উচ্চ শিক্ষা

শিক্ষা ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন ও দখলদারত্ব যেন ফিরে না আসে

সবাই আজকে এখানে উচ্চ শিক্ষা নিয়ে কথা বলছেন। কিন্তু আমার মাথার মধ্যে চলছে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের টেক্সট বুক ঠিক সময়ে সরবরাহ করতে পারব কিনা সেই বিষয়টা।

সবাই আজকে এখানে উচ্চ শিক্ষা নিয়ে কথা বলছেন। কিন্তু আমার মাথার মধ্যে চলছে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের টেক্সট বুক ঠিক সময়ে সরবরাহ করতে পারব কিনা সেই বিষয়টা। তার পরও এখানে আলোচিত অনেকগুলো পরামর্শ আমি নোট করে রেখেছি।

বাংলাদেশের উচ্চ শিক্ষার মান নিয়ে ঢালাওভাবে কিছু বলা কঠিন, কারণ উচ্চ শিক্ষা বহুধারায় বিভক্ত। সরকারি-বেসরকারি খাতের অনেক বিশ্ববিদ্যালয় আছে। মানের দিক দিয়েও সেগুলো সম্পূর্ণ ভিন্ন। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়েও উচ্চ শিক্ষা আছে। সব মিলিয়ে উচ্চ শিক্ষায় বড় বড় সমস্যা আছে, সেটা দেখা যায় কতগুলো দিকে লক্ষ করলেই, যেমন উচ্চ মাধ্যমিক পাস করার পরই মেধাবী ও আর্থিক সামর্থ্যবান শিক্ষার্থীদের কেন বিদেশে চলে যেতে হয়? আমাদের সময়ে এ ধরনের চিন্তা আসত না। এখন উচ্চ শিক্ষা শেষ করে যারা বের হচ্ছেন তাদের কর্মসংস্থানের সমস্যা দেখা দিয়েছে। শিক্ষিত বেকারের সমস্যা আমাদের সময়ে এত ছিল না। এখন শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে। আমরা উপযুক্ত মানবসম্পদ তৈরি করতে পারছি না, যা দৃশ্যমান। কাজেই উচ্চ শিক্ষা খাতে সমস্যা ও গাফিলতি যে রয়েছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

সব বিষয়ে আলোচনা করার চেয়ে বরং আমার সবচেয়ে পরিচিত যে জায়গাটা সেটা নিয়েই আলোচনা করব এখন। সুপ্রতিষ্ঠিত যেসব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় আছে, শিক্ষার্থী বিচারে সেগুলোকেই মূলধারার উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বলতে পারি। এছাড়া বেসরকারি পর্যায়ের হাতে গোনা কয়েকটি উন্নত মানের বিশ্ববিদ্যালয় আছে। সেটি নিয়ে অনেকেই এরই মধ্যে আলোচনা করেছেন। সেজন্য আমি এখন সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে দুই-একটি মন্তব্য করা দরকার বলে মনে করছি। আন্তর্জাতিক র‍্যাংকিংয়ের কথা আলোচনায় এসেছে, যদিও যেসবের ভিত্তিতে র‍্যাংকিং হয় সেসবের ব্যাপারে কিছু ত্রুটিপূর্ণ বিচার্য বিষয় আছে। তার পরও অস্বীকার করার উপায় নেই যে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় উচ্চ শিক্ষার পরিবেশ ক্রমাগতভাবে অধঃপতিত হয়েছে। এ অধঃপতনের পেছনের কারণগুলো সবারই জানা। এর মধ্যে শিক্ষকদের দলীয় লেজুড়বৃত্তিক রাজনীতি এবং ছাত্ররাজনীতির নামে দখলদারত্ব ও দুর্বৃত্তায়ন অন্যতম। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে একটি বড় ক্ষতির জায়গাটি হলো শিক্ষক নিয়োগে অনিয়ম-দুর্নীতি। একটা সময় পর্যন্ত এমনকি আমি নিজেও যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতাম তখনো শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে নিয়মনীতিগুলো ঠিকঠাক পালন করা হতো। কিন্তু পরবর্তীকালে বিশেষত গত দেড় দশকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় লেকচারার নিয়োগে প্রচণ্ড অনিয়ম হয়েছে। যেটা আসলে সাময়িক দলীয়করণের প্রক্রিয়া নয়, এটার প্রভাব দীর্ঘমেয়াদি, কারণ প্রতিষ্ঠানগুলোকে পঙ্গু করার পেছনে এ প্রক্রিয়ার দায় সবচেয়ে বেশি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো এত নেতিবাচকতায় পরিপূর্ণ থাকার পরও, উচ্চ শিক্ষা প্রতিবেশের এত অবনতি সত্ত্বেও একটি ইতিবাচক দিক হলো এখনো আমাদের পাবলিক ও প্রাইভেট উভয় বিশ্ববিদ্যালয়েই এ রকম অনেক শিক্ষক রয়েছেন যারা নিজ নিজ ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক মানের অত্যন্ত উঁচু পর্যায়ের গবেষক। কিন্তু এটাও আমাদের দৃষ্টিগোচর হয় না অনেক সময়। যেসব সূচক দিয়ে আন্তর্জাতিক গবেষকদের মান নির্ধারণ করা হয়, যেমন গুগল রিসার্চ, স্কোপাস বা এ ধরনের ওয়েবসাইটে খুঁজলেই দেখা যায় আমাদের গবেষকদের আন্তর্জাতিক মানের গবেষণাপত্রের সংখ্যা এবং তাদের সাইটেশনের উঁচু হার। কিন্তু এ ইতিবাচক বিষয়টি আমি আমাদের উচ্চ শিক্ষার আলোচনায় কখনো দেখি না। বরং বিশ্ববিদ্যালয়ের নেতৃত্বদানকারী শিক্ষক নেতাদের হাইলাইট করা হয়, এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের নিজেদের মধ্যকার আলোচনায়ও শুধু রাজনীতিই প্রাধান্য পায়। গবেষণাকারী শিক্ষকদের নিয়ে বা তাদের পেপার নিয়ে তেমন আলোচনা দেখি না। প্রশ্ন হলো কেন এ পরিবেশ সৃষ্টি হলো? কেন এসব গবেষক-শিক্ষককে আড়ালে কোণঠাসা করে রাখা হয়? এসব প্রশ্নের পটভূমি আমাদের বুঝতে হবে।

