মুসলমানরা অন্য সময়ের তুলনায় অনেক বেশি অর্থ ব্যয় করে। অন্য ধর্মাবলম্বীদের উৎসবগুলোতেও এরই নিরেট অনুকরণ।

পহেলা বৈশাখ, ভ্যালেন্টাইনস ডে ইত্যাদি ধর্মনিরপেক্ষ উৎসবে পোশাক ব্যবসায়ীদের পোয়াবারো। প্রতিটি উৎসবের জন্য আলাদা থিমের পোশাক ডিজাইন করেন ফ্যাশন ডিজাইনাররা। আর সেসব পোশাক না কিনলে যেন উৎসবের আনন্দটাই মাটি। লাল শাড়ি ও পাঞ্জাবি যেন পহেলা বৈশাখের প্রতীকে পরিণত হয়েছে। পাশাপাশি কাপলদের জন্য বিশেষ পোশাকের ডিজাইন বাজারে আসে। 

ধর্মীয় ও জাতীয় উভয় ধরনের উৎসবে কর্মীদের উৎসব ভাতা দেয়ার রীতি চালু আছে প্রায় সব প্রতিষ্ঠানে। আবার যাদের তেমন সুবিধা নেই, তারা ওভারটাইম কিংবা অন্য কোনো উপায়ে বাড়তি অর্থের বন্দোবস্ত করে নেন। আর সেসব বাড়তি টাকা খরচ হয় ভোগ্যপণ্য ক্রয়ে। অনেকে সঞ্চয় তহবিলেও হাত দিতে বাধ্য হন। 

পুঁজিবাদের চমৎকার একটি বৈশিষ্ট্য আছে, যা অন্য কোনো মতবাদ বা দর্শনের ক্ষেত্রে পরিলক্ষিত হয় না। তা হলো পুঁজিবাদের কোনো গোড়ামি নেই। নিজের স্বার্থে সে সবকিছুকেই গ্রহণ করে। বস্তুগত ও ভাবগত সবকিছুকেই পণ্যে পরিণত করার এক অসাধারণ ক্ষমতা আছে পুঁজিবাদের। আর পুঁজিবাদের ধারক ও বাহক হলেন ব্যবসায়ীরা। তাদের কাছে প্রতিটি উৎসব মানেই মুনাফার সম্ভাবনা। মানুষের আবেগ-অনুভূতিকে তারা সার্থকভাবে অর্থে রূপান্তর করেন। সব মিলিয়ে তৈরি হয়েছে বিপুলাকার উৎসব অর্থনীতি। এর একদিকে সাধারণ মানুষের মানসিকতা। অন্যদিকে তা কাজে লাগাতে ব্যবসায়ীদের নিত্যনতুন কৌশল। আর এভাবেই সমাজবিজ্ঞানী রবার্ট কে মার্টনের কথা অনুসারে, উৎসব পালনের ‘ম্যানিফেস্টো’ থেকে ‘ল্যাটেন্ট’ হিসেবে তৈরি হচ্ছে উৎসব অর্থনীতি। যেটি সম্পর্কে সাধারণ ক্রেতাদের স্পষ্ট কোনো ধারণা নেই।

নিজাম আশ শামস: সাংবাদিক

আরও