সময়ের ভাবনা

পুরাকীর্তি ব্যবস্থাপনার আধুনিকায়ন আবশ্যক

একটি জাতি কতটা সমৃদ্ধ, তা মাপার অন্যতম প্যারামিটার তাদের ইতিহাস সচেতনতা। আর ইতিহাস সচেতনতা নির্ণয় করা যায় তাদের পুরাকীর্তি ও ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ ব্যবস্থাপনা দেখে। আর এ প্যারামিটার ধরে বিচার করতে গেলে নিঃসন্দেহে আমরা জাতি হিসেবে পিছিয়ে আছি। সরকারিভাবে তো যথাযথ কোনো উদ্যোগ নেই-ই, এমনকি সাধারণ মানুষও এসব স্থাপনার ইতিহাস ও গুরুত্ব

একটি জাতি কতটা সমৃদ্ধ, তা মাপার অন্যতম প্যারামিটার তাদের ইতিহাস সচেতনতা। আর ইতিহাস সচেতনতা নির্ণয় করা যায় তাদের পুরাকীর্তি ও ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ ব্যবস্থাপনা দেখে। আর এ প্যারামিটার ধরে বিচার করতে গেলে নিঃসন্দেহে আমরা জাতি হিসেবে পিছিয়ে আছি। সরকারিভাবে তো যথাযথ কোনো উদ্যোগ নেই-ই, এমনকি সাধারণ মানুষও এসব স্থাপনার ইতিহাস ও গুরুত্ব সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নয়। এগুলো কেবল হাতে গোনা কয়েকজন গবেষকের আগ্রহ হয়েই টিকে আছে। বিষয়টি নিঃসন্দেহে জাতি হিসেবে আমাদের দৈন্যের পরিচয় দেয়। যতই যুক্তি দেয়া হোক না কেন, এ বিষয়ে দায় এড়ানোর কোনো সুযোগ নেই।

এক শতাব্দী আগেও ঢাকা শহরে বিশ্বের নানা দেশের নানা জাতির মানুষের সমাগম ছিল। ফরাসি, আর্মেনীয়, পর্তুগিজ, ওলন্দাজ, ইংরেজসহ নানা জাতি, বর্ণ ও সম্প্রদায়ের মানুষ ভাগ্যান্বেষণে এ শহরে বসতি স্থাপন করেছিল। তারও আগে মোগল আমলে প্রথমবারের মতো বাংলার রাজধানী হিসেবে এ শহর স্বীকৃতি পায়। সে সময় বাংলার নবাব, সুবাদার ও নাজিমদের অন্যতম আবাস ছিল এ শহর। তখন আরব, পারস্য, ইয়েমেন ইত্যাদি মুসলিম অধ্যুষিত দেশ থেকে মানুষ এসে এখানে বসতি স্থাপন করেছিল। মোগল ও ঔপনিবেশিক আমলে ঢাকা প্রকৃতই একটি বৈশ্বিক শহরে পরিণত হয়েছিল। বর্তমানে যেসব দেশ ও অঞ্চল আমাদের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু, তৎকালে সেসব দেশ থেকেই মানুষ পঙ্গপালের মতো ঢাকার বুকে আশ্রয় নিয়েছিল। বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষের সমন্বয়ে ঢাকার যৌবন তখন ফুলেফেঁপে উঠেছিল।

বুড়িগঙ্গার তখন ভরা যৌবন। তাই তাকে কেন্দ্র করেই মোগলরা তিলোত্তমা এ নগরীকে তিলে তিলে গড়ে তুলেছিল। তখনকার ঢাকাই কালের বিবর্তনে আজকে পুরান ঢাকায় পরিণত হয়েছে। সেখান থেকে কালক্রমে বাড়তে বাড়তে ঢাকা বর্তমান রূপ লাভ করেছে।

