কয়েক মাস ধরে বাংলাদেশে সবচেয়ে আলোচিত বিষয় ‘বিপ্লব’। জুলাই অভ্যুত্থানের পর অনেকে একে বিপ্লব, আবার কেউ কেউ অভ্যুত্থান বলতে চাইছেন। বাংলায় যা-ই বলা হোক না কেন, ইংরেজিতে একে রেভল্যুশন—আরো স্পষ্ট করে ‘কালার রেভল্যুশন’ বলছেন অনেকে। যুক্তি দিয়ে দাবি প্রমাণও করছেন। বিশ্বের যে আন্দোলনগুলো কালার রেভল্যুশন হিসেবে পরিচিত সেগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের জুলাই আন্দোলনের মিল অগ্রাহ্য করার মতো নয়। লক্ষ করার বিষয় হলো, কালার রেভল্যুশনের বেশির ভাগই যে এজেন্ডা নিয়ে শুরু হয়েছিল, বিপ্লবের এক ধাক্কার পর সেসব আর বাস্তবায়ন হয়নি। বলা চলে বিপ্লবের যে গ্রাউন্ড ছিল তা খসে পড়েছে। রঙিলা দালানের মাটির মতো বিপ্লবের মাটিও শক্ত হয়নি।
বাংলাদেশে একটা সময় বিপ্লব বলতে সোভিয়েত ইউনিয়নের বলশেভিক বিপ্লব আর চীনের সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবকে বুঝত লোকে। কিন্তু বিংশ শতকের শুরুর বলশেভিক বিপ্লবের পর দুনিয়ায় আরো বহু বিপ্লব হয়েছে। এমনকি একুশ শতকে এসেও হয়েছে বিপ্লব। সেসবের কতগুলো কালার রেভল্যুশন বলে পরিচিত। সহজ সংজ্ঞায় বলা হয়, কালার রেভল্যুশন মূলত সরকার বা চলতি ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সিংহভাগের অংশগ্রহণ বা সমর্থনে ঘটা অহিংস আন্দোলনের মাধ্যমে চলতি ব্যবস্থাকে পরিবর্তন। আর তা করতে গিয়ে বেশির ভাগ সময় পতন হয় সরকারের। সত্যি বলতে আন্দোলনও একটা সময় আর অহিংস থাকে না; সহিংস হয়ে ওঠে। মানুষের তরফ থেকে না হলেও এস্টাবলিশমেন্টের পক্ষ থেকে করা হয়।
কালার রেভল্যুশনের উদাহরণ দিতে হয় কিছু। মূলত সোভিয়েত-পরবর্তী সময়ের বিপ্লবগুলো এর মধ্যে পড়ে। তার মধ্যে জর্জিয়া, ইউক্রেন ও কিরগিস্তান উল্লেখযোগ্য। বাদ দেয়া যায় না ফেডারেল রিপাবলিক অব যুগোস্লাভিয়ার বিপ্লবও। ২০০০ সালে ঘটেছিল যুগোস্লাভিয়া বুলডোজার বিপ্লব। এরপর ২০০৩ সালে জর্জিয়ায় এলো রোজ রেভল্যুশন। পরের বছর ইউক্রেনে অরেঞ্জ রেভল্যুশন। তার পরের বছর কিরগিজস্তানে টিউলিপ রেভল্যুশন। এ সময়ের পর একটা বিরতির মতো দেখা যায়। এরপর তিউনিসিয়ায় ২০১০-১১ সালে জেসমিন রেভল্যুশন এবং ২০১০-১২ সালে ঘটে আরব বসন্ত। এ সময় থেকে একটা কথা জনপ্রিয় হয়—ইরান, চীন ও রাশিয়া দাবিও করে—এ আন্দোলন বা বিপ্লবের পেছনে পশ্চিমা বিশ্বের ইন্ধন আছে। তারা যেসব দেশে নিজেদের প্রভাব বাড়াতে চায় সেখানেই একটা ‘রঙিলা বিপ্লব’ ঘটিয়ে দেয়।
