ভূমিকা
আজকের অর্থনীতি ও সমাজের ভালোমন্দ বহুলাংশে অর্থপ্রবাহের স্বচ্ছতা, নির্ভরযোগ্যতা ও মসৃণতার ওপর নির্ভরশীল। বিনিময়ে অর্থ প্রয়োজন, তবে সেই অর্থের প্রবাহ নিশ্চিত করতে, নগদে হোক বা হিসাবের খাতায় (বা কম্পিউটারে) হোক, ব্যাংকগুলো ভূমিকা রাখে। এমনকি, মোবাইল অর্থ সেবানির্ভর লেনদেনের ক্ষেত্রেও, বর্তমান আইনি কাঠামোয়, ব্যাংকের সেবা অপরিহার্য। উভয় অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে এবং রেমিট্যান্স প্রেরণ ও প্রাপ্তিতে ব্যাংকের ভূমিকা সম্পর্কে সবাই অবগত। ভবিষ্যৎ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বর্তমানের সঞ্চয় জমানোর জন্য ব্যাংকগুলোকে নির্ভরযোগ্য প্রতিষ্ঠান হিসেবে গণ্য করা হয়। সেই অর্থ ব্যবহার করেই মূলত ব্যাংকিং নামক ব্যবসা। ব্যাংক ঋণ বিনিয়োগ বাড়িয়ে যদি তার আয়/প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে পারে, সেই ব্যবসা যেমন টেকসই হবে, তেমনি উপযুক্ত বিনিয়োগ/ব্যবসায় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অনেকের সঞ্চয় পৌঁছে দেয়ার মাধ্যমে ব্যাংক খাত অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে অবদান রেখেছে।
এই সহজ সমীকরণে বিভ্রাট যে ঘটতে পারে, তা আজ আমানতকারীদের অনেকেই টের পাচ্ছেন। সেই সঙ্গে প্রচারমাধ্যমে আজ অনেকেই অবগত যে ব্যক্তির সীমাহীন লোভ-লালসা মেটাতে ব্যাংক ব্যবস্থাপনার প্রতিটি স্তরে নীতিনৈতিকতায় স্খলন ঘটেছে, যা আন্তর্জাতিক অর্থ ব্যবস্থাপনা থেকে বিযুক্ত নয়। তবে ব্যক্তি হিসেবে আমি আশাবাদী যে ব্যক্তি সঞ্চয়কারীদের বিপদে ফেলার দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় স্থিতি ফিরে আসতে পারে না। সেই ভরসায় এ নিবন্ধে ব্যাংক ব্যবস্থাপনার কিছু মৌলিক উপাদান ভিন্ন মোড়কে পুনরাবৃত্তি করব এবং কিছু সীমিত ক্ষেত্রে সংস্কার উদ্যোগের অনুপস্থিতি ও ঘাটতির দিকগুলো উল্লেখ করব।
রাজনীতির অঙ্গনের স্বেচ্ছাচারিতার দৃষ্টান্ত দিতে যেয়ে আমরা প্রায়ই অর্থ পাচার, অনাদায়যোগ্য খেলাপি ঋণ, রেমিট্যান্স প্রবাহ এবং সার্বিকভাবে ‘ব্যাংক লুট’-এর কথা উল্লেখ করি। সেসব থেকে বিযুক্ত রেখে রাজনীতির অঙ্গনে সংস্কারের স্থায়িত্ব সম্পর্কে সংগতকারণেই প্রশ্ন জাগে। সেই সম্পর্কের বিবিধ দিক আজকের আলোচনার বিষয় নয়। বরং সুনির্দিষ্টভাবে ব্যাংক খাতের সংস্কার আলোচনায় গতি আনার উদ্দেশ্যে কিছু বিষয় নিম্নে উল্লেখ করেছি, যা একত্রে গ্রথিত করা সম্ভব হয়নি।
ভাবনা ১: মালিকানা স্বত্ব বনাম কর্তৃত্ব স্বত্ব
