মানুষের ক্ষমতা বাড়ানোর স্বার্থে রাষ্ট্রের ক্ষমতা সীমাবদ্ধ করা চাই

আমরা খুবই আনন্দিত। কারণ ১০ বছর ধরে আমরা যে চেষ্টা করেছি সেটির প্রথম পর্যায়ের সফলতা এখন দৃশ্যমান হয়েছে। আতঙ্কিত বোধ করার কোনো কারণ তো নেই; আমাদের আশা ও আস্থা অনেক বেড়েছে। আমরা খুবই আনন্দিত এবং গর্বিত বোধ করি এজন্য যে এ কাজটা আমরা শুরু করতে পেরেছিলাম। মানুষ এতদিন যেটার প্রয়োজনীয়তা বোধ করত সেটার ভাষা আমরা ধরিয়ে দিতে পেরেছি।

হাসনাত কাইয়ুম, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক, রাষ্ট্রচিন্তার প্রতিষ্ঠাতা ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী। রাজনৈতিক জীবনের শুরুতে ছাত্র ফেডারেশনের প্রতিষ্ঠাকালীন সহসভাপতি ও বাংলাদেশ লেখক শিবিরের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন। তার দল রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন, সাতদলীয় জোট—গণতন্ত্র মঞ্চের অন্যতম সদস্য। রাষ্ট্র সংস্কার, রাজনৈতিক বন্দোবস্ত ও সাম্প্রতিক নানা প্রসঙ্গ নিয়ে কথা বলেছেন বণিক বার্তায়। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সাবিদিন ইব্রাহিম

রাষ্ট্র সংস্কার নিয়ে আপনারা দীর্ঘ প্রায় এক দশক ধরে কাজ করছেন। গত ৫ আগস্টের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর এখন সব মহলে রাষ্ট্র সংস্কার নিয়ে অনেক কথা উঠছে। বিষয়টি বর্তমানে জনসাধারণের মনের ও মুখের খুবই পরিচিত বুলিতে পরিণত হয়েছে। এটাকে আপনি কীভাবে দেখছেন, আপনারা কি কোনো ধরনের আশঙ্কা বোধ করছেন?

আমরা খুবই আনন্দিত। কারণ ১০ বছর ধরে আমরা যে চেষ্টা করেছি সেটির প্রথম পর্যায়ের সফলতা এখন দৃশ্যমান হয়েছে। আতঙ্কিত বোধ করার কোনো কারণ তো নেই; আমাদের আশা ও আস্থা অনেক বেড়েছে। আমরা খুবই আনন্দিত এবং গর্বিত বোধ করি এজন্য যে এ কাজটা আমরা শুরু করতে পেরেছিলাম। মানুষ এতদিন যেটার প্রয়োজনীয়তা বোধ করত সেটার ভাষা আমরা ধরিয়ে দিতে পেরেছি। 

রাষ্ট্র সংস্কারের প্রয়োজন তো অনেক ব্যাপক। সেক্ষেত্রে কোন কোন বিষয়গুলো সংস্কারের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার পাওয়া উচিত?

আমার মতে, এক্ষেত্রে পুরো বিষয়টিকে আমরা দুই ভাগ করে আমরা ভাবতে পারি। এক ভাগ হলো মৌলিক সংস্কার বা কাঠামোগত সংস্কার। আরেকটি হলো উপরিকাঠামোগত ও পরিপূরক কিছু সংস্কার। উদাহরণ হিসেবে বলতে পারি, প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের যে স্যার সম্বোধনের বাধ্যবাধকতা আছে সেটা দূর করে নাগরিকদের স্যার ডাকার বাধ্যবাধকতা সৃষ্টি।