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর দেখা গেল বিশ্ববিদ্যালয়গুলো একেবারে নেতৃত্বশূন্য। কারণ উপাচার্য, উপ-উপাচার্যসহ রেজিস্ট্রার, প্রক্টর কাউকেই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এর থেকেই বোধগম্য যে কী রকমভাবে রাজনৈতিক দলীয়করণ হয়েছিল যে একটি রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের ফলেই সবাইকে চলে যেতে হয়েছে। এরপর যখন সব বিশ্ববিদ্যালয়ে এসব পদে পদায়ন করার প্রশ্ন উঠল এবং আমরা যখন পদায়ন করেছি তখনো পত্রপত্রিকায় এসেছে যে গতানুগতিক আগের পদ্ধতি মেনেই রাজনৈতিক বিবেচনায় এসব ভিসি নিয়োগ হয়েছে, লবিংয়ের মাধ্যমে নিয়োগ দেয়া হয়েছে বা এদের অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় নিয়োগ দেয়া হয়েছে। কিন্তু কখনো এটা জানার বা লক্ষ করার তারা চেষ্টা করেননি যে এসব নিয়োগপ্রাপ্ত ভিসির সাইটেশান যদি ৫০০০ থেকে ৭০০০ হাজার পর্যন্ত হয় তাহলে তাদের সক্রিয় রাজনীতি করার সময়টা কোথায়? এভাবে তো কেউ ভেবে দেখেন না। আসল কথা হলো শিক্ষকদের রাজনৈতিক বা দলীয় লেজুড়বৃত্তির সমস্যা একটা বড় সমস্যা। এটা নিয়ে ভাবতে বা লিখতে গিয়ে আমাদের শিক্ষকদের মধ্যে যে উচ্চমানের গবেষণা অর্জনের যে বিষয় সেটা ঢাকা পড়ে গেছে। উচ্চ শিক্ষায় দলীয় রাজনীতি ও অপরাজনীতি যেমন মুদ্রার একটি পিঠ, ঠিক তেমনি উল্টো পিঠে মেধার চরম অবমূল্যায়ন অবস্থিত। মেধার লালনে এবং স্বীকৃতি প্রদানে আমাদের চরম অনাগ্রহ। জামাল নজরুল ইসলামের মতো পৃথিবীর একজন সেরা বিজ্ঞানী, যিনি স্টিফেন হকিংয়ের বন্ধু এবং সহকর্মী বিজ্ঞানী হিসেবে সমাদৃত ও স্বীকৃত ছিলেন, তিনি যখন কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে দিয়ে এসে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি আন্তর্জাতিক মানের গবেষণা কেন্দ্র স্থাপন করে সেখানে তার বাকি জীবনটা বিলিয়ে দিয়ে গেলেন তাকে কি আমরা জাতীয়ভাবে কোনো সম্মাননা, পুরস্কার বা স্বীকৃতি দিয়েছি? এখানে একটি যুক্তি দেয়া হয়, যেটা ভিসি নিয়োগেও দেয়া হয়ে থাকে যে শিক্ষক, গবেষকরা খুব উঁচুমনের হলেও কি তারা খুব ভালো প্রশাসক হবেন? অবশ্যই প্রশাসক হতে আলাদা গুণেরও দরকার আছে। বিদেশী নামকরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যারা প্রেসিডেন্ট মানে আমাদের ভিসির মতো তারা তো প্রশাসকই হন। কারণ একাডেমিক নেতৃত্বে থকেন বিভাগীয় প্রধান এবং ডিনরা। কিন্তু আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর যারা ভিসি এই যে নিয়াজ সাহেব বসে আছেন তারা প্রশাসনিক নেতৃত্বও যেমন দেন, তাদের কিন্তু একাডেমিক নেতৃত্বও দিতে হয়। কাজেই এ নবনিযুক্ত যে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষ তারা এই অল্প সময়ের মধ্যেই অধিকাংশ শিক্ষাঙ্গনে এত অস্থির পরিস্থিতিকে শান্ত করে পুনারায় শিক্ষা কার্যক্রম চালু করতে পেরেছেন, এজন্য তাদের ধন্যবাদ দিই। এই প্রথম সম্ভবত কর্তৃপক্ষের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলোয় শিক্ষার্থীরা সিট পাচ্ছে। এমনকি প্রথমবারের মতো এবার আমরা ভিসি নিয়োগে নোয়াখালী বা পাবনার মতো প্রত্যন্ত অঞ্চলের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় বিশ্বের নামকরা প্রতিষ্ঠান যেমন অক্সফোর্ড, কেমব্রিজের মতো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পোস্টডক্টরাল বা পিএইচডি করা এমনকি এমআইটিতে অধ্যাপনা করার অভিজ্ঞতাসম্পন্ন লোকেদের নিয়োগ করেছি। তারা হয়তো সামনে বেশিদিন থাকবেন না, কারণ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নিয়মানুযায়ী ভিসি নির্বাচিত হন। সেগুলোয় আমার মনে হয় না তারা অংশগ্রহণ করবেন। তবে যে লবিংয়ের অভিযোগ আনা হয়েছে সেগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, কেমব্রিজ থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং করে আসা কোনো লোক কেন পাবনার মতো বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি হতে যাবেন? তাদের আমরা বরং উদ্বুদ্ধ করেছি এসব প্রত্যন্ত অঞ্চলে গিয়ে এসব প্রতিষ্ঠানকে সেন্টার অব এক্সিলেন্সে পরিণত করার জন্য। তারা আমাদের এ চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেছেন। এসব শিক্ষক-গবেষককে খুঁজে বের করতে গিয়ে বরং আমার একটা জিনিস উপলব্ধিতে এসেছে যে আমাদের যে ব্রেইন-ড্রেইন বা মেধা পাচারের কথা বলি সেটার বিপরীতে এই প্রথম বাংলাদেশে বিপরীতমুখী ধারা তৈরি হয়েছে। যেটাকে বলা হয় ব্রেইন-সার্কুলেশন বা মেধা সঞ্চালন। বিদেশে গিয়ে যারা ভালো চর্চা করেছেন তাদের মধ্যে অনেকে এই প্রথম ফিরে আসা শুরু করেছেন। এই বড় সুযোগটা আমি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষকেও গ্রহণ করতে বলব।