ব্যক্তির সিদ্ধান্ত গ্রহণের ওপর যারা আস্থা রাখেন তাদের অনেকে মনে করেন যে উপযুক্ত বাজার ও বিধি ব্যবস্থায় ব্যক্তিমালিকানাধীন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে সেই মালিক নিজ ব্যবসায় চৌর্যবৃত্তিতে লিপ্ত হবেন না। বরং তার উত্তরোত্তর উন্নতি সাধনে নিবিষ্ট থাকবেন এবং ব্যক্তিমুনাফা বা সামাজিক কল্যাণের যে লক্ষ্যই হোক না কেন, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের আর্থিক সচ্ছলতা বজায় রাখবেন। বাংলাদেশের অনেক ব্যাংকের ক্ষেত্রে এর ব্যত্যয় ঘটেছে যার নৈর্ব্যক্তিক অনুসন্ধান প্রয়োজন, যা এ পরিসরে করা সম্ভব নয়।
এক সাংবাদিকের সঙ্গে কথা প্রসঙ্গে প্রশ্ন উঠেছিল, ব্যাংকের মালিক কে? অনেক প্রাক্তন ও বর্তমানের ঊর্ধ্বতন ব্যাংক কর্মকর্তাকে প্রশ্ন করে এর সদুত্তর পাইনি। একসময় যে বা যারা পরিশোধিত মূলধন (পেইড-আপ ক্যাপিটাল) দিয়ে নিবন্ধন ও ব্যাংক কার্যক্রম শুরু করেছিলেন, তাকে বা তাদের ব্যাংক-কোম্পানি আইনের আওতায় ‘মালিক’ বলে গণ্য করা হতো। কিন্তু পুঁজিবাজার প্রবর্তনের পর অনেক ব্যাংকের মালিকানা স্বত্ব সমমূল্যের বহুসংখ্যক শেয়ারে রূপান্তর করার ব্যবস্থা নেয়া হয়, যার সীমিত অংশ পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীদের মাঝে বণ্টনের রীতি চালু হয়। তখনো স্পন্সর (পৃষ্ঠপোষক) শেয়ারের ভিত্তিতে মালিকানা চিহ্নিত করার চল ছিল, যা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বাইরের কোম্পানির ক্ষেত্রে এখনো প্রযোজ্য। তবে এক পর্যায়ে ব্যাংক পর্ষদের পরিচালক হওয়ার যোগ্যতা নির্ণয়ের উদ্দেশ্যে ন্যূনতম শতাংশ (২% বা বিধি সংস্থা নির্ধারিত) শেয়ার-মালিকানার রীতি প্রবর্তন করা হয়, যা কোয়ালিফায়িং (বা যোগ্যতা নির্ণয়ী) শেয়ার হিসেবে পরিচিতি পায়। তাই ইতিহাসের পাতায় (লাইসেন্স প্রাপ্তি বা নিবন্ধনকালে) স্পন্সর শেয়ার মালিকদের ব্যাংক মালিক গণ্য করলেও আজ সে-জাতীয় ধারণার কোনো আইনি ভিত্তি নেই।
পশ্চিমা দেশগুলোর প্রভাবে গড়ে ওঠা সমিতিবদ্ধ (করপোরেট) ব্যবস্থায় পর্ষদ মূল নীতিনির্ধারক হলেও পর্ষদের পরিচালকরা তাদেরই নিয়োজিত ঊর্ধ্বতন ব্যবস্থাপকদের দৈনন্দিন কর্মকাণ্ডে হস্তক্ষেপ করার কথা নয়। এ ধরনের ব্যবস্থা বিশ্লেষণে মালিকানা স্বত্ব খুঁজে বেড়ানো ভ্রান্তিকর। বরং কর্তৃত্ব স্বত্ব চিহ্নিত করে তা কীভাবে কোন পরিস্থিতিতে লুটেরা শ্রেণীর উত্থান ঘটায়, তা অনুধাবন জরুরি। যেসব ব্যাংক পিএলসিতে রূপান্তর হয়েছে সেগুলোর পরিচালনা ক্ষেত্রে ‘মালিকানা স্বত্ব’র বেড়াজাল থেকে বেরিয়ে আসা ব্যাংক খাত সংস্কারের প্রথম পদক্ষেপ হওয়া প্রয়োজন।
স্পন্সর শেয়ার বিক্রির ইতিহাস ঘাঁটলে হয়তো দেখা যাবে য তা অতিমূল্যায়িত করে বাজারে বিক্রি করে প্রথম পর্যায়ের পৃষ্ঠপোষকরা তাদের মূলধন উঠিয়ে নিয়েছেন। তাই মালিকানা স্বত্ব পরিত্যাগের উদ্যোগকে অনৈতিক মনে করার অবকাশ নেই।
ভাবনা ২: সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (এসইসি) ও বাংলাদেশ ব্যাংক