আর মৌলিক পরিবর্তন বলতে ধরা যায়, নির্বাচন ব্যবস্থার পরিবর্তন বা সংস্কার। আমাদের সংবিধানের ১২৩(৩) অনুচ্ছে অনুযায়ী, যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে তাদের অধীনেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। সেজন্য নির্বাচন করে কখনো ক্ষমতাসীনদের হারানো সম্ভব হয় না। সংবিধান অনুযায়ীই রাষ্ট্রের যাবতীয় ক্ষমতা সরকারের কেন্দ্রীয় ব্যক্তি বা প্রধানমন্ত্রীর কাছে কেন্দ্রীভূত থাকে এবং তার কোনো প্রকার জবাবাদিহির ব্যবস্থা নেই। এ অসীম ক্ষমতা সরকারের একক ব্যক্তির কুক্ষিগত থাকা অবস্থায় নির্বাচন করে ক্ষমতাসীন দলকে বাংলাদেশের ইতিহাসে আজ পর্যন্ত হারানো যায়নি। একমাত্র তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে আমাদের দেশে যেসব নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে, সেসব নির্বাচনে ক্ষমতায় ছিল এমন দল ক্ষমতা হারিয়েছে। সুতরাং এ জায়গাটিতে একটি কাঠামোগত সংস্কার প্রয়োজন। এ দুই ধরনের সংস্কারের মধ্যে বাংলাদেশে আমরা এখন মৌলিক কাঠামো পরিবর্তনের জায়গাগুলো যেমন সংসদ, বিচার বিভাগ, পুলিশ প্রশাসন, অর্থনৈতিক খাত, স্থানীয় সরকার, মৌলিক অধিকার—এসব ক্ষেত্র চিহ্নিত করে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা কাঠামোর মৌলিক সংস্কারের কথা বলি।

আপনারা এ মৌলিক কাঠামো পরিবর্তনে বেশ আগে থেকেই কথা বলে আসছেন। এ নিয়ে যদি আরেকটু বিস্তারে বলতেন। 

আমরা বাংলাদেশের সংবিধানের স্ববিরোধিতা নিয়ে ২০১৩ সাল থেকে কথা বলে আসছি। আমরা ২০১৬ সাল থেকে প্রথমে ‘রাষ্ট্রচিন্তা’ জার্নাল ও রাষ্ট্রচিন্তা সংগঠন গড়ে তুলেছি এবং আমাদের সাত দফা সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে  ২০১৬ থেকেই কাজ করে আসছি; ২০১৮ সাল থেকে যেটা আমরা আনুষ্ঠানিকভাবে জাতির সামনে তুলে ধরেছি। এ সাত দফা রাজনৈতিকভাবে বাস্তবায়নের জন্য আমরা ২০২১ সাল থেকে ‘রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন’ নামে সংগঠন নিয়ে আমরা রাজনীতির মাঠে নেমেছি। এ সাত দফা হলো আমাদের মূল ইশতেহার, তার একটি দফা হলো আমরা নির্বাচন ব্যবস্থাকে সংস্কার করতে চাই। তাছাড়া আমরা ভোট ব্যবস্থারও সংস্কার করতে চাই, এখানে বর্তমান পদ্ধতির পাশাপাশি সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতি চালু করে একটি মিশ্র পদ্ধতির প্রস্তাব আমরা দিয়েছি। যেমন এক ভোট বেশি পেলেই একজন নির্বাচিত হয় আর বাকি সব প্রার্থী মিলে বিজয়ী প্রার্থীর চেয়ে বেশি ভোট পেলেও সেসব ভোটদাতা প্রতিনিধিহীন হয়ে পড়ে। নাগরিকদের প্রদত্ত ভোট যাতে এভাবে অকার্যকর বা নষ্ট না হয়ে পড়ে, সেজন্য আমরা সংখ্যানুপাতিক ভোট ব্যবস্থা চাই। আমরা সংসদ বা আইনসভাকেও সংস্কার করতে চাই, যার অন্যতম হলো সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদের পরিবর্তন করে সংসদ সদস্যদের সত্যিকারের জনপ্রতিনিধিতে পরিণত করতে চাই, জনগণের ভোটে নির্বাচিত সংসদ সদস্যরা দলীয় প্রধানের প্রতিনিধিতে পরিণত হওয়ার বিদ্যমান ব্যবস্থার পরিবর্তন চাই। সংসদে যাতে জবাবদিহিতা ফেরত আসে সেজন্য সংসদীয় কার্যপ্রণালি বিধিকে গণতান্ত্রিক করতে চাই। এ বিধির কারণে সংসদ সরকারি দলের নিয়ন্ত্রণে থাকে, বিরোধী দল কোনো ভূমিকা রাখতে পারে না। আমরা চাই সংসদীয় কমিটিগুলোর প্রধান হবেন বিরোধী দল থেকে এবং কমিটির ক্ষমতা আরো বাড়াতে চাই। এ দুটি বিষয়ের পাশাপাশি আমরা চাই যে সংসদ নেতা আর ক্ষমতাসীন দলের প্রধান একই ব্যক্তি না হয়ে আলাদা ব্যক্তি হবেন।

সংসদ সদস্যদের প্রধান কাজ কী? আইন প্রণয়ন যদি তাদের প্রধান কাজ হয় তাহলে আসনের সব উন্নয়ন প্রকল্প ও যাবতীয় ইস্যুতে তাদের খবরদারি কীভাবে প্রশমন করা যায়?