স্থাপত্যকীর্তির দিক দিয়ে বিচার করতে গেলে ঢাকার জুড়ি মেলা ভার। এখানে যখন যে জাতির মানুষ এসেছে, তারা নিজেদের দেশ ও অঞ্চলের সুনির্দিষ্ট স্থাপত্যরীতি অনুসারে এখানে নানা স্থাপনা নির্মাণ করেছে। আর এর শুরুটা ব্যাপকভাবে হয়েছিল মোগলদের হাতে। ঢাকার প্রতিটি অলিগলিতে স্থাপিত ভবনগুলো আজও এর প্রমাণ বহন করছে। লালবাগ কেল্লা, ছোট কাটরা, বড় কাটরা, বিভিন্ন শাহি মসজিদ আজও মোগল স্থাপত্যকীর্তির প্রমাণ হিসেবে টিকে আছে। ভাবতেই রোমাঞ্চ লাগে, একসময় এর অলিগলি দিয়েই ঘোড়ার গাড়িতে চড়ে যেতেন সুবাদার ও নবাবরা। কেবল মোগলরাই নয়, এর পরে যারাই এসেছেন, সবাই কিছু না কিছু নজির স্থাপন করে গেছেন ঢাকার বুকে। পোগোজ স্কুল, আর্মেনীয় ধাঁচের বাড়ি ও চার্চ, ফরাসি স্থাপত্যশৈলী, ব্রিটিশ নকশা ইত্যাদির নানা উদাহরণ ছড়িয়ে আছে ঢাকা শহরজুড়ে। এমনকি অগ্নি উপাসক পার্সি সম্প্রদায়ের মানুষও একসময় এ শহরে বাস করত। কিন্তু ঢাকার সে যৌবন আর নেই। ঔপনিবেশিক আমল শেষ হয়ে যাওয়ার পর এ শহরের জৌলুসও যেন শেষ হয়ে যায়। ঔপনিবেশিক শাসনের গ্যাঁড়াকল থেকে আমরা মুক্তি পেয়েছি, সেটি ভালো। কিন্তু একই সঙ্গে আমরা এসব ঐতিহ্যবাহী স্থাপনার প্রতিও উদাসীন হয়ে পড়েছি। অযত্নে, অবহেলায় এসব পুরাকীর্তি ধুঁকে ধুঁকে আজ ধ্বংসের শেষ সীমায় এসে পৌঁছেছে। নিতান্তই কিছু ব্যতিক্রম বাদে সেগুলো সংরক্ষণে উল্লেখযোগ্য কোনো তৎপরতাও চোখে পড়ছে না। অথচ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানে এসব পুরাকীর্তি সংরক্ষণের ব্যাপারে স্পষ্ট দিকনির্দেশনা আছে। সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগের ২৪ নং অনুচ্ছেদে বলা আছে, ‘বিশেষ শৈল্পিক কিংবা ঐতিহাসিক গুরুত্বসম্পন্ন বা তাৎপর্যমণ্ডিত স্মৃতিনিদর্শন, বস্তু বা স্থানসমূহকে বিকৃতি, বিনাশ বা অপসারণ হইতে রক্ষা করিবার জন্য রাষ্ট্র ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন।’ কিন্তু কাজির গরু কেবল কেতাবেই থেকে গেল, গোয়ালে এর কোনো হদিস পাওয়া যাচ্ছে না। ঢাকার ঐতিহাসিক স্থাপনা ও পুরাকীর্তির বর্তমান বিলুপ্তপ্রায় দশা যেন সংবিধানের এ অনুচ্ছেদকে উপহাস করছে।