বিস্তারিত ব্যাখ্যায় যাওয়ার সুযোগ নেই। পূর্বে উল্লেখিত ‘কর্তৃত্ব স্বত্ব’ কীভাবে সংজ্ঞায়ন করলে কল্যাণমুখী ব্যাংক ব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব, তা ভাবা জরুরি এবং সেই আলোকে সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (এসইসি) আইন (১৯৯৩)-এর সঙ্গে ১৯৯১-এর ব্যাংক আইনের মধ্যে সমন্বয় আনা প্রয়োজন। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে শেয়ারবাজারে একটি ব্যাংকের দর ওঠানামা সেই ব্যাংকের ব্যালান্স শিটে কোনো প্রভাব ফেলে না। তাই সেই ব্যাংকের আমানতকারীদের ভিন্ন কারণে শেয়ারবাজারের দর ধর্তব্যে আনতে হলেও ঢালাওভাবে উদ্বিগ্ন হওয়ার কারণ নেই। সমাজকল্যাণ ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে ব্যাংকের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা স্বীকৃতি দিলে ব্যাংক আইনকে প্রাধান্য দিয়ে সংস্কারের উদ্যোগ নিতে হবে। এ ব্যাপারে অর্থ মন্ত্রণালয়কে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে।
ভাবনা ৩: বিধিনিষেধের কার্যকর বেড়াজাল চিহ্নিত করে সেই বলয়ে (বহুমাত্রিক ক্ষেত্রে) বিধি স্থির করা
এ ভাবনার তাত্ত্বিক দিকগুলো নিয়ে কাজ চলমান। সংক্ষেপে এর প্রাথমিক ধারণা নিম্নে বর্ণনা করা হলো। একটি ব্যাংক ব্যবস্থায় আয়-বণ্টনের ভিত্তিতে নিম্নোক্ত গোষ্ঠী (স্টেকহোল্ডার) স্বার্থ চিহ্নিত সম্ভব।
১। আমানতকারী, যারা সুদহারের ভিত্তিতে উপার্জন করেন এবং যে প্রাপ্তি ব্যাংকের খাতায় খরচ হিসেবে দেখানো হয়।
২। ব্যবস্থাপনা খরচ, যা কর্মী ও ব্যবস্থাপকদের নিয়মিত আয় অন্তর্ভুক্ত করে।
৩। কার্য পরিচালনা বাবদ অন্যান্য খরচ (অপারেশন খরচ), যার মধ্যে অনেক ক্রয়/সংগ্রহ অন্তর্ভুক্ত।
৪। মুনাফা সাপেক্ষে শেয়ারপ্রতি লভ্যাংশ ও ব্যবস্থাপকসহ ব্যাংক কর্মীদের বোনাস।
৫। সরকারি রাজস্বে দেয়া কর, এবং
৬। ব্যাংকের সম্পদে নতুন সংযোজন।
আগেই বলেছি যে ইকুইটি শেয়ারের সঙ্গে কর্তৃত্ব স্বত্বের সম্পর্ক থাকলেও ব্যাংকের ব্যালান্স শিটে সম্পদ-দায়ের হিসাবনিকাশের পর লভ্যাংশ থেকে শেয়ারপ্রতি প্রাপ্তি ব্যতিরেকে স্বল্পমেয়াদে শেয়ারমূল্য বা পরিমাণের কোনো ভূমিকা নেই। স্পন্সর শেয়ারের যুগে এ প্রাপ্তির প্রণোদনামূলক ভূমিকা থাকলেও আজ তা কর্তৃত্ব দখলে হাতিয়ার হিসেবে দেখলে ভুল হবে না। নিকট অতীতে সেই কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠায় নানা ধরনের শক্তি প্রয়োগ করা হয়েছে। নিঃসন্দেহে সেই শক্তি প্রয়োগে পর্ষদের অভ্যন্তরীণ কার্যনীতি, ব্যবস্থাপনা পরিচালকের সঙ্গে চেয়ারম্যানের একক স্বাক্ষরের উপস্থিতি এবং পছন্দসই পরিচালক নির্বাচনের ভূমিকা থেকেছে। কিন্তু এসবই সম্ভব হয়েছে রাষ্ট্রক্ষমতা ব্যবহার করে এবং নির্দিষ্ট বিধি সংস্থাকে (বাংলাদেশ ব্যাংক) বা সেখানকার দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের বিপথে নিয়ে। সেই অন্ধকার থেকে বেরিয়ে আসতে হলে তিন স্তরে অর্থাৎ পেশাদারত্ব, নিয়মনীতি ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কৃতিতে আমূল পরিবর্তন আনা জরুরি। এসব কাজে কেন্দ্রীয় ব্যাংক, ব্যাংক পর্ষদ এবং ঊর্ধ্বতন ব্যবস্থাপকদের মাঝে সমন্বয় প্রয়োজন। তবে তা শুরু হওয়া প্রয়োজন বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দিষ্ট শাখাগুলো থেকে।
লক্ষণীয় যে এতদিনকার কার্যনির্দেশ অনেক ক্ষেত্রে ‘লুটেরা’দের স্বার্থে প্রণীত হয়েছিল। যেমন, শ্রমিকদের বেতন-ভাতা দেয়ার জন্য রফতানিকারী ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানকে ঋণ দেয়া যেতে পারে বলে যে চিঠি পাঠানো হয়েছিল, তাকে নির্দেশ গণ্য করে অনেকে পরিশোধ সম্ভাবনা নিশ্চিত না করে পছন্দসই প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দেয়ার সুযোগ পেয়েছে।
এসব কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সব কার্যনির্দেশ নিরীক্ষা করে অস্বচ্ছতা দূর করা প্রয়োজন। অনেক ক্ষেত্রে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিষয়ে চোর-পুলিশের খেলায় না নেমে বিধি সংস্থাকে নীতি পর্যায়ে তার কর্মপরিধি সীমিত রাখা প্রয়োজন। সীমিত বলয়ে নজরদারি রাখার একটি উপায় হলো (ছয় বা অধিকে খাতে) আয়-বণ্টনের বলয় নিয়মিত নজরদারিতে আনা এবং খাতওয়ারি আনুপাতিক বণ্টনের পরিসীমা বেঁধে দিয়ে ব্যাংকের কর্মকাণ্ড কাঙ্ক্ষিত পথে আটকে রাখতে পারে।
সেই সঙ্গে একটি স্বাধীন দেশের অর্থ ব্যবস্থার দায়িত্বে রত বিধি সংস্থাকে ব্যাংকের মাধ্যমে অর্থপ্রবাহের তথ্য নিয়মিত বিশ্লেষণ করে ব্যাংকগুলোকে দিকনির্দেশনা দেয়া প্রয়োজন। এসব ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিনির্ধারণী বিভাগের সঙ্গে পর্ষদের প্রত্যেক পরিচালকের মতবিনিময়ের সুযোগ থাকা প্রয়োজন। কারণ পর্ষদ পর্যায়ে গণতান্ত্রিক চর্চা নিশ্চিত করা ব্যাংক খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠার পূর্বশর্ত।
পরিশেষে উল্লেখ করব যে আন্তর্জাতিক অর্থ ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের হয়ে একজন নজরদারির ভূমিকা থেকে দেশজ বিধি সংস্থার কার্যপরিধিতে গুণগত পরিবর্তন আনা প্রয়োজন। স্বদেশী ভাবনাকে উদ্বুদ্ব করতে হলে তথ্যনির্ভর কর্মনির্দেশনা দেয়ার জন্য স্বনিয়ন্ত্রিত গবেষণা চালু করা জরুরি, যা প্রতিটি ব্যাংকে বিস্তৃত করা আবশ্যিক। এসবের জন্য সামষ্টিক পরিবেশ তৈরিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংককেই অগ্রণী ভূমিকা নিতে হবে, যেখানে অন্যান্য সামর্থ্যবান ব্যাংক শরিক হতে পারে।
সাজ্জাদ জহির: নির্বাহী পরিচালক, ইকোনমিক রিসার্চ গ্রুপ (ইআরজি)