আইন প্রণয়নই সংসদ সদস্যদের প্রধান কাজ, কিন্তু এটাকে একমাত্র কাজে সীমাবদ্ধ করতে হবে। সংসদ সদস্যরা আইন প্রণয়নের বাইরে যাতে কোনো উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বা রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে ভূমিকা রাখতে না পারেন তা নিশ্চিত করতে হবে। অর্থাৎ রাষ্ট্রের লাভজনক কোনো কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সংসদ সদস্যদের কোনো যোগসূত্র থাকতে পারবে না। উন্নয়নমূলক ও যাবতীয় সেবামূলক কার্যক্রম স্থানীয় সরকারের কাছে ন্যস্ত করতে হবে। স্থানীয় সরকারের ও কেন্দ্রীয় সরকারের দায়িত্ব, কর্তব্য ও ক্ষমতার বণ্টন সুস্পষ্ট থাকতে হবে। স্থানীয় সরকারের ওপর সংসদ সদস্য ও প্রশাসনের খবরদারি চলবে না, সাংবিধানিকভাবেই এসব নিশ্চিত করতে হবে।

পাশাপাশি আমরা বিচার বিভাগের সংস্কার চাই। কারণ সংসদের আইন ও প্রশাসনের সবকিছু পরিশেষে গিয়ে বিচার বিভাগের মাধ্যমে পরীক্ষিত হয়। সেখানে বিচার বিভাগের যে নিয়োগ পদ্ধতি বিশেষত উচ্চতর আদালতে সেটা বাতিল করতে চাই, বিচারপতি নিয়োগ দলীয় পছন্দ-অপছন্দের ভিত্তিতে হতে পারে না। এছাড়া আদালত  আইন মন্ত্রণালয়ের অর্থ বরাদ্দের মুখাপেক্ষী থাকতে পারে না। বিচার বিভাগের জন্য কোনো সচিবালয় নেই আমরা বিচার বিভাগের জন্য একটি সচিবালয় চাই এবং এ বিভাগের নিজস্ব অর্থায়ন বা ফান্ডের ব্যবস্থা চাই।  অধস্তন আদালতের বিচারকদের নিয়োগ, পদোন্নতি, বদলি সর্বোপরি এর নিয়ন্ত্রণ রয়েছে আইন মন্ত্রণালয়ের হাতে। আমরা চাই এটা উচ্চ আদালতের হাতে ন্যস্ত করতে। আমরা আইনেরও সংস্কার চাই। যেমন বিচার বিভাগ সংস্কার করার পরও আইসিটি অ্যাক্টের মতো অগণতান্ত্রিক, অন্যায্য আইন থাকলে বিচারপ্রার্থীরা অগণতান্ত্রিক বিচারই পাবে। তাই সব ভোগান্তি থেকে বাঁচতে আমরা এসব অগণতান্ত্রিক আইন বাতিল করতে চাই, অগণতান্ত্রিক আইন বানানোর ক্ষমতা বাতিল করতে চাই। 

পুলিশ ও প্রশাসন সংস্কার নিয়েও অনেকে কথা বলছেন। আপনারা এ নিয়ে কী ভাবছেন?