কয়েকদিন আগে পুরান ঢাকায় হাঁটার সুযোগ হয়েছিল। সরজমিনে দেখলাম, প্রতিটি ঐতিহাসিক ভবন ও স্থাপনার কী দৈন্যদশা! কোনো কোনোটির কেবল সম্মুখভাগই কোনো রকমে টিকে আছে। প্রায় সব ভবন নানা ব্যবসায়িক আড়তদারের দখলে। প্রতিটি রাস্তায় মানুষ যেন কিলবিল করছে। হাঁটার কোনো জো নেই। রিকশা, ভ্যান, ট্রাক, মানুষ সব মিলিয়ে যেন সুঁই ফোটানোরও জায়গা নেই। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ধুলাবালি। রাস্তার মাঝখানেই হকাররা ভ্যানে করে বিভিন্ন দ্রব্যের পসরা সাজিয়ে বসেছেন। কোনো রকমে গা বাঁচিয়ে হেঁটে চলে গেলাম ফরাসগঞ্জ। আহা! কী বিবর্ণ দশা। এখানেই অবস্থিত ঐতিহ্যবাহী নর্থব্রুক হল, রূপলাল হাউজ, বিবি কা রওজা। প্রতিটিরই বিবর্ণ দশা। নর্থব্রুক লাইব্রেরির অস্তিত্ব প্রায় চোখেই পড়ে না। সেখানে গিয়ে দেখলাম হলটির সামনে কিছু লোক ক্যারম খেলছে। তারা কি আদৌ জানে এ ভবনের গুরুত্ব! নর্থব্রুক হলের দরজা, জানালা সব ভাঙা। তবে পুরান ঢাকার অন্যান্য ঐতিহাসিক ভবন ও স্থাপনার তুলনায় এর ভাগ্য ভালোই বলতে হবে। এটি এখনো দখল হয়ে যায়নি। আশার ব্যাপার হলো, এর সংস্কারের কাজ চলছে। কিন্তু ফরাসগঞ্জ এলাকার অন্য ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলোর সঙ্গে ভাগ্য সদয় আচরণ করেনি। ফরাসগঞ্জের শ্যামবাজার থেকে হেঁটে সূত্রাপুর পর্যন্ত গেলে রাস্তার দুই পাশে এমন অনেক বিলুপ্তপ্রায় ভবন ও দেয়াল চোখে পড়বে, যেগুলোর কারুকার্য ও নকশা দেখে সহজেই বোঝা যায়, এগুলো একসময় কতটা জমকালো ছিল। কিন্তু এখন সেগুলো দখল হয়ে কোথাও হয়তো টিম্বার মিল হয়েছে, কোথাও বা বসেছে আড়ত। তেমনই একটি ভাগ্যহত ভবন হলো ঐতিহ্যবাহী রূপলাল হাউজ! উনিশ শতকের ষাটের দশকে নির্মিত দ্বিতল ভবনটি নির্মাণ করেছিলেন ঢাকার বিখ্যাত আর্মেনীয় জমিদার আরাতুন। তার কাছ থেকে কিনে নিয়ে ভবনটি পুনর্নির্মাণ করেছিলেন ব্যবসায়ী দুই ভাই রূপলাল দাস ও রঘুনাথ দাস। তখন এর নাম হয় ‘রূপলাল হাউজ’। ‘মার্টিন অ্যান্ড কোং’-এর একজন স্থপতি অভিনব এ ভবনের নকশা করেছিলেন। বর্তমানে এ ভবনকে আড়তদাররা এমনভাবে ঘিরে রেখেছেন যে এর পাশ দিয়ে গেলেও বোঝার উপায় নেই এখানে এত চমৎকার একটি স্থাপনা আছে। এর দরজা, জানালাগুলো সব ভাঙা। সংস্কারের কোনো উদ্যোগ নেই। বিবর্ণ এ ভবন কোনো রকমে ধুঁকে ধুঁকে টিকে আছে। এমনকি ফরাসগঞ্জ এলাকায় যারা বাস করেন, তাদের অধিকাংশই এ ভবনের অস্তিত্ব সম্পর্কে জানেন না। ফলে এটি খুঁজে পেতে বেশ বেগ পেতে হয়েছিল। অনেককে জিজ্ঞাসা করার পর অবশেষে একজন বলতে পারলেন। এমনই দশা!

কেবল ঢাকা শহরই নয়, বাংলাদেশের অধিকাংশ পুরাকীর্তি ও ঐতিহাসিক স্থাপনারই খারাপ অবস্থা। জাতি হিসেবে আমরা যদি নিজেদের অবস্থানকে উন্নত করতে চাই, তাহলে এগুলো সংরক্ষণে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। সরকারি উদ্যোগ তো নিতেই হবে, পাশাপাশি এগুলোর তত্ত্বাবধানে বেসরকারি বিনিয়োগ আকৃষ্টের চেষ্টা করতে হবে। এর সঙ্গে লাগবে জনসচেতনতাও। পুরান ঢাকার ক্ষেত্রে দুটি দিকে গুরুত্ব দিতে হবে। এক. এর পুরাকীর্তি ও ঐতিহাসিক ভবনগুলো আধুনিক পদ্ধতিতে সংরক্ষণ করতে হবে এবং দুই. বায়ান্ন বাজার তেপ্পান্ন গলির এ শহরকে সুব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এর মরণদশা থেকে উদ্ধার করতে হবে।

আমরা প্রচুর পয়সা খরচ করে ইউরোপ-আমেরিকায় যাই। তাদের পুরাকীর্তি ও ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলো দেখে বিমোহিত হই। অথচ ঘরের কাছেই নিজেদের এত সম্পদ যে আছে, সেগুলো সম্পর্কে আমরা নিজেরাই জানি না! অন্যদের জানাব কী! দেখাবই বা কী! এ যেন ‘দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া, ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া’র মতো অবস্থা। এ আফসোস ঘুচবে কবে!

নিজাম আশ শামস: লেখক ও সাংবাদিক

আরও