যতই এসব বলি না কেন, সঙ্গে সঙ্গে এটাও অনস্বীকার্য যে দেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যায় ব্যাপক বিস্তৃতি ঘটেছে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে যে কলেজগুলো আছে এসব গ্রামে, প্রত্যন্ত অঞ্চলে রাজনৈতিক প্রভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে অনার্স-মাস্টার্স খুলে বসে আছে অথচ কোনো শিক্ষক নেই। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে প্রতিটি জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দেয়া হয়েছে, এখানে না আছে ভালো শিক্ষক, না আছে তেমন ভালো শিক্ষার্থীর সংখ্যা। এগুলোর ভবিষ্যৎ কী হবে আমি জানি না। হতে পারে, আস্তে আস্তে এগুলোর স্বাভাবিক মৃত্যু ঘটবে ভালো শিক্ষক, গুণগত শিক্ষা ও শিক্ষার্থীদের মানের অভাব এবং বেকারত্বে শীর্ষতার প্রভাবে। গ্রামে-মফস্বলে খুলে বসা বিশ্ববিদ্যালয়-কলেজ, যেগুলোয় এইচএসসি থেকে মাস্টার্স পর্যন্ত পড়ানো হয়—কিন্তু এক বিষয়ে চার-পাঁচজনের বেশি শিক্ষক নেই, সেগুলোর ভবিষ্যৎ কী হতে পারে? সেখানে একজন আমাকে পরামর্শ দিয়েছেন যে অন্তত গুচ্ছ আকারে তারা যদি কিছু কিছু বিষয় শুধু পড়ায় এবং ওই বিষয়ের শিক্ষকদের সেখানে কেন্দ্রায়ন করে তাহলে হয়তো ন্যূনতম মানের কিছু শিক্ষা সেখানে প্রদান করা যেতে পারে।