আমরা পুলিশ ও প্রশাসনের সংস্কার চাই। আমি মনে করি, এখনই পুলিশকে সংস্কার করার সবচেয়ে ভালো সময় যাচ্ছে। সরকারের যদি স্ট্যাবিলিটি থাকত তাহলে তার প্রথম কাজ হওয়া উচিত ছিল পুলিশ বাহিনীতে সংস্কার সাধন করা। আমরা বর্তমান পুলিশ ব্যবস্থাকে ভেঙে দিতে চাই। আমরা পুলিশকে আসলে স্থানীয় সরকারের কাছে নিয়ে যেতে চাই, আমরা জেলা সরকার চাই। বর্তমানে যেটা আছে সেটা স্থানীয় সরকার নয়, বরং স্থানীয় শাসন যা কেন্দ্রীয় শাসনেরই এক ধরনের সম্প্রসারণ। কিন্তু আমরা এমন একটা স্থানীয় সরকার চাই যারা প্রকৃত অর্থেই স্থানীয় সমস্যাগুলো সমাধান করবে। কেন্দ্রের আর স্থানীয় সরকারের দায়িত্ব, কর্তব্য ও ক্ষমতা আসলে সুনির্দিষ্ট করে পৃথক করে দিতে হবে। কেন্দ্রের কাছে আমরা ক্ষমতা কমিয়ে আনতে চাই, যাতে স্থানীয় সরকারের ক্ষমতা বাড়ে। আবার পুলিশেও যেসব সংস্কার প্রয়োজন সেসবের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে কেন্দ্রীয়ভাবে পুলিশকে প্রশাসনিক ক্ষমতায়ন না করা, যেমন আমেরিকায় কিন্তু কেন্দ্রীয় পুলিশ বাহিনী নেই। সেখানে স্থানীয় সরকারের অধীনে পুলিশ বাহিনী কাজ করে। পুলিশকে মানবিক হতে হবে এবং জনগণের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ থাকবে। ব্রিটিশরা এ দেশে পুলিশ তৈরি করেছিল ঔপনিবেশিক শাসন বজায় রাখার জন্য। কিন্তু তাদের নিজেদের ভূখণ্ডে এমন পুলিশ পাওয়া যাবে না যারা গুলি করে মানুষ মেরে ফেলে। ওখানে হাজার আন্দোলন, হামলা, সম্পদ বিনষ্ট হলেও পুলিশ কিন্তু কাউকে গুলি করে মারে না। কারণ ওদের প্রশিক্ষণ পদ্ধতিতেই ওরা দায়িত্বশীল হয়ে দাঁড়ায়। আমরাও সেই রকম মানবিক পুলিশ চাই। সর্বোপরি পুলিশ, প্রশাসন, বিচার বিভাগের সংস্কার চাই। আমরা প্রশাসনিক আইনের সংস্কার চাই এবং প্রশাসনকে জনগণের কাছে জবাবদিহিতে বাধ্য রাখার জন্য সংসদের কাছে জবাবদিহির আইন করতে চাই।

স্থানীয় সরকার নিয়ে আপনাদের ভাবনার কথা যদি বলতেন।

আমরা স্থানীয় সরকারের সংস্কার চাই। আমরা চাই স্থানীয় সরকারের কাছে বাজেট জনসংখ্যার অনুপাতে বণ্টন করে দেয়া হবে, যাতে স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধিদের মন্ত্রী বা এমপিদের কাছে তদবিরের প্রয়োজন না হয়, বৈষম্য ও দুর্নীতি যাতে দূর হয়। আমরা স্থানীয় সরকারের নিজস্ব ফান্ড চাই, বাজেট চাই এবং স্থানীয় সরকারের অধীন প্রতিটি এলাকার নিজস্ব বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে ভূমি ব্যবস্থাপনা থেকে শুরু করে অন্যান্য স্বতন্ত্র চাহিদা কেন্দ্রে ঠিকঠাকভাবে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করতে চাই।

স্থানীয় সরকার নিয়ে আমরা এরই মধ্যে কিছু কথা বলেছি। আমরা স্থানীয় সরকারের নির্বাচন পদ্ধতি পাল্টাতে চাই। ইউনিয়ন পর্যায়ে কোনো দলীয় প্রতীকের ভিত্তিতে নির্বাচন চাই না। আমরা চাই স্থানীয় পর্যায়ে দলীয় বিভাজনের বাইরে প্রকৃত জনদরদিদের যেন নেতৃত্ব হিসেবে গড়ে ওঠার পথ খোলা থাকে। একই সঙ্গে আমরা নির্বাচিত প্রতিনিধিদের প্রত্যাহার করার ব্যবস্থা রাখতে চাই, যাতে প্রতিনিধিরা জনবিরোধী কাজ করলে জনগণ তাদের প্রত্যাহার করতে পারে। তাহলে জনগণের ক্ষমতায়ন ও সেবা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। 

অর্থনৈতিক ব্যবস্থার সংস্কার নিয়ে আপনাদের পরিকল্পনা কী?

