বৈষম্য শব্দটি আমাদের সবার খুবই পরিচিত। বাংলাদেশের সমাজে বৈষম্য বিভিন্ন ক্ষেত্রে আমরা লক্ষ করি। শুধু অর্থনৈতিক ক্ষেতেই নয়, সমাজ ও রাজনীতিসহ সব ক্ষেত্রেই বৈষম্য বিরাজমান। অর্থনৈতিক বৈষম্যের কথা বললে শুরুতেই আসবে আয়বৈষম্য। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০২২ সালের তথ্যে দেখা যাচ্ছে, আয়বৈষম্য বেড়ে দশমিক ৪৯ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। অর্থনীতির ভাষায় বলা যায়, অতি বৈষম্য আয়সম্পন্ন দেশে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশে সম্পদের বৈষম্য আরো বেশি। সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে বিশেষ করে করে শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ বিভিন্ন গোষ্ঠীর প্রবেশাধিকারে বৈষম্য, নারী-পুরুষের মধ্যে বৈষম্য বিদ্যমান। তবে উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে প্রতিটি ক্ষেত্রেই বৈষম্য বৃদ্ধি পাচ্ছে। এক কথায় বলতে পারি, আজকে যে সমাজে বসবাস করছি, এ সমাজে বৈষম্য স্বাধীনতা-পরবর্তী যেকোনো সময়ের তুলনায় অত্যন্ত বেশি। সবচেয়ে বৈষম্যপূর্ণ সমাজে এখন বসবাস করছি। কিন্তু বেশি বৈষম্য বা বৈষম্যের বৃদ্ধি সেটা কিন্তু অবধারিত ছিল না। বাংলাদেশের আশপাশের দেশগুলো, বিশেষ করে পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর দিকে লক্ষ করলে দেখা যাবে, সেসব দেশ বাংলাদেশের তুলনায় দ্রুত গতিতে উন্নয়ন করেছে, কিন্তু বৈষম্য সেসব দেশে এতটা বৃদ্ধি পায়নি। বৈষম্য কম রেখেও আমরা কিন্তু দ্রুত গতিতে উন্নয়ন করতে পারতাম।
- তাহলে প্রধান প্রশ্ন হচ্ছে, বিদ্যমান বৈষম্য দূর করতে আমাদের করণীয় কী? এক্ষেত্রে দুটি জিনিস গুরুত্বপূর্ণ মনে করছি। প্রথমত, আয়বৈষম্য (ইনইক্যুয়ালিটি ইন আউটকামস)। এ বৈষম্য দূর করার জন্য বিভিন্ন পদ্ধতি আছে। যেমন প্রগ্রেসিভ ইনকাম ট্যাক্স (অগ্রসর আয়কর নীতি)। কিন্তু বাংলাদেশে যারা আয়কর দেন তাদের সংখ্যা খুবই কম। ফলে এর মাধ্যমে খুব বেশি সম্পদের পুনর্বণ্টন হয় না। কিন্তু বিশ্বের অনেক দেশে আয়কর প্রদানের মাধ্যমে সম্পদের পুনর্বণ্টন করা সম্ভব। যতক্ষণ পর্যন্ত বাংলাদেশের কর ব্যবস্থাপনার পরিবর্তন না করা হবে ততক্ষণ পর্যন্ত প্রগ্রেসিভ ইনকাম ট্যাক্সের মাধ্যমে সম্পদের পুনর্বণ্টনের সুফল পাওয়া যাবে না। এছাড়া আরো অনেক পদ্ধতি আছে। যেমন দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে সহায়তা প্রদান।
- দ্বিতীয়ত, আমি মনে করি আমাদের এখানে জোর দেয়া উচিত ইনইক্যুয়ালিটি ইন অপরচুনিটিজ বা সুযোগের ক্ষেত্রে বৈষম্য কমানোয়। সুযোগের বৈষম্যের কারণেই কিন্তু বাংলাদেশে বিভিন্ন ধরনের বৈষম্য সৃষ্টি হচ্ছে। কাজেই বৈষম্য সৃষ্টির উৎসে আমাদেরকে হাত দিতে হবে। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের নীতি কাঠামো ও অর্থনীতির মূল ধারার পরিবর্তন করা দরকার। বাংলাদেশে এতদিন যেভাবে উন্নয়ন করা হয়েছে সেই উন্নয়ন বৈষম্য কমানোয় সহায়ক নয়। কাজেই বাংলাদেশকে নতুন ধারার উন্নয়ন সূচনা করতে হবে। সেখানে অন্তর্ভুক্তীমূলক উন্নয়নকে মূল চালিকাশক্তি হিসেবে গ্রহণ করতে হবে।
- উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে যে সুযোগগুলো সৃষ্টি হচ্ছে, এ সুযোগগুলোর প্রবেশাধিকার যাতে সামগ্রিকভাবে যারা সুবিধাভোগী শ্রেণী তাদের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে সবার মধ্যে ছড়িয়ে যেতে পারে সেদিকে দৃষ্টি দিতে হবে। অর্থাৎ এমন একটি কাঠামোগত পরিবর্তন করতে হবে যাতে শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ প্রতিটি ক্ষেত্রে যে বৈষম্য বিদ্যমান রয়েছে সেই বৈষম্যগুলো দূর করতে এবং উন্নয়নের একটি নতুন ধারা সূচনা করতে পারি। এর মাধ্যমেই কিন্তু বৈষম্য সৃষ্টিকে বন্ধ করতে পারব এবং আমরা এমন একটি সমাজ নির্মাণ করতে পারব, যেখানে সবার স্বাধীনতা সুনিশ্চিত হবে ও সুযোগের সমতা সুরক্ষিত হবে। আমাদের বিদ্যমান সংবিধানে যে আকাঙ্ক্ষা বিধৃত আছে কিংবা ৫ আগস্টের পটপরিবর্তন যে স্বপ্নের জন্ম দিয়েছে সেই বৈষম্যহীন সমাজ তৈরি সম্ভবপর হবে। এর মাধ্যমে একটি সমৃদ্ধ ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গড়ে তুলব বাংলাদেশে। তাই উন্নয়ন চিন্তাধারাকে পরিবর্তন করতে হবে এবং এর মাধ্যমেই বৈষম্যকে নিরসন করে উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য অর্জন করতে সক্ষম হব।
ড. মুস্তফা কে মুজেরী: নির্বাহী পরিচালক, ইনস্টিটিউট ফর ইনক্লুসিভ ফাইন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (আইএনএম)
[১১ নভেম্বর বণিক বার্তা আয়োজিত ‘বৈষম্য, আর্থিক অপরাধ ও বাংলাদেশের অর্থনীতির নিরাময়’ শীর্ষক তৃতীয় বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সম্মেলন ২০২৪-এ প্যানেল আলোচকের বক্তব্য]