কালার রেভল্যুশনের ক্ষেত্রে প্রাথমিক ধারণা বা প্রকাশ হলো এটি অহিংস। তবে উল্লিখিত বিপ্লবগুলোর দিকে নজর দিলে আরেকটা বিষয় চোখে পড়ে—প্রায় প্রতিটিতে ছাত্রদের অংশগ্রহণ ছিল। ছাত্র না হলেও তরুণরা ছিল অগ্রগামী। যুগোস্লাভিয়ায় প্রথম এ ঘটনা ঘটে। Otpor (প্রতিরোধ) নামে তারা আন্দোলন শুরু করেছিল। ১৯৯৮ সালে বেলগ্রেড বিশ্ববিদ্যালয়ে স্লোভোদান মিলোসোভিচের বিরুদ্ধে শুরু হয় প্রতিরোধ। বলকান কসাই নামে পরিচিত ছিলেন এ শাসক। পুলিশি হামলার পর ২০০০ সালে Gotov je (তার সমাপ্তি) আন্দোলন শুরু হয়। শেষ পর্যন্ত পতন হয়েছিল মিলোসোভিচের। সার্বিয়ায় আন্দোলনকে বুলডোজার রেভল্যুশন বলা হয়। কেননা আন্দোলনের সময় একটা বুলডোজার নিয়ে আন্দোলনকারীরা সার্বিয়ার রেডিও-টেলিভিশন ভবনে প্রবেশ করেছিল। ওখান থেকেই মিলোসোভিচ তার প্রপাগাণ্ডা চালাতেন।
জর্জিয়ার বহু মানুষ তাদের ২০০৩ সালের নির্বাচন নিয়ে খুশি ছিল না। নভেম্বরে শুরু হয় আন্দোলন। এদুয়ার্দ শেভারনাদজের ক্ষমতা হারানোয় এর সমাপ্তি। এর মাধ্যমে জর্জিয়ায় সোভিয়েত যুগ শেষ হয়। অরেঞ্জ রেভল্যুশনেরও প্রায় একই ঘটনা। আসকার আকায়েভকে ক্ষমতা থেকে সরায় টিউলিপ রেভল্যুশন। কিরগিজস্তানের এটি ছিল প্রথম বিপ্লব। এরপর আসে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। ২০০৯ সালে মলদোভায়ও আন্দোলন হয়েছিল। তবে আমাদের দেশের জন্য সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক সম্ভবত আরব বসন্ত ও তিউনিসিয়ার জেসমিন বিপ্লব। আরব বসন্তের গুরুত্ব আছে এর মুসলিমসংশ্লিষ্টতার জন্য। আর তিউনিসিয়ার বিপ্লবের ধরন ও পরবর্তী অবস্থার সঙ্গে বাংলাদেশের মিল রয়েছে।
কালার রেভল্যুশনের কিছু বিষয় একই রকম। যেমন আবর বসন্তকে অন্তত বাইরে থেকে দেখে মনে হয়, আন্দোলনটি ছিল আরবের সাধারণ মানুষের দাবি-দাওয়ার আন্দোলন। তিউনিসিয়া থেকে এর সূচনা। এরপর তা ছড়িয়ে পড়ল লিবিয়া, মিসর, ইয়েমেন, সিরিয়া ও বাহরাইনে। সব আন্দোলনই শুরু হয়েছিল মানুষের মৌলিক চাহিদাগুলোর দাবি থেকে। বিশেষত তিউনিসিয়ার মানুষের আন্দোলন ছিল বেকারত্ব, দুর্নীতি, মূল্যস্ফীতির বিরুদ্ধে। তারা রাজনৈতিক অধিকার ও বাকস্বাধীনতা চাচ্ছিলেন। স্বাভাবিকভাবেই আন্দোলন একসময় সরকারবিরোধী হয়ে পড়ে। জাইন এল আবেদিন বেন আলীকে উৎখাতের মধ্য দিয়ে এর সমাপ্তি হয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠা করা হয় যার প্রধানমন্ত্রী হন মোহাম্মদ ঘানুচি।