আমরা অর্থনৈতিক ব্যবস্থারও সংস্কার চাই। বাংলাদেশ ব্যাংক ও ব্যাংক খাত নিয়ে যে কথা উঠছে। এর কারণ হচ্ছে এ জায়গাগুলোয় অর্থ মন্ত্রণালয়ের ফাইন্যান্স ডিভিশনের মাতব্বরি করার সুযোগ আছে। আমরা অর্থ মন্ত্রণালয়ের এ বিভাগের বিলুপ্তি চাই। কারণ ব্যাংকের ওপর এ বিভাগের নিয়ন্ত্রণ ক্ষতিকর। ব্যাংকগুলোকে চলতে হবে বাংলাদেশ ব্যাংকের রেগুলেশন অনুযায়ী বা ব্যাংকিং আইনের অধীনে এবং সেখানে ‘রেগুলেটরি বডি’ হিসেবে কাজ করবে বাংলাদেশ ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকে সরকারি পছন্দের লোক বসিয়ে যাতে চুরির ব্যবস্থা করা না যায়, সে ব্যবস্থা করতে হবে। আমরা এমন অনিয়ন্ত্রিত মাত্রায় বিদেশী ঋণ চাই না, যেখানে মোট জিডিপির ৫০ শতাংশের বেশি বিদেশী ঋণ থাকবে। আমরা এখন মোট জিডিপির সর্বোচ্চ ২৫ শতাংশ ঋণ অনুমোদন চাই এবং এ ঋণের টাকা কোথায় কোন খাতে খরচ হয় তা জনগণকে জানাতে হবে, সংসদে প্রত্যক্ষ আলোচনা হতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে যেকোনো বৈদেশিক চুক্তির ব্যাপারেও সংসদে আলোচনা চাই। 

অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে আমরা একটি প্রতিযোগিতামূলক বেসরকারি খাত চাই। কিছু নির্দিষ্টে ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ নিয়ন্ত্রণ ও পদক্ষেপের বাইরে এখানে সরকারি কোনো হস্তক্ষেপ চাই না, সরকার কোনো ব্যবসা করুক সেটাও চাই না। আমরা চাই যে সরকার শুধু রেগুলেশন করবে এবং সেটা ‘স্ট্রিক্টলি মেইনটেইন’ করবে, তারা উৎপাদক ও বিজনেসম্যানদের সব সিকিউরিটি এনসিউর করবে। এখানে যাতে ব্যবসায়ীরা যথাযথভাবে মুনাফা অর্জন করতে পারেন এবং যথাযথভাবে ট্যাক্স প্রদানের পরে ব্যবসায়ীরা যাতে তাদের টাকা ইচ্ছা অনুযায়ী ব্যবহার করতে পারেন, সেটির নিশ্চয়তা বিধান করতে চাই। আমরা অর্থনৈতিক আইন-কানুন ও পরিবেশকে এমনভাবে বিন্যস্ত করতে চাই যাতে আমাদের দেশ উৎপাদক ও ব্যবসায়ীদের জন্য নিরাপদ ও লাভজনক হবে এবং বিদেশী বিনিয়োগ বাড়বে। যদি আমরা ব্যবসায়ীদের বিনিয়োগ ও পুনর্বিনিয়োগের নিশ্চয়তা দিতে পারি তাহলে ব্যবসায়ীরা আর টাকা পাচার করবেন না। একই সঙ্গে তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে আমাদের, তাদের অর্থ-সম্পদ উপভোগ করার সুযোগ ও পরিবেশ দিতে হবে, অর্থাৎ তাদের যে মর্যাদা ও অবদান সেটা আমরা নিশ্চিত করতে চাই। কিন্তু দলের কিছু লোককে ব্যবসার নামে মাফিয়াচর্চায় উৎসাহিত করে বাকি ব্যবসায়ীদের বঞ্চিত করার চর্চাকে আমরা আর উৎসাহ দিতে চাই না। বাংলাদেশে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পকে প্রতিষ্ঠিত ও বিস্তৃত করতে চাই। আমাদের দু-একজন মেগা বিজনেসম্যানের প্রয়োজন নেই, আমাদের প্রয়োজন আমাদের ক্ষুদ্র ও মধ্যম পর্যায়ের শিল্পগুলোর ব্যাপক সম্ভাবনাকে কাজে লাগানো। এগুলোই হবে আমাদের অর্থনৈতিক সংস্কারের মূল জায়গা।

শ্রুতলিখন: সুস্মিতা হোসেন স্বর্ণালী

আরও