আর আগেই বলেছি শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা আমাদের ক্রমাগত বাড়ছে, সেটাকে আমরা যতই ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড বলি না কেন, এখানে মানবসম্পদ তৈরির ক্ষেত্রে বিরাট একটি অপচয় ঘটছে আমাদের দেশে। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সঙ্গে তাল মিলিয়ে যে মানবসম্পদ তৈরি করা প্রয়োজন সোটা তো এখনো অনেক দূরের বিষয়। কিছু কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে যেভাবে বিভিন্ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের সহযোগিতায় শিক্ষার্থীদের প্র্যাকটিক্যাল ইন্টার্নশিপ করানো হচ্ছে, তাতে শিক্ষার্থীদের কর্মসংস্থানের যোগ্য করে গড়ে তোলার একটা সুযোগ সৃষ্টি করা হয়েছে।

পরিশেষে বহুল আলোচিত কিছু সমস্যার সম্ভাব্য উত্তরণ নিয়ে আমি কিছু বলতে চাই। প্রথমত এসব সমস্যা সমাধানে আমি কোনো শর্টকাট দেখি না। উচ্চ শিক্ষার মান কী করে বৈশ্বিক মানে রূপান্তর করা যাবে সহজেই সেটা অর্জন করা সম্ভব নয়। উচ্চ শিক্ষার যে বৈশ্বিক মান তার সঙ্গে পরিচিত যদি হতে হয় তাহলে বিদেশের ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যৌথ কার্যক্রম চালু করতে হবে বা ক্রেডিট বিনিময়ের পদ্ধতি চালু করতে হবে। যদিও খুবই প্রাথমিক পর্যায়ে সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু কিছু বিভাগে এটা শুরু হয়েছে কিন্তু বড় আকারে এখনো তৈরি হয়নি। এছাড়া বিশ্বের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় আমাদের যেসব শিক্ষার্থী যাচ্ছে অথবা বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত যেসব প্রথম সারির শিক্ষক-গবেষক রয়েছেন যাদের সংখ্যা ক্রমবর্ধমান হারে বাড়ছে, তাদের অনেকেই আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় কাজ করার আগ্রহ প্রকাশ করেন। সেক্ষেত্রে স্থায়িত্বের পাশাপাশি ভিজিটিং প্রফেসরশিপ চালু করাও এখন সময়ের দাবি, যাতে তারা কিছু সময়ের জন্য হলেও এসে তাদের সেবাটা দিতে পারেন। চীনের ক্ষেত্রেও আমরা দেখেছি তাদের পশ্চিমা শিক্ষায় শিক্ষিত শিক্ষক, গবেষকদের দেশে নিয়ে তাদের সাহায্যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো গড়ে তুলছে। সেজন্য সাম্প্রতিক নানা র‍্যাংকিংয়ে তারা অনেক বেশি ভালো করেছে। আমরা এখন পর্যন্ত এমন পরিবেশ তৈরি করতে পারিনি। সক্ষমতাসহ অন্যান্য প্রশ্ন এল। অন্তত তাদের আমরা ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে আনার কথা চিন্তা করতে পারি। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের যারা কর্ণধার ও নেতৃত্বে যারা থাকবেন মেধা সংরক্ষণ ও চর্চার ব্যাপারে যদি তাদের উৎসাহ ও আগ্রহ না থাকে তাহলে এদিকে এগোনো যাবে না। সেজন্য এ একাডেমিক ও প্রশাসনিক নেতৃত্বগুলো কাদের হাতে সেটা খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আগেই বলেছি, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় ব্যক্তি পর্যায়ের অনেক উন্নতমানের গবেষক রয়েছেন, কিন্তু তাদের অনেক বাধা রয়েছে। এখন ১৯৩০-এর দশকের মতো সত্যেন বোসদের অবস্থা নেই, যখন একা একা কার্জন হলে বসে এমন আবিষ্কার করতে পেরেছেন, যার ফলে তিনি বিশ্ববিখ্যাত হয়েছেন আইনস্টাইনের সঙ্গে একত্রে গবেষণা করে। কিছুদিন আগেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সত্যেন বোসকে স্মরণ করে একটি আন্তর্জাতিক সেমিনারের আয়োজন করা হয়েছিল।