কিরগিজস্তানের অন্তর্বর্তী সরকার বেশকিছু সমস্যায় পড়েছিল। এর প্রথমেই ছিল জমির ওপর অধিকার। সশস্ত্র কৃষকরা নানা জায়গায় জমি দখল শুরু করেছিল। পুলিশ তা থামাতে পারেনি। এছাড়া আন্দিজানের অভিবাসী, শরণার্থীদের নিয়েও সমস্যায় পড়েছিল সরকার। এদিকে তিউনিসিয়ায় বিপ্লবের পর সর্বপ্রথম যে নেতিবাচক দিকটি নজরে আসে তা হলো জাইন এল আবেদিনের প্রশাসনের সুবিধাভোগী লোকদের ক্ষমতা। তারাই আবারো নতুন সরকারে যুক্ত হয়েছিল। এরপর আন্দোলনের সময়কার আহতরা চিকিৎসা পাননি। আরব বসন্তের সূচনাকারী এ আন্দোলনের অন্যতম এজেন্ডা বা চাহিদা ছিল মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ। কিন্তু নতুন সরকারের আমলে মূল্যস্ফীতি কমেনি। শিক্ষা ও তরুণদের কর্মসংস্থানেও আসেনি কোনো নতুন বার্তা। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রদের ফেরানোর কোনো তোড়জোড় ছিল না। সেক্যুলার ও উগ্র ডানপন্থীদের মধ্যে সংঘাতও বাড়ে। সব মিলিয়ে সরকার সফল হয়নি। এখন অবধি বারবার দেশটির সরকার বদল হয়েছে।
বিপ্লব নিয়ে কথা বলতে গেলে ব্যর্থ বিপ্লবের সংখ্যাই বেশি দেখা যায়। আবার যেসব বিপ্লবকে সফল বলে মনে হয়, বিপ্লব-পরবর্তী সময়ে দেখা যায়, যে আশা ও সম্ভাবনা নিয়ে বিপ্লব হয়েছিল তা বাস্তবায়ন হয়নি। না হওয়ায় বিপ্লবোত্তর পরিস্থিতি আরো খারাপের দিকে যেতে থাকে। মূলত যে ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে বিপ্লব হয় তা-ই খসে যেতে শুরু করে। বাস্তবিক কিছু বিপ্লবে হয়তো ভিত্তি থাকেও না। পরিকল্পনা থাকে না।
বাংলাদেশের জুলাই অভ্যুত্থান পূর্ণতা পায় ৫ আগস্টে। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের মধ্য দিয়ে তৈরি হয় নতুন সম্ভাবনা। কিন্তু একটা প্রশ্ন উঠে আসে এর পরপরই। জুলাই অভ্যুত্থানকে যে জুলাই অভ্যুত্থান বলা হচ্ছে তা কি আসলেই জুলাইয়ে শুরু হয়েছিল? কোটা সংস্কার আন্দোলনই কি এর সূতিকাগার? সেটা মেনে নিলে বলতে হয় জুলাই আন্দোলনের সূচনা ২০১৮ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলন দিয়ে। সেখানে আরো বড় ভূমিকা রেখেছিল ওই বছরেরই নিরাপদ সড়ক আন্দোলন। সেই সময় নিরাপদ সড়ক আন্দোলনকে কেউ কেউ ‘নীল-সাদা বিপ্লব’ বলেছিলেন। মূলত ২০১৮ সালের স্কুল-কলেজের সেই ছাত্ররাই নেমেছিল ২০২৪ সালে। তারা ততদিনে পরিণত হয়েছে অনেকটা। ২০১৮ সালের ভুলগুলো ছয় বছর পর আর করেনি। কিন্তু তারাও কি বুঝেছিল আওয়ামী লীগকে সরানো সম্ভব?
৫ আগস্টের পর প্রায় তিনদিন দেশ সরকারহীন ছিল। মার্চ টু ঢাকার পরিকল্পনা থাকলেও সমন্বয়ক বা কারো হয়তো বিশ্বাস ছিল না সরকার পতন হবে। তাই তারা নতুন সরকারের কোনো পরিকল্পনা করেনি। বিপ্লব প্রশ্নবিদ্ধ হওয়া শুরু করেনি তখনো। প্রশ্ন উঠেছিল, যখন মাঠের নেতারা সেনাপ্রধানের সঙ্গে বসার আগে রাজনৈতিক দলের নেতারা ডাক পেলেন। এরপর এক সময় জানা গেল আন্দোলন নাকি সাধারণ ছাত্ররা করেনি, এর পেছনে ছিল ছাত্রশিবির। আবার তারা নাকি লুকিয়ে ছিল ছাত্রলীগের মধ্যে। ৫ আগস্ট-পরবর্তী বাংলাদেশের ঘটনাবলি ক্রিস্টোফার নোলোনের সিনেমার চেয়েও প্যাঁচালো। সেখানে নতুন নতুন মাস্টারমাইন্ডের খবর আসে দুদিন পরপর। আবার প্রধান উপদেষ্টা বলে বসেন আন্দোলন গোছানোই ছিল।
বিপ্লব ব্যর্থ হয় কেন? দেশ বা সময়ভেদে এর উত্তর আলাদা হতে পারে। তবে সাধারণ একটা উত্তর হলো—আন্দোলন গড়ে তোলার সময় যে আশ্বাস দেয়া হয়, স্বপ্ন দেখানো হয়, পরে তা পূর্ণ না করা। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম ব্যর্থতা আইন-শৃঙ্খলা ব্যবস্থা পুনরুদ্ধার করতে না পারা। তিনদিন সরকারহীন রাষ্ট্রে খুব বেশি রাহাজানি, ডাকাতি, সন্ত্রাস না হলেও এরপর তা কম হয়নি। আরো পরে যখন রাশ টানার প্রয়োজন ছিল, তখনো পুলিশকে ফেরানো হয়নি ঠিকভাবে। প্রতিদিন ঢাকায় হয়েছে কোনো না কোনো আন্দোলন। সেখানে কেবল পতিত ফ্যাসিস্টের ছায়া দেখেছে সরকার ও বিপ্লবকারীরা। এ লেখা যখন তৈরি হচ্ছে (ফেব্রুয়ারী দ্বিতীয়ার্ধ্ব), তখন শোনা যাচ্ছে যাত্রীবাহী বাসে ডাকাতির কথা। সেই সঙ্গে এখনো চলছে আন্দোলনের কৃতিত্ব নেয়ার প্রতিযোগিতা।
আন্দোলনের ভিত্তি নিয়ে কথা বলা প্রয়োজন। কোটা সংস্কার বা বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন থেকে সরকার পতন হয়েছে—এটা বাহ্যিক দৃষ্টিতে বলাই যায়। তবে বাস্তবিক, এ আন্দোলনের পেছনে ছিল বহু মানুষ। আন্দোলনের পর কৃতিত্ব নেয়ার জন্য নতুন নতুন বহু দল, গোষ্ঠী বেরিয়ে আসছে। তারা দাবি করছে, এ আন্দোলন বা বিপ্লবের তারাই ছিলেন মূল শক্তি। এসব কিছুর মধ্যে বারবার বিপ্লবটাই প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। আয়নাঘর প্রকাশ করতে সময় লাগল ছয় মাস। ততদিনে তরুণ উপদেষ্টাদের অনেকেও তাদের বচন ও বাচনের কারণে প্রশ্নবিদ্ধ। এখন নতুন দল গঠন নিয়ে আরেকবার উঠল বিতর্ক।
সব মিলিয়ে এ কথা বাহুল্য হবে না যে বিপ্লবের মাটি শক্ত করার বদলে বিপ্লবের পর এর মাটি আলগাই হয়েছে। গানে বলা হয়েছিল ‘দিনে দিনে খসিয়া পড়িবে রঙ্গিলা দালানের মাটি’, এদিকে পুরোনো বিপ্লবগুলোয় যেমন হয়েছে, আমাদের বিপ্লবের মাটিও খসে পড়তে শুরু করেছে।
মাহমুদুর রহমান: লেখক ও সাংবাদিক