এখনকার দিনে গবেষণা করতে হলে ন্যূনতম শর্ত হলো কিছু শিক্ষককে নিয়ে একটি গবেষণার পরিবেশ তৈরি করা প্রয়োজন এবং গবেষণার জন্য প্রয়োজনীয় সাজ-সরঞ্জামেরও প্রয়োজন হয়। এজন্য আমাদের ইউজিসির কর্মপরিধি একটু বাড়িয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কমিশন বা উচ্চ শিক্ষা কমিশন নামকরণ করে এর ওপর কিছু কিছু নতুন কর্মপরিকল্পনা বা দায়িত্ব প্রদান করা যায় কিনা সে বিষয়ে চিন্তা করা যেতে পারে। তারা যেন আমাদের একটা আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় গবেষণা নেটওয়ার্ক তৈরি করতে পারেন, যেখানে সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে একই ক্ষেত্রে বা বিষয়ে যারা গবেষণা করছেন তারা যাতে একত্র হয়ে যৌথভাবে গবেষণার সুযোগ পান। এছাড়া বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক শিক্ষা ও গবেষণার সরঞ্জাম, উপকরণ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে সেগুলোরও যেন একত্রায়ন তারা করতে পারেন। ফলে বিদ্যমান শিক্ষা উপকরণের ব্যবহার আরো বেশি সুষ্ঠুভাবে করা সম্ভব হবে। একই সঙ্গে শিক্ষা ক্ষেত্রের বাজেট বাড়াতে হবে। বর্তমানের মতো জিডিপির মাত্র ৩ শতাংশ বরাদ্দ দিলে চলবে না, এটা বাড়িয়ে যথাযথ করার কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু হঠাৎ করে তো সেটা করা যাবে না, সেজন্য অগ্রাধিকার ভিত্তিতে এগোতে হবে। কিন্তু এত অগ্রাধিকারমূলক সমস্যা বিদ্যমান রয়েছে, যেমন প্রাইমারি শিক্ষকদের বেতন-ভাতা বাড়াব নাকি বেসরকারি মাধ্যমিক স্কুলের—সেটা নিয়ে আমি এরই মধ্যে বেশ চিন্তায় আছি।

আমাদের মূল কথা হলো উচ্চ শিক্ষা ও গবেষণার সুস্থ পরিবেশ তৈরি করতে চাই আমরা। এখন আমরা চেষ্টা চালাচ্ছি অন্তত স্বল্প সময়ের জন্য হলেও যেন দলীয়করণকে বাদ দিয়ে একটা পরিবেশ তৈরি করা যায়। যে চেষ্টা চলছে এটা যদি অব্যাহত থাকে, অর্থাৎ মেধার স্বীকৃতি ও প্রকৃত মূল্যায়ন। বৈশ্বিক মানের উচ্চ শিক্ষার পথে এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে আমরা যেন আরো আগ্রহী হতে পারি এবং দলীয়করণের ফলে ও রাজনীতির নামে শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের ভোগান্তি যেন না হয়। শিক্ষা ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন ও দখলদারত্বের সংস্কৃতি রোধ করা ও ছাত্ররাজনীতির নামে অপরাজনৈতিক চর্চা যেন ফিরে না আসে। কিছু কিছু পদায়নের ক্ষেত্রে, যেমন উচ্চ শিক্ষায় বা এই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নেতৃত্ব যারা দেবেন তাদের শিক্ষাগত যোগ্যতা, তাদের প্রশাসনিক যোগ্যতা এক্ষেত্রে যেই দৃষ্টান্তগুলো স্থাপন করা হচ্ছে এগুলো অন্তত পরবর্তী নির্বাচিত সরকারের জন্য যদি একটি উদাহরণ হয়ে থাকে, সেটাও আমাদের একটা বড় সাফল্য হিসেবে আমরা মনে করব।

ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ: উপদেষ্টা, শিক্ষা মন্ত্রণালয়

[‘উচ্চ শিক্ষায় বৈশ্বিক মান: বাংলাদেশের করণীয়’ শীর্ষক বণিক বার্তা আয়োজিত প্রথম বাংলাদেশ উচ্চ শিক্ষা সম্মেলন ২০২৪ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্য]

আরও